বেইজিংয়ের সেই দিনগুলো: পর্ব-৫
চীন সরকারের বৃত্তিতে বেইজিং সফর। ভাষা শেখার পর বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্টস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন লেখক। সাত পর্বের পঞ্চম পর্ব আজ
বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটে আমাদের প্রথম দিনের বেলাটা বেশ কর্মব্যস্ততার মধ্যেই কেটে গেল। সন্ধ্যা ছয়টায় রাতের খাবারের জন্য দল বেঁধে আবার হাজির হলাম ফরেন স্টুডেন্টদের নির্ধারিত ডাইনিংয়ে। খাবারের আইটেমের তেমন কোনো রকমফের দেখতে পেলাম না। লাঞ্চের সময় যেসব আইটেম দেখেছিলাম, এখনো আবার তাদের দেখা পেলাম। অর্থাৎ তেমন কোনো মুখরোচক কিংবা উপাদেয় খাবার এখানে যে পাওয়া যাবে না সেটা মোটামুটি বোঝা হয়ে গেল। তা ছাড়া এত তাড়াতাড়ি ডিনার খাওয়ার অভ্যাস বাংলাদেশিদের নেই। ফলে রাতে যে আবার খিদে পাবে, সেটা বেশ পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম। তাই অনেকটা অসহায়ের মতো এর প্রতিকার কী হতে পারে, সেটা নিয়েই আমাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। আমরা সিনিয়র স্টুডেন্টদের কাছ থেকে এর প্রতিকারের ব্যবস্থাপত্র ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছি—সেটা হলো নিজেদের রান্না করে খেতে হবে। তবে বললেই যে হুট করে রান্না করে খাওয়া-দাওয়া শুরু করা যাবে, তা কিন্তু নয়। এর জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন। রান্নার জন্য আমাদের প্রথমে কিনতে হবে হাঁড়িপাতিল এবং ইলেকট্রিক স্টোভ। হলুদ, মরিচ, জিরা, ধনিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের মসলাপাতির ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই–না রান্না শুরু করা যাবে। তার ওপর আমাদের কারোরই নেই রান্নার পূর্ব অভিজ্ঞতা। তবে আশার কথা এই যে আমরা কেউ–ই হতোদ্যম হলাম না বরং নতুন এক অভিজ্ঞতা অর্জনের উত্তেজনায় মুখিয়ে উঠলাম। আপাতত যেহেতু নিজেদের উদ্যোগে রান্না শুরু করা যাচ্ছে না, তাই ভেবে দেখলাম যে রাতের বেলায় খিদে পেলে আমাদের গন্তব্য হবে ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটের পেছনের গেট লাগোয়া ‘শিয়াও মাই পু’ বা কনভিনিয়েন্স স্টোর। স্টোরটির পাশে অবশ্য একটি ছোট রেস্টুরেন্টও আছে, কিন্তু সেখানকার খাবারের স্বাদের সঙ্গে আমরা তখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। তাই আপাতত কনভিনিয়েন্স স্টোরের ব্রেড, বিস্কুট কিংবা ইয়োগার্টের ওপরই আমাদের ভরসা করতে হচ্ছে। ইয়োগার্টকে চায়নিজে বলে সুয়ান-নাই। ‘সুয়ান’ অর্থ টক আর ‘নাই’ অর্থ দুধ। সেই সময় বেইজিংয়ের বহুল প্রচলিত ইয়োগার্টটি পাওয়া যেত একটি পোর্সিলিনের বোতলে। বেইজিংয়ের প্রথম যে খাবারটি আমাদের কাছে উপাদেয় মনে হয়েছিল, সেটি হচ্ছে সেই বিশেষ ব্র্যান্ডের ‘সুয়ান-নাই’।
ফরেন স্টুডেন্টদের জন্য নির্ধারিত হোস্টেলগুলোয় মাত্র একটি করে গোছলখানা রয়েছে। এই একটি মাত্র গোছলখানায় অনেক শাওয়ার-বুথ রয়েছে, ফলে অনেকেই একই সঙ্গে শাওয়ার নিতে পারে। আমি আমার ক্যাডেট কলেজের জীবনে এ ধরনের শাওয়ার-বুথ ব্যবহার করে এসেছি। ফলে আমার জন্য এটা নতুন কিছু নয়। তবে যেটা নতুন সেটা হচ্ছে, এখানকার শাওয়ার নেওয়ার বিশেষ কিছু নিয়ম-কানুন। শাওয়ার নেওয়ার জন্য নির্ধারিত সময় হচ্ছে সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দশটা। কারণ, এই সময়টাতেই শাওয়ারের জন্য গরম পানি আসে। প্রতিটি শাওয়ারে দুটি ট্যাপ আছে, লাল রঙের ট্যাপে আসে গরম পানি আর নীল রঙেরটায় ঠান্ডা পানি। এই নির্ধারিত সময়ের বাইরে দুটি ট্যাপেই আসবে বরফ শীতল পানি। তাই গোছল করতে হলে অবশ্যই সেটা করতে হবে সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দশটার ভেতর। প্রথম যেদিন আমরা বেইজিং পৌঁছাই, সেদিন সবকিছু গুছিয়ে হোস্টেলে উঠতে উঠতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল, তাই আমাদের কারোরই গোছল করা হয়নি। তাই আজ দ্বিতীয় দিনে আমরা সবাই তক্কে তক্কে ছিলাম কখন গরম পানি আসবে। সিনিয়র স্টুডেন্টরা আমাদেরকে প্রথম দিনই সাবধান করে দিয়েছিলেন গরম পানির ট্যাপ কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সে ব্যাপারে। পই পই করে বলে দিয়েছিলেন গরম আর ঠান্ডা পানি মিশিয়ে সেটার তাপমাত্রা পরখ করার পর আমরা যেন শাওয়ারের নিচে দাঁড়াই। তা না হলে বেশি গরমে শরীর ঝলসে যাওয়ার ভয় থাকে। গোছলের পর আমরা সবাই বেশ চাঙ্গা বোধ করি। আর রাত তখন মাত্র আটটা বাজে। তাই সবাই দল বেঁধে নিচতলাতে টিভিরুমে গিয়ে হাজির হলাম। টিভির সব কটি চ্যানেলই চায়নিজ ভাষায়। তাই কী দেখাচ্ছে, সেটা আমাদের বোধগম্য হচ্ছিল না। তবু আমরা বেশ মজা পাচ্ছিলাম। একসময় আমরা আবিষ্কার করি যে প্রতি রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার সময় ডিজনির বিখ্যাত কার্টুন ‘মিকি মাউস’ আর ‘ডোনাল্ড ডাক’ টিভিতে দেখানো হয়। চায়নিজে ডাবিং করা ‘মিকি মাউস’-এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘মি লাউ-শু’, আর ‘ডোনাল্ড ডাক’-এর ‘থাং লাও ইয়া’। চীনে তখন যেসব বিদেশি সিনেমা টিভিতে কিংবা প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হতো সেগুলো সবই চায়নিজে ডাবিং করে দেখানো হতো। ফলে এই ডাবিংয়ের কারণে তখন চীনে অনেক ‘ভয়েস আর্টিস’ তারকাখ্যাতি লাভ করেছিলেন। যেমন ‘ডোনাল্ড ডাক’-এর ভয়েস আর্টিস লি ইয়াং। ডিজনির এই কার্টুন দুটি চীনে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। সেই সম্পর্কে রিপোর্ট করতে গিয়ে ১৯৮৮ সালে ‘লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস’ পত্রিকা ‘মিকি মাউস চার্মস চায়নিজ ভিউয়ারস’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে চীনের বর্ষীয়ান নেতা দেং শিয়াওপিং-ও প্রতি রোববার সন্ধ্যায় তাঁর নাতিকে নিয়ে এই কার্টুন উপভোগ করেন।
টিভিরুমে অন্য দেশের ফরেন স্টুডেন্টরাও এসে ভিড় জমাত জনপ্রিয় এই কার্টুন দেখার জন্য। তখন তাদের সঙ্গে টুকটাক আলাপের মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে আমার। সেইসব ফরেন স্টুডেন্টের ভেতর ছিল তুরস্ক থেকে আসা একজন ডাক্তার। জানতে পারলাম সে এখানে আকুপাংচারের ওপর একটা কোর্স করতে এসেছে। কিছু ইয়েমেনি ও সোমালি স্টুডেন্টের সঙ্গেও আলাপ হলো যারা আমাদের মতো আন্ডারগ্রেড করতে এসেছে। এই সোমালি স্টুডেন্টদের মধ্যে আবদুস সালাম নামের একজন আমাকে তার একটা ছবি দিয়েছিল, যা আমার অ্যালবামে এখনো সংরক্ষিত আছে। কিছু কিছু সোমালিয়ান আর ইয়েমেনিকে লুঙ্গি পরা দেখে অবাক হলাম। ওরাও যে আমাদের মতো লুঙ্গি পরে, সেটা আগে জানা ছিল না। আসলে বেইজিংয়ে আসার পর প্রতি মুহূর্তেই কিছু–না কিছু নতুন দেখছি কিংবা জানছি। নতুন কিছু জানা কিংবা দেখার ভেতর একধরনের উত্তেজনা থাকে, আমরা সবাই সেই উত্তেজনাকে বেশ উপভোগ করছিলাম। আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে প্রতিদিনই কিছু–না কিছু জমা হচ্ছিল।
আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য চায়নিজ সরকারের অবদানও ছিল বিশেষভাবে উল্লেখ্য। কারণ, ফরেন স্টুডেন্টদের জন্য আয়োজন করা হতো বেইজিংয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শনের। এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর তালিকায় প্রথমেই ছিল বিখ্যাত চীনের প্রাচীর গ্রেট ওয়াল। বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউট থেকে বাসে করে আমাদের একদিন নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। বেইজিং শহর থেকে প্রায় সত্তর কিলোমিটার দূরে পাতালিং নামক একটি স্থানে গ্রেট ওয়ালের একটি অংশকে রেনোভেট করে ট্যুরিস্টদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। আমাদের সেখানেই নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেট ওয়ালকে চায়নিজে বলা হয়ে থাকে ‘ঠ্রাং ঠ্রেন’, যার সরল অর্থ হচ্ছে ‘লম্বা দেয়াল’। সেই ছোটবেলা থেকে চীনের যে মহাপ্রাচীরের কথা শুনে এসেছি, সেটাকে চর্মচক্ষু দিয়ে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতাটি ছিল বেশ উত্তেজনাকর। আমরা সারা দিন গ্রেট ওয়ালের বিভিন্ন অংশে হেঁটে বেড়াই। সেই সঙ্গে আমাদের এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বেশ কিছু ছবি তুলে রাখি। সেই ছবিগুলো আজও আমার অ্যালবামে সংরক্ষিত আছে। পাতালিং নামক স্থানে শুধু যে গ্রেট ওয়ালের একটি অংশ রয়েছে তা নয়, সেখানে একটি বড় ‘ওয়াটার রিজার্ভের’ এবং একটি ‘স্লুইসগেট’ও রয়েছে, যেখানে আমাদের অন্য আরেক দিন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমরা অন্য ট্যুরিস্টদের মতো সেই রিজার্ভের শান্ত পানিতে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়েয়েছি আর স্লুইসগেটের বিশাল আকৃতি দেখে অবাক হয়েছি। এ ছাড়া বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউট থেকে আমাদের বেইজিং শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত চীনের সম্রাটদের প্রাসাদ ‘ফরবিডেন সিটি’ ও বেইজিংয়ের হাইতিয়েন ডিস্ট্রিক্টে অবস্থিত সম্রাটদের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপন প্রাসাদ ‘সামার প্যালেস’-এ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। চীনের শেষ সম্রাট পু ঈ-এর জীবনকাহিনি নিয়ে ইতালিয়ান পরিচালক বারনার্ডো বারতোলুচি ‘দ্য লাস্ট এম্পেরর’ নামে একটি এপিকধর্মী সিনেমা তৈরি করেন। কাকতালীয়ভাবে সিনেমাটি আমরা যে বছর বেইজিংয়ে আসি সেই বছরের নভেম্বর মাসে টোকিও ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রথম প্রদর্শিত হয়। এই সিনেমার সুটিং প্রায় পুরোটাই বেইজিংয়ের ‘ফরবিডেন সিটি’-তে হয়েছে।
বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউট থেকে আমাদের বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও নিয়ে যাওয়া হতো। সেই সুবাদে সৌভাগ্য হয়েছিল ‘চায়না ন্যাশনাল অপেরা হাউস’-এ চীনের বিখ্যাত ‘সেন্ট্রাল ব্যালে ট্রুপ’-এর পারফর্ম করা ‘সোয়ান লেক’ ব্যালে দেখার। বেইজিংয়ের বিখ্যাত ‘পিকিং অপেরা’ যাকে চায়নিজে ‘চিং-চু’ বলা হয়, সেটারও পারফরম্যান্স দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল। ‘চিং-চু’-এর বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে একই সঙ্গে দ্রুত ও উচ্চ লয়ের ইনস্ট্রুমেন্টাল মিউজিক, হাই পিচের ভয়েস পারফরম্যান্স, মাইম, মার্শাল আর্টস, নাচ এবং অ্যাক্রোবেটিকস—এই ছয় রকমের শিল্পকলার সমন্বয় ঘটানো হয়। তা ছাড়া পারফরমারদের মুখ বিভিন্ন রকম উজ্জ্বল রং দিয়ে পেইন্ট করা হয়। ফলে পারফর্মের সময় দর্শকেরা তাদের আসল চেহারা কখনোই দেখতে পায় না। আমাদেরকে একবার এক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নানা ধরনের পারফরম্যান্সের সঙ্গে ছিল একটি ম্যাজিকের আইটেম। ম্যাজিশিয়ান ভদ্রলোক ম্যাজিক দেখানোর এক পর্যায়ে একটি মাছ ধরার বড়শি নিয়ে দর্শকের সারিতে নেমে আসেন। তিনি আমার পাশে বসা আমার রুমমেট আজমীর দিকে বড়শির রশিটি ছুড়ে মারেন। আজমী সেই রশিটি ধরে ফেলে। কিন্তু পরক্ষণেই টের পায় তার হাতের পেছনে রশিটির ডগায় লাল রঙের বেশ বড়সড় একটি মাছ ছটফট করছে। ভয় পেয়ে সে রশিটি ছেড়ে দেয়। দর্শকেরা তখন দেখতে পায় শূন্য থেকে বড়শির মাথায় একটি মাছ চলে এসেছে। মুহূর্তেই করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে অডিটরিয়াম। সেই ম্যাজিক্যাল মুহূর্তটি এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে আমার স্মৃতির পাতায়।
একসময় আমাদের চায়নিজ ভাষাশিক্ষার ক্লাস শুরু হয়, যার জন্য আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটে এই ভাষাশিক্ষার ক্লাসগুলো আবার বিভিন্ন কারিকুলাম অনুসারে ডিজাইন করা। যেমন আমরা যারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছি আমাদের জন্য একধরনের কারিকুলাম, আবার যারা মেডিকেল অথবা ফাইন আর্টস পড়তে এসেছে তাদের জন্য তাদের সাবজেক্ট অনুযায়ী আরেক ধরনের কারিকুলাম। বাংলাদেশ থেকে আমরা মোট দশজন এসেছি চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে। তার ভেতর আমিসহ আরও ছয়জন অর্থাৎ আমরা মোট সাতজন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভিন্ন শাখার ছাত্র। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কারিকুলামের একটি ক্লাসে দেওয়া হলো। আমাদের সঙ্গে দুজন পড়তে এসেছে ফাইন আর্টস, তাদের দেওয়া হলো অন্যান্য ফাইন আর্টসের ছাত্রদের সঙ্গে। একজন এসেছে মেডিকেল পড়তে, তার জন্য নির্ধারিত হলো মেডিকেল স্ট্রিমের ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাস। আমাদের বলা হলো যে প্রথম সেমিস্টারে যদিও সাধারণ দৈনন্দিন জীবনে চলতে ফিরতে যে ধরনের চায়নিজ ভাষার দরকার সেটা শেখানো হবে, তবে দ্বিতীয় সেমিস্টারে জোর দেওয়া হবে ‘ট্রু আন ইয়ে ছ’ বা ‘সাবজেক্ট ম্যাটারের শব্দকোষ’-এর ওপর। ক্লাস হবে প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত। মোট চার পিরিয়ড। প্রতি পিরিয়ডের দৈর্ঘ্য হচ্ছে পঞ্চাশ মিনিট। দুই পিরিয়ডের মাঝে দশ মিনিটের বিরতি। তবে প্রথম দুই পিরিয়ডের পর বিশ মিনিটের একটি বড় বিরতি। এই বিরতির সময় একাডেমিক বিল্ডিংয়ের নিচে কয়েকটি ফুড কার্ট বিভিন্ন ধরনের স্ন্যাকস নিয়ে বসে। অনেকেই সেখানে ভিড় করে, বিশেষ করে যারা সকালে নাশতা করার সময় করে উঠতে পারেনি।
প্রথম দিন সকাল আটটায় আমাদের জন্য নির্ধারিত ক্লাসরুমে গিয়ে দেখি আমাদের ক্লাস টিচার ইতিমধ্যে ক্লাসে চলে এসেছেন। তিনি তাঁর পরিচয় দিলেন ‘ঠ্রেং লাও-শ্রি’ বা ‘টিচার ঠ্রেং’ হিসেবে। মধ্যবয়সী টিচার ঠ্রেং আমাদের বাংলাদেশি পরিচয় পেয়ে বললেন যে দুই বছর আগে তিনি বাংলাদেশের ছাত্রদের পড়িয়েছিলেন। তাঁর পূর্ববর্তী বাংলাদেশি ছাত্রদের চীনা ভাষা শেখার দক্ষতার প্রশংসাও করলেন তিনি। আমাদের ক্লাসে আমরা সাতজন বাংলাদেশি ছাত্র ছাড়াও রয়েছে ছয়জন কেনিয়ার ছাত্র, যারা আমাদের মতোই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভিন্ন শাখায় আন্ডারগ্রেড করতে এসেছে। ঠ্রেং লাও-শ্রি আমাদের সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট এমনভাবে করে দিলেন যে একজন বাংলাদেশির পাশে একজন কেনিয়ার স্টুডেন্ট। উদ্দেশ্য হলো ক্লাসে যেন আমরা কেউই আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে না পারি। আমার পাশে কেনিয়ার যে ছেলেটির সিট নির্ধারিত হলো তার নাম হচ্ছে ‘অভেলি’। অন্যদের চেয়ে কিছুটা ছোটখাট গড়নের অভেলি ছিল বেশ সপ্রতিভ এবং আমার সঙ্গে তার বেশ সখ্য গড়ে ওঠে। ভাষাশিক্ষা কোর্সের শেষে গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনির সময় ঠ্রেং লাও-শ্রি আমাদের দিয়ে একটি নাটিকা মঞ্চস্থ করেন, যেখানে অভিলি, আমার রুমমেট আজমী ও আমি এই তিনজন অভিনয় করি। আমাদের দেশের মতো কেনিয়াও একসময় ব্রিটেনের কলোনি ছিল। তারাও আমাদের মতো নিজেদের মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাকে অন্যতম ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে। ফলে ক্লাসে আমাদের সহপাঠী কেনিয়ার ছাত্রদের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা চালাতে কোনো বেগ পেতে হতো না। তবে কালক্রমে আমাদের কথাবার্তার মাধ্যম ইংরেজির পরিবর্তে ধীরে ধীরে চায়নিজে রূপান্তরিত হয়ে যায় অনেকটা আমাদেরই অগোচরে।
ঠ্রেং লাও-শ্রি আমাদের প্রথম দুটি পিরিয়ড নেন। তারপর সকাল দশটার বিরতির পর ক্লাসে আসেন একজন নারী শিক্ষক, যিনি আমাদের তাঁকে ‘ট্রোং লাও-শ্রি’ বলে সম্বোধন করতে বলেন। কেমিস্ট্রিতে সদ্য গ্র্যাজুয়েট টিচার ট্রোং আমাদের কীভাবে চায়নিজ ক্যারেকটার লিখতে হয়, সেটা শেখাবেন। চায়নিজ লেখার জন্য কোনো বর্ণমালা নেই। ছবি থেকে একেকটা শব্দের লিখিত রূপ এসেছে, যাকে ইংরেজিতে ক্যারেকটার বলে। এই প্রকার লিখিত রূপকে বলা হয়ে থাকে ‘হায়ারোগ্লিফিক্স’। প্রাচীনকালে কোরিয়ান এবং জাপানি ভাষাতে চায়নিজ লিপিই ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে কোরিয়ান ও জাপানি ভাষাতে বর্ণমালার প্রবর্তন হয়েছে। কিন্তু মূল চায়নিজ ভাষায় এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার বর্ণমালার প্রবর্তন করা হয়নি। ভবিষ্যতে যে করা হবে সেই লক্ষণও আমার চোখে ধরা পড়েনি। তবে মেইনল্যান্ড চায়নাতে প্রাচীন পদ্ধতির জটিল লিখিত রূপ বা ক্যারেকটারকে পরিবর্তন করে সরলীকরণ বা সিমপ্লিফায়েড করা হয়েছে। হংকং ও তাইওয়ানে এখনো প্রাচীন পদ্ধতির লিখিত রূপ প্রচলিত আছে। আমাদেরকে অবশ্য সিমপ্লিফায়েড ক্যারেকটার শেখানো হয়েছিল। চায়নিজ ভাষার ব্যাকরণ কঠিন না, কঠিন হচ্ছে উচ্চারণ। কারণ, কথা বলার সময় এই ভাষাতে চারটি ‘টোন’ বা ‘মাত্রা’ ব্যবহার করা হয়। চার মাত্রার উচ্চারণকে বাগে আনা কিন্তু কোনো সহজ ব্যাপার নয়। উচ্চারণের এই মাত্রা সঠিক না হলে শব্দের অর্থ পাল্টে যায়। যেমন, চায়নিজ শব্দ ‘মা’ উচ্চারণের মাত্রা ভেদে ‘মাদার বা মা’ কিংবা ‘হর্স বা ঘোড়া’ অর্থ হতে পারে। তবে উচ্চারণ কিংবা লেখার চেয়েও চ্যালেঞ্জিং হচ্ছে চায়নিজ ভাষার শব্দভান্ডারকে আয়ত্তে আনা। কারণ, এর বিশালত্ব। চীনের বিখ্যাত ক্লাসিক্যাল উপন্যাস ‘হোং লৌ মং’ বা ‘আ ড্রিম অব রেড ম্যানশনস’-এ নাকি সত্তর হাজার চায়নিজ শব্দের সন্ধান পাওয়া গেছে, যাদের স্বতন্ত্র অর্থ রয়েছে। এখান থেকে চায়নিজ ভাষার শব্দভান্ডার যে কত বিশাল, তার একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। যেখানে খোদ চায়নিজদের পক্ষেই এই বিপুল পরিমাণ শব্দভান্ডারকে আয়ত্তে আনা সম্ভব নয়, সেখানে বিদেশিদের পক্ষে তো আরও নয়। তবে বলা হয়ে থাকে যে পাঁচ থেকে সাত হাজার ‘ক্যারেকটার’ জানলেই নাকি স্বচ্ছন্দে খবরের কাগজ পড়াসহ চায়নিজ সমাজে মিশে যাওয়া যায়, যাকে চায়নিজে ‘ট্রোং কোয়া থোং’ বলা হয়ে থাকে।
আমরা প্রতিদিনই আমাদের ভাষা শিক্ষার ক্লাস থেকে নতুন নতুন চায়নিজ শব্দ শেখা শুরু করলাম। সেই শব্দগুলো দিয়ে বিভিন্ন ধরনের বাক্য গঠনের জন্য আমাদের বেসিক ব্যাকরণও শেখানো হতো। ফলে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত চায়নিজ ভাষা ধীরে ধীরে আমাদের আয়ত্তে আসা শুরু হলো। দুপুর ১২টায় ক্লাস শেষ হলে আমাদের প্রথমেই ছুটতে হতো লাঞ্চের জন্য ডাইনিং হলে। লাঞ্চের পর আমাদের হাতে থাকত অখণ্ড অবসর। দুপুর বেলায় আমি অন্যান্য চায়নিজ ছাত্রছাত্রীদের দেখাদেখি লাইব্রেরিতে যাওয়া শুরু করলাম। সেখানে নিরিবিলি বসে প্রথমেই ক্লাসের অ্যাসাইনমেন্টগুলো শেষ করতাম। তারপর হোস্টেলে ফিরে এসে তৈরি হতাম ভলিবল কিংবা বাস্কেটবল খেলার জন্য। কোনো কোনো দিন খেলা বাদ দিয়ে কয়েকজন মিলে বের হতাম ক্যাম্পাসের বাইরে রাস্তা ধরে হাঁটতে। বড় রাস্তার পাশে বেশ কিছু সরকারি দোকান ছিল, যেখানে ফলমূল, সবজি ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী পাওয়া যেত। আরেক পাশের রাস্তার দু’ধারে ছিল অনেকটা কাঁচা বাজারের স্টাইলে ছাপরা দেওয়া সারি সারি দোকান, যেখানে মূলত রেডিমেড কাপড়চোপড় পাওয়া যেত। ব্যক্তিমালিকানার এই দোকানগুলোয় আমাদের দেশের মতো দামাদামি চলত। আমি আমার সদ্য লব্ধ চায়নিজ ভাষা জ্ঞান খাটিয়ে সেইসব দোকানদারের সঙ্গে দামাদামি করে কখনো জিনসের প্যান্ট, কখনো হাল ফ্যাশনের শার্ট কিনে ফেলতাম। তারাও বিদেশির মুখে ভাঙা ভাঙা চায়নিজ শুনে কিছুটা চমৎকৃত ও কিছুটা আমোদিত হতো। এভাবেই আমি আমার চায়নিজ ভাষাজ্ঞানকে ধীরে ধীরে উন্নত করে নিচ্ছিলাম এবং সেই সঙ্গে সাধারণ চায়নিজদের সঙ্গে মিশে তাদের কালচারকেও বুঝতে শুরু করলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল ধীরে ধীরে একদিন ‘ট্রোং কোয়া থোং’ হয়ে ওঠা। চলবে...
*আগামীকাল পড়ুন: বেইজিংয়ের সেই দিনগুলো: পর্ব-৬
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]