১.
রাস্তাটা পার হতে গিয়ে ‘চক্ষু চড়কগাছ’ বলতে যা বোঝায়, এমন অবস্থা হয়ে গেল আমার। ঢাকার ফার্মগেটে এসে পড়লাম নাকি! অস্ফুটে বলেই ফেলি। জায়গাটা একটা চৌরাস্তা। বেশ কয়েকটা বাস একেবারে গা ঘেঁষে ঘেঁষে যাচ্ছে। চারদিক থেকেই প্রাইভেট কার তাদের রাস্তা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আর আছে পথচারীদের পারাপার, কোলাহল।
—আসেন মামা, আসেন।—গোলাপের ডাকে যেন সংবিৎ ফিরে আসে। গোলাম মোস্তফা গোলাপ আমাদের গাইড, আমরা যাচ্ছি স্ট্যাচু অব লিবার্টিতে। গোলাপ আগেই মেসেজ দিয়ে রেখেছিল—সকালে এসে সে আমাদের তুলে নেবে। কথামতো যথাসময়েই হাজির। 150th স্ট্রিট থেকে 88th অ্যাভিনিউতে তাঁর বাসার কাছাকাছি অন্য একটি অ্যাপার্টমেন্টে গাড়ি রেখে আমরা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ধরে যাব স্ট্যাচু অব লিবার্টি।
পার্কিং করতে বিল্ডিংটায় ঢুকতে ঢুকতে গোলাপ তাঁর নিজের বাসাটা দেখাল। যেই অ্যাপার্টমেন্টে গোলাপ থাকে, সেখানে গাড়ি না রেখে অন্য অ্যাপার্টমেন্টে গাড়ি রাখতে হচ্ছে কেন?—প্রশ্নটা মাথায় আসে। কিন্তু গোলাপ নিজেই ব্যাখ্যাটা দিয়ে ফেলে।
ব্যাখ্যা নয়, সেটা আসলে একটা গল্প। এবং সেই গল্পটাও চমৎকার। গোলাপদের অ্যাপার্টমেন্টে পার্কিং আছে কয়েকটি মাত্র। বিল্ডিংয়ে যতগুলো ইউনিট আছে তার এক তৃতীয়াংশও নয়। কেবল এই অ্যাপার্টমেন্টই নয়, অধিকাংশ অ্যাপার্টমেন্ট এমনকি হাউসেও নাকি পর্যাপ্ত নিজস্ব পার্কিং নেই। সবাই গাড়ি রাখে বাড়ি–সংলগ্ন রাস্তায়। সেটাও খালি থাকা সাপেক্ষে। আপনি গাড়ি রেখেছিলেন, কোনো কারণেই জায়গাটা ছেড়ে দিলেন, আর কেউ এসে সেখানে গাড়ি রেখে দিলে আপনার আর কিছু বলার নেই।
গোলাপ যখন গাড়ি কেনে তখন তার অ্যাপার্টমেন্টের সব পার্কিং বুকড হয়ে গেছে। গাড়ি নিয়ে এসে কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেও পার্কিংয়ের জায়গা না পেয়ে গাড়ি নিয়ে যখন চরম হতাশ, ঠিক সেই সময়ই অন্য একজন ফোনে পাশের অ্যাপার্টমেন্টে একটি পার্কিং স্পট খালি থাকার কথা জানায়। গোলাপও যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে পয়সা দিয়ে পার্কিং স্পট ভাড়া নিয়েছে গোলাপ। এখন এই বিল্ডিংয়ে গাড়ি রেখে নিজের বাসায় যায়, আবার হেঁটে এই বিল্ডিংয়ে এসে এখান থেকে গাড়ি নিয়ে অফিস বা অন্য যেখানে যাওয়ার সেখানে যায়। জানা গেল জ্যামাইকাই কেবল নয়—নিউইয়র্কের অনেক এলাকায় বাসিন্দাদের গাড়ি পার্কিং নিয়ে এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বা ফ্রিডম টাওয়ারই কেবল নয়, আরও অনেক মিউজিয়াম আছে আশেপাশে। যুক্তরাষ্ট্রের আদি ইতিহাস নিয়েও একটি মিউজিয়ামের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। পর্যটকেরা এখান থেকে বিকেল সন্ধ্যায় হাডসন নদীর দৃশ্য দেখেন, অনেকেই বোটে চড়ে হাডসন নদীতে ঘুরতে ঘুরতে নদী আর ব্যস্ততম ম্যানহাটান শহরটাকে দেখেন।
সাটপিন ব্লুভার্ড থেকে সাবওয়ে ধরব আমরা। সাবওয়ে স্টেশনে যেতে যেতেই এই জায়গাটায় এসে পৌঁছালাম—যেটিকে আমার ফার্মগেটের মোড় বলে মনে হয়েছে। অবশ্য তার কারণও আছে। সাটপিন ব্লুভার্ডটাকে ট্রান্সপোর্টেশন হাব হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। জেএফকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সরাসরি যাওয়ার এয়ার ট্রেনটাও অনেকেই এখান থেকেই ধরেন। ফলে এই স্টেশন যেমন ব্যস্ত থাকে, তেমনি ব্যস্ত থাকে সংলগ্ন এলাকাটাও।
গোলাপের ডাকে তাড়াতাড়ি রাস্তা পেরুতে হয়। সাটপিন ব্লুভার্ড থেকেই ট্রেন ধরব আমরা। যাব সোজা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার—এই রুটের একেবারে শেষ স্টেশন। সেখান থেকে খানিকটা হেঁটে ব্যাটারি পার্ক, তারপর ফেরি ধরে স্ট্যাচু অব লিবার্টি, আমাদের নিউইয়র্কের প্রথম অ্যাডভেঞ্চার স্পট।
২.
ট্রেন থেকে নেমে রাস্তায় উঠতেই চোখ আটকে যায় সাদা একটি ভবনে, ইটের দালান নয়, স্টিলের তৈরি, দেখে মনে হয় ঠিক যেন পাখির দুটি ডানা আকাশে উড়ে যেতে চাইছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ঘিরে নিউইয়র্কের অন্যতম আইকনিক ভবনটি তৈরি হয়েছে—যার নাম ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার অকোলাস’। আপনাদের নিশ্চয়ই নাইন ইলেভেনের কথা মনে আছে? সেই যে ইতিহাসের বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলা, যার জের ধরে বিশ্বরাজনীতির খোলনলচেই পাল্টে গেল। এখন অবশ্য এখানে নতুন মেমোরিয়াল হয়েছে, হয়েছে ফ্রিডম টাওয়ার। এই অকোলাসটাও নাইন ইলেভেনের পর তৈরি।
গোলাপ জানায়, ফিরতি পথে এই জায়গা ঘুরে যাব মামা। এখন চলেন, ফেরি ধরতে হবে।
হ্যাঁ, আমাদের লক্ষ্য যেহেতু স্ট্যাচু অব লিবার্টি, পথে দেরি করা ঠিক হবে না। আবার নাইন ইলেভেনের স্মৃতিবিজড়িত এই জায়গাটা ছুঁয়ে না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে যাওয়াটাও ঠিক হবে না। ফিরতি পথে ৯/১১–এর ইতিহাসের পৃষ্ঠায় সাঁতার কাটার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা ফেরিঘাটের দিকে হাঁটতে থাকি।
ঐতিহাসিক ম্যানহাটানের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে হাডসন নদীর তীর ঘেঁষে ব্যাটারি পার্কের অবস্থান। নামের সঙ্গে পার্ক যুক্ত থাকলে ও ২০১৫ সাল থেকে কর্তৃপক্ষ এর নামকরণ করেছে ব্যাটারি। ব্যাটারি কিংবা ব্যাটারি পার্ক যাই বলি না কেন—এর আছে চমৎকার এক ইতিহাস। মূলত, নিউইয়র্কের ইতিহাসের সূতিকারও এই ব্যাটারি পার্ক। নিউইয়র্ক শহরের জন্মই হয়েছে এই ব্যাটারি পার্কে। সেই হিসেবে জায়গাটাকে নিউইয়র্কের জন্মস্থান হিসেবেও অভিহিত করা যায়।
সেটা ১৬২৫ সালের দিকের কথা। ন্যাটিভ আমেরিকান আর ডাচ সেটেলাররা এই জায়গাটার কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনা করে এখানে প্রথম বসতি গাড়েন। নদী থেকে রক্ষা পেতে তৈরি করেন দুর্গ। তারপর সময়ের ব্যবধানে এই জায়গার উন্নয়ন হয়েছে, সম্প্রসারণ হয়েছে। নানা রকমের মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। গড়ে উঠেছে নিউইয়র্ক শহর। একেবারে নদী লাগোয়া বলেই ব্যবসা–বাণিজ্যের বিবেচনায় তারা এই জায়গাটা বেছে নিয়েছিলেন। এখনো এটি পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। অনেকেই বলে থাকেন নিউইয়র্ক ভ্রমণের যাত্রাটা নাকি এখান থেকেই শুরু করতে হয়।
তো, এর নাম ব্যাটারি পার্ক হলো কেন?—এই প্রশ্নটা অনেকের মনেই জাগে। তথ্য বলছে, এখানে অবস্থিত আর্টিলারি ক্যাম্প থেকেই এর নাম হয়েছে ব্যাটারি পার্ক।
ফেরিঘাটের ডকে যেতে যেতে চারপাশ ঘুরে দেখি। পার্কটায় সংস্কারকাজ চলছে বলে বেশ কিছু রাস্তা বন্ধ। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বা ফ্রিডম টাওয়ারই কেবল নয়, আরও অনেক মিউজিয়াম আছে আশেপাশে। যুক্তরাষ্ট্রের আদি ইতিহাস নিয়েও একটি মিউজিয়ামের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। পর্যটকেরা এখান থেকে বিকেল সন্ধ্যায় হাডসন নদীর দৃশ্য দেখেন, অনেকেই বোটে চড়ে হাডসন নদীতে ঘুরতে ঘুরতে নদী আর ব্যস্ততম ম্যানহাটান শহরটাকে দেখেন। স্ট্যাচু অব লিবার্টি, এলিস আইল্যান্ড, স্টাটেন আইল্যান্ড যাওয়ার ফেরিও এখান থেকেই ধরতে হয়। ফলে জায়গাটায় হাজারো মানুষের আনাগোনা হয়। স্টাটেন আইল্যান্ডের ফেরিটা আবার ফ্রি। ফলে বিনা টিকিটে জাহাজে চড়ে স্টাটেন আইল্যান্ড পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে আসা আর এই ফাঁকে শহর নিউইয়র্ক বিশেষ করে ম্যানহাটানের সুরম্য অট্টালিকার দৃশ্য দেখা যায়, জাহাজ থেকে স্ট্যাচু অব লিবার্টিটাও খানিকটা দূর থেকে দেখে নেওয়া যায়। স্ট্যাচু অব লিবার্টি যেতে অবশ্য জাহাজের টিকিট কাটতে হয়। সেটি এখন মাথাপিছু পঁচিশ ডলারের বেশি ট্যাক্স হয়ে গেছে।
ফেরিতে ওঠার লাইনে দাঁড়ানোর ঠিক আগে আগেই আবার ক্যাসল ক্লিনটন। কালো কালো বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য থেকে প্রথমটায় মনে হয়েছিল—উত্তর আমেরিকার অনেক পার্কেই শহরের বিশেষ ব্যক্তিদের ভাস্কর্য বসানো থাকে। এগুলোও হয়তো তেমন কিছুই। কিন্তু কাছে গিয়ে জানা গেল—আরেক ইতিহাস।
আগেই উল্লেখ করেছি—ব্যাটারি পার্ক হচ্ছে নিউইয়র্ক শহরের জন্মস্থান, আর ব্যাটারি পার্কের এই জায়গাটা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী ইতিহাসের সূচনাস্থান, যেখানে প্রথম ইমিগ্রেশন সেন্টার স্থাপিত হয়েছিল। নদীপথে আসা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হতো এলিস আইল্যান্ডে, সেখানে চিকিৎসা দেওয়ার পর শহরে পাঠানো হতো। শহরের প্রথম তাদের আনা হতো এই ক্লিনটন ক্যাসলে।
স্ট্যাচু অব লিবার্টি থেকে এলিস আইল্যান্ডে আমাদের যাওয়ার কথা রয়েছে। তখন সেটা নিয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রইল। আপাতত এই ক্যাসল ক্লিনটনের কথাই বলি। ১৮০৮ সালের দিকে স্থাপিত হয়েছিল এই ক্যাসল ক্লিনটন। এরপর বিভিন্ন সময় নাম এর নামের পরিবর্তন হয়েছে, নানা রকম সংস্কার হযেছে, শেষমেশ আবার ক্যাসল ক্লিনটন নামেই থিতু হয়েছে।
তথ্য–উপাত্ত বলে, ১৮৫৫ থেকে ১৮৯০—এই সময়টায় প্রায় সাড়ে সাত মিলিয়ন অভিবাসী এই স্থান দিয়ে নিউইয়র্কে প্রবেশ করে। ইতিহাস আর নামে যতই বাহার থাকুক, বাইর থেকে দেখে ক্যাসল ক্লিনটনের মাহাত্ম্য আন্দাজ করা যায় না। অনেকটা পরিত্যক্ত ভবনের মতোই একটি বিল্ডিং। আর সেই বিল্ডিংটা ঘিরে আছে বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য, যার প্রতিটির সঙ্গে আছে একেকটি ইতিহাস।
৩.
ফেরিতে ওঠার লাইনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়ে গোলাপ চলে যায় টিকিট কাটতে। আমি আর সেরীন লাইনে দাঁড়িয়ে। আমরা যে জায়গাটায় দাঁড়িয়েছি সেখান থেকে সামনে লাইনটা বেশ দীর্ঘ। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেছনের দিকে আরও বাড়তে থাকে।
—আমরা এই ফেরিটা ধরতে পারব তো?—অস্ফুটে বলি আমি।
—সমস্যা নেই, পরেরটায় যাব।—সেরীন জবাব দেয়।
ডকের মাথা থেকে পেঁচিয়ে লাইনটা অনেক দূর চলে গেছে। একটা ফেরিতে এতগুলো মানুষ যেতে পারবে কি না, তা নিয়ে আমার সংশয় হয়। এত মানুষ স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে যায়!
হ্যাঁ যায়। প্রতিদিন নাকি গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার দর্শনার্থী স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে যায়। সামারে এই সংখ্যাটা আরও বেড়ে যায়। এমনকি শীতকালেও এমন দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীরা লিবার্টি আইল্যান্ডের পেরি ধরে বলে জানা যায়। আর এটা তো অক্টোবর। অক্টোবরের শেষ সময়টায় না শীত-না গরম—এমন একটা আরামদায়ক আবহাওয়ায় দর্শনার্থীর সংখ্যা তো আরও বেশি হবেই। ‘স্ট্যাচু সিটি ক্রুজ’ নামের যে কোম্পানিটি স্ট্যাচু অব লিবার্টিতে দর্শনার্থী আনা–নেওয়ার ফেরি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে, তাদের প্রতিটি পেরিতে ৮৭০ জনের মতো যাত্রী ধরে বলে জানা যায়।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ফেরিতে ওঠার আগে দর্শনার্থীদের দীর্ঘ লাইন হয়ে যাওয়ার আরও একটি কারণ আছে। ফেরিতে ওঠার আগে প্রত্যেক দর্শনার্থীকেই ‘এয়ারপোর্ট স্টাইলে’ সিকিউরিটি চেকের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। অর্থাৎ প্রতিজন দর্শনার্থীর পুরো শরীর, সঙ্গের ব্যাগ তল্লাশি করা হয়। কোমরের বেল্ট, পায়ের জুতা খুলে ওদের স্ক্যানিং মেশিনের ভেতর দিয়ে পার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরগুলোয় যে ইনটেনসিভ নিরাপত্তা তল্লাশি চালানো হয়, তার সবই এখানে অনুসরণ করা হয়। জানা যায়, এই অবস্থাটা শুরু হয়েছে ৯/১১–এর সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে। ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে যে বিমান হামলা হয়েছিল, সেই স্থানটি একেবারেই ফেরিঘাটের লাগোয়া। তা ছাড়া স্ট্যাচু অব লিবার্টির নিরাপত্তার জন্যও বাড়তি সতর্কতা হিসেবে এই নিরাপত্তা তল্লাশির প্রবর্তন করা হয়েছে। বহুল আলোচিত ‘এয়ারপোর্ট স্টাইল সিকিউরিটি চেক’ সেরে আমরা ফেরিতে গিয়ে উঠি।
সেরীন আর আমি দুজনেই ঠিক করে ফেলেছিলাম—ফেরিটার ছাদে মানে ওপরের তলায় গিয়ে উঠব। গোলাপও একই পরামর্শ দিল। আমরা ভিড় ঠেলে সোজা দুতলা ফেরিটার ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে সেখানকার বসার জায়গাগুলো পূর্ণ হয়ে গেছে। তাতে সমস্যা নেই। আমরা একপাশে দাঁড়িয়ে যাই।
ফেরির ছাদে দাঁড়ানো মানে যেন অপরূপ এক পৃথিবীর মুখোমুখি হওয়া। অক্টোবরের রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ, একেবারে মেঘহীন—যেন ভিন্ন কোনো নীল রঙে সেজে আছে। হাডসন নদীর বুকে চিরে ফেরিটা এগিয়ে যাচ্ছে লিবার্টি আইল্যান্ডের দিকে। আর ফেরিটা চলার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে একপাশে পড়ে ম্যানহাটানের আকাশছোঁয়া অট্টালিকাগুলো। সেই অট্টালিকা ভেদ করে নিউইয়র্কের ঝকঝকে আকাশটা। দূরে অন্য একটা শহর—নিউ জার্সি কিংবা স্টাটেন আইল্যান্ড। পাশ দিয়ে আরেকটা ফেরি শব্দ করে ছুটে চলে যায়—লিবার্টি আইল্যান্ড থেকে দর্শনার্থীদের নিয়ে ফিরেছে। আমরা একবার ডানে, একবার বায়ে, আরেকবার সামনে তাকিয়ে আকাশ, নদী, দূরের শহর আর ম্যানহাটানের অপরূপ স্কাইলানটা দেখতে থাকি। হাডসন নদীর জলরাশির মাঝখানে স্ট্যাচু অব লিবার্টিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে জলের ভেতর থেকে ভালোবাসার কোনো দেবী যেন হঠাৎ মাথা বের করে উঠে দাঁড়িয়েছে আর মুচকি হাসিতে ইশারায় কাছে ডাকছে।
সেই মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমিও অস্ফুটে বলে উঠি, আসছি হে মুক্তির দেবী, তোমার কাছেই আসছি। চলবে...