ইয়েল ইউনিভার্সিটি আর ক্যাম্পাসের ‘সিক্রেট বিল্ডিং’–এর গল্প  

সিক্রেট সোসাইটি ভবনের সামনে সেরীন-সাজুছবি: লেখকের পাঠানো

১.

‘আমরা কি কোনো প্রাচীন স্থাপত্যকলার নিদর্শনের প্রদর্শনীতে চলে এলাম!’ -ইয়েল ক্যাম্পাসে ঢুকেই প্রথমে এই ভাবনাটা মনে এল। আমাদের গাইড রিফাত তরফদার বিভিন্ন ভবনের ভেতর দিয়ে এদিক–সেদিক নিয়ে যাচ্ছে, তার সাথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বিল্ডিংগুলোর ভেতর দেখছি, বাইরে দেখছি। ভেতরে-বাইরে যেন নান্দনিকতার প্রতিযোগিতা চলছে।

টরন্টোর বে-স্ট্রিটের ফাইন্যান্সিয়াল এনালিস্ট শেখ সালাহ উদ্দিন যখন বলছিল-কানেটিকাটে গেলে ইয়েল ইউনিভার্সিটি না দেখে আসবেন না। তখন মনে হয়েছিল, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে দেখার কী আছে। আর এখন ক্যাম্পাসে ঢুকে মনে হলো, ইয়েল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে যেভাবে সময়কে দৃশ্যমান করে ধরে রেখেছে, এটা নিজ চোখে না দেখলে ভাবাই যেত না।

ইয়েল ইউনিভার্সিটি। পৃথিবীর খ্যাতিমান একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম। হার্ভাডের সঙ্গে সারা বছর কম্পিটিশনে লেগে থাকে বলেই নয়, ভর্তির বাছাইপ্রক্রিয়ায় রক্ষণশীলতা, উচ্চশিক্ষার মান—সব মিলিয়ে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে ইয়েল ইউনিভার্সিটি। আমেরিকার অন্তত পাঁচজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়েল–এর গ্র্যাজুয়েট। তার মধ্যে দুই জর্জ বুশ, বিল ক্লিনটন। হিলারি ক্লিনটনও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, সেটি তো আমাদের ভালোই জানা। বিশেষ করে ক্লিনটন-হিলারির সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল ইয়েলের ক্যাম্পাসেই।

আরও পড়ুন

ইয়েলে আমাদের গাইড রিফাত, রিফাত তরফদার। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র রিফাত অবশ্য ইয়েলে আইন নিয়ে আবারও পড়তে চায়। ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টে ইন্টার্নি করতে গিয়ে তার মার্কিন প্রশাসনের ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নয়, ভবিষ্যতে আমেরিকান রাজনীতিতে ক্যারিয়ার গড়তে চান রিফাত, সেই লক্ষ্য থেকেই আইনে পড়াশোনার সিদ্ধান্ত তার। রিফাতের কাছেই জানা গেল-এই ইউনিভার্সিটিতে অন্তত শতাধিক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আছেন। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান যেমন আছেন, তেমনি সরাসরি বাংলাদেশ থেকে পড়তে আসা ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থীরাও আছেন। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের একটি সমিতিও আছে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে।

-বাংলাদেশি শিক্ষক নেই ইয়েলে? প্রশ্ন করতেই রিফাতের জবাব, আছে। পবিত্র রমজানে কোনো কোনো শিক্ষক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ইফতারের দাওয়াত দেন-সেই তথ্যও জানিয়ে দেন রিফাত।

রিফাতের সঙ্গে আমাদের এই প্রথম সাক্ষাৎ। নতুন প্রজন্মের চটপটে তরুণ, আমাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলার সে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা তার। তাঁর বাবা আশফাকুল তরফদার স্বপন ভাইদের পারিবারিক বন্ধু। কানেটিকাটে এসে প্রথম রাতেই স্বপন ভাইয়ের বাসায় পরিচয় হয়েছে তাঁর সঙ্গে। চমৎকার বন্ধুবৎসল মানুষ। কানেটিকাটের বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন দুই মেয়াদে। ইয়েল দেখতে চাই শুনেই তিনি ছেলেকে বলে রেখেছিলেন-আঙ্কেলদের তোমার ক্যাম্পাসটা ভালোভাবে দেখিয়ে দিয়ো। রিফাতও বিপুল উৎসাহে আমাদের নিয়ে ইয়েল ক্যাম্পাসের অলিগলি ঘুরতে লাগল। রিফাত একদিকে যেমন বিভিন্ন ভবনের তথ্যউপাত্ত ইতিহাস তুলে ধরছিল, আবাসিক ছাত্র হিসেবে বিভিন্ন ভবনের এক্সেস কোড থাকায় আমাদের ভবনগুলোর ভেতরে ঢুকে পড়াটাও সহজ হচ্ছিল।  

কেউ কখনো কাউকে এখানে আসতে দেখেনি। কিন্তু সবাই জানে, এই বিল্ডিংয়ে বসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, সাবেক প্রেসিডেন্ট কিংবা বিশেষ ব্যক্তিরা গোপন মিটিং করেন।
আরও পড়ুন

২.

নিউ হেভেন সিটিতে ১১০৮ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে ইয়েল ইউনিভার্সিটি। তবে নিউ হেভেনের মূল ক্যাম্পাসটি ২৬১ একর। সম্পূর্ণ আবাসিক এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আমেরিকার তৃতীয় প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। ১৭১৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সেটি আমেরিকার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, আর এখন তো সারা দুনিয়ার প্রেস্টিজিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়।

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

শুরুতে এর নাম ছিল কলেজিয়েট স্কুল। পরে ব্রিটিশ-আমেরিকান ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এলিহো ইয়েলের নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হয়ে যায় ইয়েল ইউনিভার্সিটি। চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, এলিহো ইয়েল ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সেই কোম্পানি থেকেই তিনি নিজের ভাগ্যকে গড়ে তুলেছিলেন। ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাস তো আমরা সবাই জানিই।

ইয়েল ইউনিভার্সিটিকে তিনি কত টাকা ডোনেশন দিয়েছিলেন? অনেক টাকা? আমার বাংলাদেশি মনে এই প্রশ্নটা জেগে ওঠে।

তথ্য ঘেঁটে দেখা গেল, সেটি চমকে ওঠার মতো কিছু নয়। সেই সময়টায় অবশ্য কলেজিয়েট স্কুল বেশ আর্থিক কষ্টে ভুগছিল। ব্যবসায়ী ইয়েল চার শ বই, রাজা জর্জ-১–এর ছবি এবং আরও কিছু মূল্যবান সামগ্রী কলেজকে অনুদান হিসেবে দেন। সেগুলো বিক্রি করে যা পাওয়া যায়, তা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সংকট মেটানো হয়। আর সে কারণেই তাঁকে সম্মান দেখাতে কলেজিয়েট স্কুলের নাম হয়ে যায় ইয়েল ইউনিভার্সিটি। এখন অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির কোনো আর্থিক সংকট নেই। মোটা অঙ্কের অনুদান দিতে দাতাদের দীর্ঘ লাইন হয়ে যায়। কিছুদিন আগে চার্লস বি জনসন নামে এক ব্যক্তি একাই ২৫০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে।

আরও পড়ুন

রিফাতকে অনুসরণ করে আমরা হাঁটতে থাকি। আমরা আসলে এসেছি নিউ হেভেনের মেইন ক্যাম্পাসে। রিফাত জানান, ১৪টি কলেজ মিলিয়ে ইয়েল ইউনিভার্সিটি। একেকটি কলেজ মানে হচ্ছে একেকটি সাবজেক্ট। ল কলেজে যেমন আইন পড়ানো হয়, সায়েন্স কলেজে বিজ্ঞানের নানা বিষয় পড়ানো হয়, এমন আরকি। আবাসিক হল, প্রশাসনিক ভবন, লাইব্রেরি ভবন মিলিয়ে ৩২২টি ভবন এই ক্যাম্পাসে। একেটা বিল্ডিং যেন একেকটা প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন। গথিক ধাঁচের টাওয়ার, সবুজ লন ঘিরে লাল ইটের ভবন এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে স্থাপত্য সমালোচকেরা এই ক্যাম্পাসকে ‘আমেরিকার সবচেয়ে সুন্দর নগর ক্যাম্পাস’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর করবেই না বা কেন? আড়াই শ বছরের বেশি সময়ে স্থাপত্যকলার কোন নিদর্শনটা নেই এই ক্যাম্পাসে! সেই ১৭৫০ সালের জর্জিয়ান কাঠামোয় নির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে পুরোনো বিল্ডিংটি তো আমেরিকার ‘ন্যাশনাল হিস্ট্রিক ল্যান্ডমার্ক’ হিসেবেই স্বীকৃতি পেয়েছে। জর্জিয়ান, গথিক স্থাপত্যকলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের আধুনিক স্থাপত্যকলার নকশায় বানানো ভবনও আছে ইয়েল ক্যাম্পাসে। আমরা এগুলোর ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে লাইব্রেরি ভবনে ঢুকে পড়ি।

ইয়েল ক্যাম্পাসের একটি ভবন
ছবি: লেখকের পাঠানো

৩.

লাইব্রেরিটাতে ঢুকেই মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা। বই আর বইয়ে ঠাসা রেকগুলোর উচ্চতা স্বাভাবিকভাবে ঠাওর করা যায় না। আকাশচুম্বী ভবন দেখার জন্য যেমন মাথা বাঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকাতে হয়, অনেকটা সেই রকম অবস্থা।

জানা গেল এটি আসলে ইয়েলের মূল লাইব্রেরি না, এটি হচ্ছে আর্কাইভ মানে রেফারেন্স লাইব্রেরি। কেবল রেফারেন্স! তাহলে আসল লাইব্রেরির অবস্থাটা কেমন?
আমরা ঘুরে ঘুরে রেফারেন্স লাইব্রেরি দেখতে থাকি। লাইব্রেরি দেখা মানে আসলে সারিবদ্ধ বইয়ের স্তূপ দেখা। এক পাশে দেয়ালে বড় ধরনের বিলবোর্ডে কী যেন ঘোষণার মতো আছে। কাছে গিয়ে চোখ রাখতেই বোঝা গেল-জাপানি সাহিত্যের বিশেষ একটা আয়োজন চলছে এই সময়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাহিত্য আর সংস্কৃতি নিয়ে প্রদর্শনী-সেমিনার সিম্পোজিয়াম চলতে থাকে প্রায় নিয়মিতই। ইয়েল তার শিক্ষার্থীদের জানার, বোঝার পরিধিটাকে উন্মুক্ত রাখতে চায় বলে, নানা সংস্কৃতিকে জাঁকজমকভাবেই তুলে ধরে তাদের সামনে।

মূল লাইব্রেরিতে যাওয়ার আগে আমার কালচারাল সেন্টারে ঢুঁ মারি। সেন্টারটার সামনেই একটা নামফলকের মতো একটা স্তম্ভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই স্মৃতিফলক। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চমৎকার কিছু বাণী সেখানে লেখা আছে।

মূল লাইব্রেরি ভবনটাও যেন আরও এক বিস্ময়। স্টার্লিং মেমোরিয়াল লাইব্রেরি নামে পরিচিত মূল লাইব্রেরির প্রবেশপথ থেকে শুরু করে ভেতরের প্রতিটি কক্ষ, ছাদ, দেয়াল সবকিছুই যেন চোখ আটকে রাখে। কেবল যে কারুকার্য করে রাখা হয়েছে তা নয়, সেগুলো করা হয়েছে অর্থপূর্ণ স্থাপত্য নকশা ব্যবহার করে। লাইব্রেরির ঠিক প্রবেশপথেই আছে বেশ কিছু মূর্তি এবং বিভিন্ন ভাষার খোদিত বাণী। মানবসভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ের পণ্ডিত ব্যক্তিদের ছবি এবং তাঁদের বাণী খোদাই করা হয়েছে সেখানে। আর যে যে ভাষার মনীষী ছিলেন, তাঁদের বাণী সংযোজিত করা হয়েছে ঠিক সেই ভাষায়ই। ইংরেজি ভাষার বাণী যেমন আছে, তেমনি আছে হিব্রু, আরবি সব মতকে ধারণ করার একটা ইঙ্গিত যেন লাইব্রেরির প্রবেশপথেই এঁকে দেওয়া আছে।

স্টর্লিং মেমোরিয়াল লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক পাশে ছোট্ট একটি টাওয়ারের মতো জিনিস চোখে পড়ে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে গাইড রিফাতের দিকে তাকাতেই সে জানায়, এটি হচ্ছে জরুরি পুলিশ ডাকার ব্যবস্থা। কোনো কারণে আপনি নিরাপত্তাহীন বোধ করলে এটিতে সুইচ টিপে দিলেই পুলিশ চলে আসবে।

বিশ্বের সেরা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নিরাপত্তাহীনতার ব্যাপার থাকে? পুলিশ ডাকার ব্যবস্থা থাকে?রিফাতকে প্রশ্নটা করতে গিয়েও থেমে যাই। নিজের মনেই একটা উত্তর আসে, ঘটনা ঘটুক বা না ঘটুক, প্রতিরোধের প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা থাকাই প্রাজ্ঞতার লক্ষণ।  

ইয়েল ক্যাম্পাসে গাইড রিফাত এবং স্বপন ভাইয়ের সঙ্গে লেখক
ছবি: লেখকের পাঠানো

৪.

কতক্ষণ ধরে ঘুরছি আমরা! কেউ সময়ের দিকে তাকাইনি। তাকানোর প্রয়োজনই বোধ হয়নি সম্ভবত। বিশ্বের সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উঁচু দালানের স্থাপত্যকলার নিদর্শনই কেবল নয়, ক্যাম্পাসের মানুষগুলোর হাঁটচলা, কথা বলাও যেন আমাদের মুগ্ধ করতে থাকে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অথচ কোথাও কোনো কোলাহল নেই, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া তরুণ কিংবা তরুণীটির চাহনিতেও যেন কেমন একটা স্নিগ্ধ ভাব, যেন ভালোবাসা ঠিকরে পড়ছে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষটির প্রতিও।

ইয়েল ক্যাম্পাস ছাড়ার আগে কোথাও বসে কফি খাব। এত বড় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ক্যাম্পাসে কফি না খেয়ে গেলে কি চলে! আমাদের ইচ্ছার কথা রিফাতকে জানাতেই তার উত্তর এটা তার মাথায় আছে। কোনো একটা কফি হাউসের দিকেই যাচ্ছি—এমন ভাবনা নিয়েই রিফাতকে অনুসরণ করতে থাকি। কিন্তু রিফাত যে বিল্ডিংটির সামনে এসে দাঁড়ায়, সেটি কফি হাউস নয়, ইয়েলের ল স্কুল ভবন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শিক্ষা বিশ্বের সেরাদের একটি, এই সত্যের চেয়েও আমাদের মনে পড়ে গেল, এই ভবনে বিল ক্লিনটন আর হিলারি ক্লিনটন পড়েছেন, এখানেই তাঁদের প্রেম হয়েছিল। ক্লিনটন-হিলারির আলোচনায় ছেদ টেনে দিয়ে আমাদের গাইড রিফাত জানিয়ে দেয়, সে–ও শিগগিরই এই স্কুলে পড়তে আসছে।

এবার আমরা সত্যি সত্যি কফিশপের সন্ধানে হাঁটতে থাকি। চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে, আমাদের ম্যানচেস্টারে ফিরতে হবে। রাতে আবার একটি গানের অনুষ্ঠানে যেতে হবে। গানের অনুষ্ঠানে যাব অবশ্যই গান শুনতে, কানেটিকাটে বাংলাদেশির অনুষ্ঠান আয়োজন কেমন হয়, সেটি তো দেখাই হবে, সেখানেই আমার দিপুর সঙ্গে দেখা হবে। মাহমুদ হাসান দিপু থাকে কানাডার ক্যালগেরি। ক্যালগেরি থেকে সে–ও কানেটিকাটে এসেছে। ওই অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক গ্র্যাজুয়েট হালিমের সাথেও দেখা হবে। কিন্তু আমরা কফি খেতে চাই আসলে আমাদের গাইড নতুন প্রজন্মের রিফাত তরফদারকে আপ্যায়ন করতে।

কফিশপের দিকে যেতে যেতেই একটা ভবনের সামনে থেমে যায় রিফাত। এতক্ষণ আমরা এত যে বিল্ডিং দেখলাম, এটা তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, নান্দনিক সৌন্দর্যের ক্যাম্পাসে যেন বেমানান অনেকটা ভুতুড়ে বিল্ডিং।

-‘এটা সিক্রেট সোসাইটি বিল্ডিং’।
-রিয়েলি!-উত্তেজনায় সেরীন খানিকটা চিৎকার করে ওঠে। ‘সিক্রেট সোসাইটির বিষয়টা তাহলে রিয়েল?-সেরীন প্রশ্ন করে।
-হ্যাঁ।-রিফাতের উত্তর।

’সিক্রেট সোসাইটি’ বা ‘ইয়েলের সিক্রেট বিল্ডিং’ সম্পর্কে আমার কোনো ধারনাই ছিল না। কিন্তু সেরীন দেখলাম এ ব্যাপারে ভালোই জানে। রিফাত আর সেরীন ইয়েলের সিক্রেট বিল্ডিং নিয়ে আলোচনায় মত্ত হয়ে উঠল।

আমি বিল্ডিংটার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম। কাছাকাছি বলতে যতটা কাছাকাছি যাওয়া যায়। আগেই উল্লেখ করেছি নান্দনিক সৌন্দর্যের ক্যাম্পাসে এই বিল্ডিংটা যেন একেবারেই বেমানান। একটা বদ্ধ ঘর, কোনো জানালা চোখে পড়ল না। অন্য পাশে কি কোনো দরজা আছে? আছে হয় তো!

-সত্যিই এখানে প্রেসিডেন্ট, সাবেক প্রেসিডেন্টরা গোপন মিটিং করতে আসেন?-সেরীন প্রশ্ন করে।

রিফাত জবাব দেয়-হ্যাঁ। কিন্তু কেউ কখনো তাদের কাউকে এখানে আসতে দেখেনি। কিন্তু সবাই জানে, এই বিল্ডিংয়ে বসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, সাবেক প্রেসিডেন্ট কিংবা বিশেষ ব্যক্তিরা গোপন মিটিং করেন।

ইয়েল ইউনিভার্সিটির প্রবেশপথে লেখক
ছবি: লেখকের পাঠানো

‘সিক্রেট বিল্ডিং’–এ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কিংবা নীতিনির্ধারকেরা কেউ কখনো মিটিং করতে এসেছিলেন কি না, এই ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। যদিও এই কথাটা প্রায় সবাই জানে এবং বিশ্বাস করে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আমরা যে বিল্ডিংটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, এটি ইয়েলের আট সিক্রেট বিল্ডিংয়ের একটি। নানা নামে আটটি সিক্রেট সোসাইটি এবং সিক্রেট সোসাইটি বিল্ডিং আছে ইয়েলের এই ক্যাম্পাসে। প্রতিবছর ১৫ জন শিক্ষার্থীকে এই সোসাইটির সদস্য পদ দেওয়া হয়। কী প্রক্রিয়ায়, কাদের সিক্রেট সোসাইটির সদস্য পদ দেওয়া হয়, এই তথ্যগুলোও রীতিমতো সিক্রেট। এই সিক্রেট বিল্ডিংগুলোয় সোসাইটির সদস্যরা গোপনে মিটিং করেন, কখনো কখনো রাজধানী থেকে কারা যেন এই সব মিটিংয়ে যোগ দেন। জনশ্রুতি আছে, ইয়েলের সিক্রেট সোসাইটি আসলে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সংগঠন।

ইয়েলের ‘সিক্রেট সোসাইটি’র গল্প শুনতে শুনতে আমরা সামনে এগোতে থাকি। রিফাত আমাদের যে জায়গায়টায় নিয়ে আসে, সেটা আসলে ক্যাম্পাসের বাইরে কিন্তু ক্যাম্পাস লাগোয়া। মাঝখানে কেবল একটি সড়ক। আমরা যখন রেস্টুরেন্ট, কফি হাউসের সাইনবোর্ড পড়ে পড়ে কোনটায় ঢুকব, তা নিয়ে ভাবছিলাম, রিফাত হনহন করে একটা কফি হাউসে ঢুকে যায়। কফি হাউসে ঢুকেই দেয়ালে আঁকা চিত্রকর্ম আর সামগ্রিক সেটআপ যেন নতুন বিস্ময় নিয়ে হাজির হয়। সেই গল্প আলাদাভাবে শোনাব আপনাদের। চলবে...