নিউইয়র্ক—আমেরিকার প্রথম রাজধানী কিংবা ‘সাম্রাজ্য রাজ্যে’

জেহাদ-শাহীনের সঙ্গেছবি: লেখকের পাঠানো

১.

দেবাশীষ বলেছিল কথাটা। ‘অনেকে তো কেবল প্রকৃতি দেখতেই নিউইয়র্ক থেকে কানেটিকাট ড্রাইভ করে। রাস্তাটা এত্ত সুন্দর!’ দুপাশে তাকাতে তাকাতে কেবল ‘আহা! উহু!’ করতে ইচ্ছা হলো। কানেটিকাটে আসার সময় রাত হয়ে গিয়েছিল বলে বাস থেকে এই দৃশ্যটা দেখা হয়নি। আজ জেহাদের গাড়ি থেকে প্রকৃতি উপভোগেরও সুযোগ হয়ে গেল।

জেহাদ গাড়ি চালায় খুব চমৎকার, একেবারে মসৃণ। আমাদের বন্ধু টরন্টোর বাংলা টিভির প্রধান নির্বাহী, লেখক সাজ্জাদ আলী একটা কথা প্রায় বলে থাকেন। চলন্ত গাড়িতে বসে যদি এক ফোঁটাও সিটে না ফেলে চা খেতে পারেন, তাহলে বোঝা যাবে আপনি ভালো চালক, ভালো গাড়ি চালান।’ টরন্টোর তো বটেই, উত্তর আমেরিকার ব্যস্ততম জীবনযাত্রায় অসংখ্য মানুষ সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কফিশফের ড্রাইভ থ্রো থেকে কফি নিয়ে খেতে খেতে অফিস বা কাজের জায়গায় ছুটতে থাকেন। ফলে গাড়ি চালাতে চালাতে চা খাওয়ার অভ্যাস হয়ে যায় প্রায় সবারই। জেহাদ এমনভাবে গাড়ি চালাচ্ছে, যে অনায়াশেই গাড়িতে বসে চা খাওয়া যাবে।

—‘থামব কোথাও? কফি খাবেন?’—ভীষণ চমকে উঠি। গাড়ি চালানো আর কফি খাওয়া নিয়ে ভাবছিলাম যখন, তখনই জেহাদের কফি খাওয়ার প্রস্তাব! এমন কাকতালীয় ঘটনা কীভাবে ঘটে?

—না, না। দেরি হয়ে যাবে।—সেরীন জবাব দেয়।

ডা. মুনমুনের বাসায় সবাই অপেক্ষা করছে। ইতিমধ্যে শাহীন কয়েকবার ফোন করে ফেলেছে। ‘আর কদ্দুর? আর কতক্ষণ?’—টেলিফোনে শাহীনের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর। বুঝতে পারি, অনেক মানুষ সেখানে অপেক্ষায়। কিন্তু কানেটিকাট থেকে নিউইয়র্কের রাস্তাটাও নেহাত কম নয়। সাধারণভাবেই প্রায় পৌনে চার ঘণ্টার ড্রাইভ। আর রাস্তায় বেশ ট্রাফিক। ‘পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে’—জেহাদ আন্দাজ করে বলে।

২.

গাড়িতে চমৎকার একটা পুরোনো দিনের বাংলা গান বাজছে। রাস্তার দু পাশের গভীর অরণ্যের মতো বিশাল বনভূমি, এঁকেবেঁকে যাওয়া সড়কপথ আর অক্টোবরে নতুন রঙ্গে অপরূপা হয়ে ওঠা নানা গাছের, গাছের পাতার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বুঁদ হয়ে আছি। রাস্তায় ভালোই জ্যাম আছে, ক্ষণে ক্ষণে গতি কমিয়ে আানতে হচ্ছে, কখনো কখনো একেবারেই থেমে পড়তে হচ্ছে। হাইওয়েতে কম গতিতে গাড়ি চালানো কিংবা থেমে থাকাটা বিরক্তিকর। কিন্তু নিউইয়র্কের রাস্তায় এই বিরক্তি  প্রকাশ করাটা অবান্তর—এটা গত কয়েক দিনে জেনে গেছি। জেহাদ এদিক–সেদিক লেন বদলে বদলে সময়টাকে যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

জেহাদুল হক জেহাদ আমার বন্ধু শাহীনের ভাগনে। থাকে স্ট্যামফোর্ডে। কানেটিকাটের একটি শহর হলেও সেটি নিউইয়র্কের কাছাকাছি। আমাদের নেওয়ার জন্য তাকে উল্টোপথে এক ঘণ্টার বেশি ড্রাইভ করতে হয়েছে। নিউইয়র্কে আমাদের পৌঁছে দিয়ে সে আবার স্ট্যামফোর্ডে ফিরবে।

জেহাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে হলো—বিদেশ বিভুঁইয়ে গাইড হিসেবেও জেহাদ চমৎকার। যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে অনেক বছর আগে। শুরুটা ছিল নিউইয়র্কে। তারপর কানেটিকাটে বসতি গাড়ে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসা করতেন একসময়। কিন্তু কোভিডের সময় যুক্তরাষ্ট্রের রিয়েল এস্টেট মার্কেট স্থবির হয়ে গেলে সে স্ট্যামফোর্ডে কনভেনিয়েন্ট স্টোর দেয়। কোভিড আমাদের কত কিছুই যে বদলে দিয়েছে। নিউইয়র্কের গোলাম মোস্তফা গোলাপও বলছিল—সে এয়ারপোর্টে  চাকরি করত, কোভিডের সময় এয়ারপোর্ট বন্ধ হয়ে গেলে সে পোস্ট অফিসে চাকরি নেয়। এখন ফেডারেল সরকারের এমপ্লয়ি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পোস্ট অফিসে চাকরি করেন।

নিউইয়র্কের পরিচিতি বিশ্বের রাজধানী হিসেবে। অথচ এটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীই নয়। এমনকি খোদ নিউইয়র্ক রাজ্যের রাজধানীও অন্য একটা শহর—আলবেনি, নিউইয়র্ক থেকে প্রায় দেড় শ মাইল উত্তরে। অবশ্য নিউইয়র্ক কোনো একটা সময় যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীই ছিল, প্রথম রাজধানী।

জেহাদ জানাল, সে সময় পেলেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরতে চলে যায়। আর যেখানেই যায় সেখানকার বিবরণ, তথ্য দিয়ে ইউটিউব করে। আমাদের গাড়ি চলতে থাকে, জেহাদের সঙ্গে নিউইয়র্ক আর কানেটিকাট নিয়ে কথাবার্তা চলতে থাকে। বলা চলে, নিউইয়র্কে পৌঁছার আগে আমি জেহাদের চোখ দিয়ে নিউইয়র্ক দেখতে থাকি।

আমরা যে রাস্তাটা ধরেছি, তার নাম আই ৯১ এস (I91S)। টরন্টোর হাইওয়েগুলো কেবল একটি নম্বরেই চিহ্নিত করা হয়। যেমন হাইওয়ে ৪০১, হাইওয়ে ৪২৭, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের হাইওয়ের নামে নম্বরের সঙ্গে একটা অক্ষর আছে, যেমন I 91। যেই হাইওয়েগুলো এক রাজ্যের সঙ্গে অন্য রাজ্যের সংযোগ স্থাপন করেছে, সেগুলোর নামের সঙ্গে ‘আই’ আছে।  ‘আই’ মানে হচ্ছে ‘ইন্টার স্টেট’—আন্তরাজ্য। হাইওয়ের নাম অবশ্য সংখ্যায়ই। প্রধান প্রধান হাইওয়ের নাম দুই ডিজিটে এবং সেগুলো সবই বিজোড় সংখ্যা। আর এই রাস্তাগুলো প্রবাহিত হয়েছে উত্তর দক্ষিণে। আর সহায়ক হাইওয়েগুলোর নাম তিন ডিজিটে এবং সেগুলো জোড়সংখ্যার। সেই রাস্তাগুলো পূর্ব থেকে পশ্চিমে। আমরা এখন I 91S ধরে যাচ্ছি। নিউইয়র্কের কাছাকাছি গিয়ে আই-২৭৮ ধরব। ১৯২৬ সালে নতুন এই ব্যবস্থা নামকরণ চালুর আগে ‘ইউএস-১’, ‘ইউএস-২’ এভাবে হাইওয়ের নামকরণ হতো। এখনো কোথাও কোথাও নতুন নামের সঙ্গে পুরোনো ইউএস–১ বা ইউএস–২ সেই নাম রাস্তার বোর্ডে উল্লেখ করা হয়।

ডা. মুনমুন-ডা. সেলিমের বাসায়
ছবি: লেখকের পাঠানো

—‘আর কতক্ষণ? কোন জায়গায় এখন?’—নিউইয়র্ক থেকে আবারও শাহীনের ফোন আসে। ‘তাড়াতাড়ি আসো, সবাই অপেক্ষায় আছে।’—বন্ধুর কণ্ঠে তাগাদা। কিন্তু আমরাই–বা কী করতে পারি। দূরত্ব আর জ্যাম, কোনোটাই তো উপেক্ষা করার মতো নয়।

—তাড়াহুড়ার কিছু নেই। তুমি তোমার কমফোর্টে গাড়ি চালাও—জেহাদকে আশ্বস্ত করি আমি। জেহাদ তার মতো করে গাড়ি চালাতে থাকে। নিউইয়র্ক পৌঁছুতে আর কতক্ষণ—এই ভাবনাটা ভুলে থাকতে চাই আমরা। ব্যস্ততম হাইওয়েতে কোনো তাড়া নিয়ে গাড়ি চালাতে নেই।

আরও পড়ুন

৩.

নিউইয়র্কের পরিচিতি বিশ্বের রাজধানী হিসেবে। অথচ এটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীই নয়। এমনকি খোদ নিউইয়র্ক রাজ্যের রাজধানীও অন্য একটা শহর—আলবেনি, নিউইয়র্ক থেকে প্রায় দেড় শ মাইল উত্তরে। অবশ্য নিউইয়র্ক কোনো একটা সময় যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীই ছিল, প্রথম রাজধানী। সেটা ১৭৮৫ থেকে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত। তারপর ওয়াশিংটন চূড়ান্ত হওয়ার আগে ফিলাডেলফিয়াও যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ছিল।

কাগজে–কলমে নিউইয়র্ক যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী না হলেও কালের পরিক্রমায় শহরটি গুরুত্বের বিবেচনায় রাজধানীর চেয়েও বেশি কিছু হয়ে ওঠে। যে কারণে নিউইয়র্ক পরিচিত হয়ে ওঠে ‘এম্পায়ার স্টেট’ বা ‘সাম্রাজ্য রাজ্য’ হিসেবে। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, আগের এক পর্বে আমি বলেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যেরই একটি ডাকনাম আছে, নিউইয়র্কের ডাকনাম হচ্ছে ‘এম্পায়ার স্টেট’।

ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই  মুনমুন আমাদের নিয়ে অস্থির হয়ে পড়লেন। তাঁর দুশ্চিন্তা—আয়োজনটা ছিল দুপুরের, সবাই খেয়ে চলে গেছে, আমাদের জন্য কোনো কিছু বাদ পড়ল কি না। বিশাল ডাইনিং টেবিলে খাবারের বহর দেখে আমাদের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। কিন্তু মুনমুনের যেন অতৃপ্তির শেষ নেই।

নিউইয়র্ক কেন ‘এম্পায়ার স্টেট’, এ নিয়েও নানা রকম গল্প আছে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি যে ব্যাখ্যাটি দেওয়া হয়, তা হলো—আমেরিকান বিপ্লবের সময় নিউইয়র্ক শহরের কৌশলগত গুরুত্ব ও শক্তির প্রশংসা করতে গিয়ে জর্জ ওয়াশিংটন এটিকে ‘সম্রাটদের আসন’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তবে রাজ্যের বিশাল সম্পদ, অর্থনৈতিক শক্তি এবং বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যার আধিপত্য ও অর্থনীতিতে সেই জনসংখ্যার ভূমিকার কারণে শহরের নাম  হিসেবে ‘এম্পায়ার স্টেট’ই  স্থায়ী হয়ে যায়। এই নামের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের  ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতিতে এর কেন্দ্রীয় ভূমিকা ও একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে এর অপরিসীম সম্ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায়।  ‘এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং’ নামে ১০২ তলার একটি বিশাল ভবন শহরের ট্যুরিস্ট আকর্ষণ হিসেবেই কেবল নয়, আকাশছোঁয়ার অহংকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

—আমরা কি শহরে পৌঁছে গেলাম!—আকাশছোঁয়া অট্টালিকাগুলো যেন আপনাতেই জানিয়ে দেয়—এটা নিউইয়র্ক শহর। লেকের মতো কিছু একটা, তার পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়িটা। কোনো একটা সাইনবোর্ডে কি ‘ম্যানহাটান’ নামটা চোখে পড়ল! পরপর বেশ কয়েকটা বড় বড় ব্রিজ পার হয়ে গেলাম আমরা, ব্রিজগুলো যেন দুই প্রান্তের দুই শহরকে হাত ধরাধরি করে একসঙ্গে আগলে রেখেছে।

—আমরা কি এই ব্রিজের ওপর দিয়ে যাব? সেরীন জানতে চায়।

—না। আমরা ব্রিজে যাচ্ছি না। টানেলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যাব।—জেহাদ উত্তর দেয়।

—টানেলের ভেতর দিয়ে!—সেরীন খানিকটা বিস্ময় নিয়েই প্রশ্ন করে।

—হ্যাঁ। হাডসন নদীর ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া ট্যানেল। এই নিউইয়র্ক শহরটা হচ্ছে ব্রিজ আর টানেলের শহর। আপনারা যখন ঘুরতে বেরুবেন, টাইমস স্কয়ার, ম্যানহাটানে যাবেন, তখন সময় করে ব্রুকলিন ব্রিজে যাবেন। অনেক মানুষ দূর থেকে ব্রুকলিন ব্রিজ দেখে, ব্রুকলিন ব্রিজে হাঁটে।

ম্যানহাটানের অট্টালিকা
ছবি: লেখকের পাঠানো ছবি: লেখকের পাঠানো

ব্রুকলিন ব্রিজ, ম্যানহাটান, টাইম স্কয়ার—নামগুলো মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে। কোথায় যেন পড়েছিলাম—প্রতিটি মানুষের যেমন একটা গল্প থাকে, প্রতিটি শহরেরও নানা রকম গল্প থাকে। নিউইয়র্কের মতো শহর নিয়ে হাজারো গল্প থাকাটা স্বাভাবিক। সেই গল্পগুলো কী! জেহাদ আমাদের বিশাল বিশাল ব্রিজ, গগনচুম্বী অট্টালিকার পাশ দিয়ে, টানেলের ভেতর দিয়ে ব্রুকলিনে ডা. মুনমুনের বাসায় নিয়ে হাজির হয়।

আরও পড়ুন

৪.

ব্রুকলিনে মুনমুনের বাসায় যখন আমরা পৌঁছি, ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা ৬টা ছুঁয়ে ডানদিকে হেলে পড়েছে। দুপুরের নিমন্ত্রণে আমরা কিনা এসে হাজির হয়েছি সন্ধ্যায়। বন্ধু মঞ্জুর আলম শাহীন তাতে ও খুশি—‘শেষ পর্যন্ত আসতে পেরেছো যে।’

মুনমুনের সঙ্গে আমার এই প্রথম পরিচয়। যার বাসায় দাওয়াত খেতে সেই কানেটিকাট থেকে পড়িমরি করে ছুটে আসা—তাঁর সঙ্গে পরিচুয়টুকুই নেই, ভাবতে কেমন অস্বাভাবিক লাগে, তাই না? আমাদের বন্ধু, বন্ধুত্বগুলো এমনি।

ডা. শারমীন সুলতানা মুনমুন আর তাঁর হাজব্যান্ড ডা. সেলিম হোসাইন। দুজনেই যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। মুনমুন আসলে শাহীনের বন্ধু। মুনমুনের বাবা একসময় ফেনীতে সরকারি চিকিৎসক হিসেবে চাকরি করেছেন, সেই সময় থেকে মুনমুনদের সঙ্গে শাহীনের বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব এখনো অটল। মুনমুনের আরেকটা পরিচয় আছে, ডাকসুর সাবেক জিএস ও জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব  প্রয়াত জিয়াউদ্দিন বাবলুর ছোট বোন মুনমুন।

ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই  মুনমুন আমাদের নিয়ে অস্থির হয়ে পড়লেন। তাঁর দুশ্চিন্তা—আয়োজনটা ছিল দুপুরের, সবাই খেয়ে চলে গেছে, আমাদের জন্য কোনো কিছু বাদ পড়ল কি না। বিশাল ডাইনিং টেবিলে খাবারের বহর দেখে আমাদের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। কিন্তু মুনমুনের যেন অতৃপ্তির শেষ নেই। খাবার ঠিকমতো গরম আছে কি না, নিজেই ছুটলেন মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করে দিতে, কোন খাবারটা বেশি সুস্বাদু—সেটা যন মিস না করি—এমন সব তদারকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মুনমুন। খেতে খেতে আমি মুনমুনের অস্থিরতা দেখছিলাম,দেখছিলাম একজন মানুষের নিখাদ আন্তরিকতা। অনেক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা, যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালের একজন চিকিৎসক—এই মাত্র পরিচয় হওয়া ক্ষণিকের অতিথির জন্য তার কী আন্তরিকতা!

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

খাবার শেষ হতে না হতেই আড্ডা জমে ওঠে। আসলে আড্ডা চলছিল সেই দুপুর থেকেই। আমরা চলমান আড্ডায় যুক্ত হয়েছি মাত্র। সেলিম ভাই ‘মাই ডিয়ার’ টাইপের মানুষ, চমৎকার আড্ডাবাজও। আড্ডায় জমে গিয়ে আমরা ভুলে যাই—আমাদের আর কোথাও যাওয়ার কথা।

জেহাদের তাগাদায় আমাদের সম্বিত ফেরে। তাকে ফিরে যেতে হবে কানেটিকাটের স্ট্যামফোর্ড। শাহীনও ততক্ষণে হইচই করে ওঠে—ইউনিভার্সিটির অ্যালামনাই নাইটে যেতে হবে, শুরু হয়ে গেছে তো।

জেহাদের গাড়িতে আমাদের ব্যাগ। সেগুলোর কী হবে?

শাহীনের যেন সবকিছু সাজানোই ছিল। জেহাদের গাড়ি থেকে ব্যাগ চলে যায় তানজিলের গাড়িতে। লক্ষ্মীপুরের ছেলে তানজিলের সঙ্গেও আমার প্রথম পরিচয়।

—আপনারা নঈম ভাইয়ের বাসায় থাকবেন তো? আমি পৌঁছে দেব। ব্যাগ আপাতত আমার গাড়িতেই থাক।—এ কথা বলেই  তানজিল নিজের গাড়িতে ব্যাগ তুলে নেয়। জেহাদও বিদায় নেয়।

‘কানেটিকাট থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত আপনার সঙ্গটা খুবই এনজয় করেছি।’ বলে জেহাদকে বিদায় জানাই।

আরও পড়ুন

৫.

ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই প্রোগ্রামটা হচ্ছে 57th স্ট্রিট, উডসাইডের ‘কুইন্স প্যালেসে’। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন নর্থ আমেরিকা ইনক আয়োজন করেছে এই ‘চিটাগাং ইউনির্ভাসিটি অ্যালামনাই নাইট’। কেবল নিউইয়র্কই নয়, আশপাশের নানা রাজ্য থেকেও চিটাগাং ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েটরা এসেছে। শাহীন নিজেই তো এসেছে ফ্লোরিডা থেকে। টরোন্টো থেকে এসেছেন আমাদের বড় ভাই, সাংবাদিক মোশাররফ হোসেন।

কুইন্স প্যালেসের ভেতর ঢুকতেই কেমন যেন একটা নস্টালজিয়া কাজ করে। বসে থাকা, দাঁড়িয়ে থাকা, হাঁটাচলা করা মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকাই আর ভাবি—এঁরা একসময় চট্টগ্রামের পাহাড়ঘেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস চষে বেড়াতেন। জীবন–জীবিকার তাগিদে তাঁরা এখন অন্য মেরুতে বসতি গেড়েছেন। আবার এখানেও নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তুলেছেন।

মঞ্চে প্রোগ্রাম চলছে, আমি অনুষ্ঠানস্থলের ভেতর ঘুরতে থাকি আর মানুষের মুখের দিকে তাকাই। ইংরেজি বিভাগের বিধান বিশ্বাসের সঙ্গে এখানে আমার দেখা হওয়ার কথা। কালই সে ফোন করেছিল। শামীম মানে আমাদের আবদুল আউয়াল তো সপ্তাহে সপ্তাহে ফোন করে অস্থির করে ফেলে, কখন আসবে নিউইয়র্ক। অ্যালামনাই নাইটে একসঙ্গে এত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা কম কী! সংগঠনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন লেখক হোসাইন কবীর, ছড়াকার শামস চৌধুরী রুশো—এঁদের অবশ্য চিনতে অসুবিধা হয় না।

কেউ কেউ সামনে এসে হাত বাড়িয়ে আচমকা জিজ্ঞেস করে বসে—চিনতে পেরেছো? চেহারায় ‘হ্যাঁ, চিনি তো’ ভাব করেও রেহাই পাওয়া যায় না। ‘নাম বলো’—অনিবার্য প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার প্রায় ৩৫ বছর পর হঠাৎ কারও সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্রই চিনে ফেলা কিংবা নাম বলে ফেলা কঠিন  কাজ। কিন্তু তাতেও সমস্যা হচ্ছে না, বিব্রতও হচ্ছি না। বরং এই যে নাম বলতে না পারার কারণে অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়া—সেটাই বরং আনন্দ দিচ্ছে বেশি। চলবে...

আরও পড়ুন