নিউইয়র্ক দেখা, প্রস্তুতি পর্ব

নিউইয়র্কে চবি অ্যালামনাই নাইটে শাহীন, মোশারফ হোসেন, সেরীনসহ লেখকছবি: লেখকের পাঠানো

ফিফটি সেভেনথ স্ট্রিট, উডসাইডের ‘কুইন্স প্যালেস’ থেকে ওয়ান হানড্রেড ফিফটিথ স্ট্রিটে যেতে বার কয়েক হোঁচট খেতে হলো। খানিকটা ঘুরে, ফোন করে ডিরেকশন নিয়ে আমরা বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াই। তামজিদ গাড়ি থেকে ব্যাগ নামাতে যায়। কিন্তু বাড়িটা এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন কেন? ওপরে–নিচে সব লাইটই তো বন্ধ দেখা যাচ্ছে। উডসাইড থেকে বেরিয়ে মাঝপথে যখন কথা হলো, তখনো জানিয়েছি, আমরা ৮–১০ মিনিটের দূরত্বে আছি। এই সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার কথা না।

কলিং বেল টিপে অপেক্ষায় থাকি। বেশ কিছুক্ষণ পর ওপরতলার বাতি জ্বলে ওঠে। কেউ একজন জানালার পাশে এসে উঁকি দেন। একজন বয়স্ক লোক। নিচতলা থেকে চেহারার অবয়বটা চেনা লাগছে না। তাহলে আমরা কি ভুল করলাম! জানালার পাশে যে লোকটাকে উঁকি দিতে দেখলাম, তিনি যে নঈম ভাই নন, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আবার ফোন করি।

: আপনার বাসার সামনে, নিচে।

: ধুর মিয়া। কই তোমরা। আমি তো দেখতে পাচ্ছি না।

এবার তামজিদ কথা বলে। বুঝতে পারি আমরা ভুল করেছি। কিন্তু ঠিকানা তো হুবহু এক। তাহলে?

তানজিল পরিষ্কার করে, রোড আর স্ট্রিটের প্যাচে গোলামাল হয়েছে কোথাও।

গাড়িতে ওঠেন, এবার আর ভুল হবে না।—তানজিল তাড়া দেয়।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে বিহ্বল হয়ে থাকা লোকটা তখনো জানালায় দাঁড়িয়ে, আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কী ঘটেছে, সম্ভবত সেটা বোঝার চেষ্টা করছে। এত রাতে বাড়ির সামনে গাড়ি, দু–তিনজন অপরিচিত লোক, কলিং বেলে চাপ, তাঁর তো নির্ঘাত ৯১১ কল করার কথা! ভাগ্যিস, তিনি এসবের কিছুই করেননি! জানালার দিকে হাত নাড়ি, খানিকটা শব্দ করেই বলি, সরি ম্যান। মাই অ্যাপোলজিস।

তানজিল আবার গাড়ি ছেড়ে দেয়। এবার ঠিকই পেয়ে যাব, আশ্বস্ত করে সে।

রাস্তার ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি। শহরে ঘুরে বেড়াতে হলে রাস্তার মেকানিজমটা তো বুঝতে হবে। নিউইয়র্কের রাস্তাগুলোর নামকরণ হয়েছে গাণিতিক নম্বর দিয়ে। টরন্টোর রাস্তার যেমন নিজস্ব একটা নাম আছে, যেমন প্যাস্ট্রানো কোর্ট, ব্রিমলি রোড, ডেনফোর্থ অ্যাভিনিউ, নিউইয়র্কের ব্যাপারটা ভিন্ন রকম। এখানে রাস্তার নাম হচ্ছে 150th স্ট্রিট 88th অ্যাভিনিউ। নিউইয়র্কের অধিকাংশ রাস্তাই এই রকম নম্বর দিয়ে চিহ্নিত। তবে কিছু কিছু রাস্তার অবশ্য আলাদা নাম আছে। যেমন—লেক্সিংটন অ্যাভিনিউ, ম্যাডিসন অ্যাভিনিউ। সেগুলো অবশ্য সংখ্যায় কম।

স্ট্রিটগুলো পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে। অ্যাভিনিউ গেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। শুনেছি রাস্তার এই সন্নিবেশটি করা হয়েছে ম্যানহাটানকে ঘিরে। ম্যানহাটানকে বলা হয়ে থাকে নিউইয়র্কের হৃৎপিণ্ড। আর মিডটাউন হচ্ছে ম্যানহাটানের কেন্দ্রবিন্দু। একটু মনোযোগী না হলে নম্বরের খেলায় হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়, যেমন আমরা নঈম ভাইয়ের বাসা হারিয়ে অন্য বাড়ির দরজায় গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করেছি।

আরও পড়ুন
গাড়ি থেকে দেখা রাতের নিউইয়র্ক
ছবি: লেখকের পাঠানো

২.

কুইন্স প্যালেসে চিটাগং ইউনিভার্সিটির অ্যালামনাই নাইট শেষ না করেই আমরা চলে এসেছি। কানেটিকাট থেকে দীর্ঘ ড্রাইভের পর লম্বা সময় ধরে অনুষ্ঠান উপভোগ করা কঠিন বৈকি! কিন্ত প্রোগ্রামটা খুবই ভালো লাগছিল। এই যে বিদেশবিভূঁইয়ে এত মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়া, পুরোনো সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা হওয়া—এগুলো তো অমূল্য স্মৃতি। শিল্পী তপন কান্তি বৈদ্যের গান শুনে তো বিমোহিত হয়েছি। শুনেছি, শিল্পী তপন বৈদ্য নিউইয়র্কেই থাকেন শুদ্ধ সংগীতের সাধক তিনি। টরন্টো থেকে আসা সাংবাদিক মোশারফ হোসেন তাঁকে রাজি করিয়ে অনুষ্ঠানে গাইতে নিয়ে এসেছেন। নিউইয়র্ক ভ্রমণে তপন বৈদ্যর গান স্মৃতি হিসেবে চমৎকার সংযোজন হয়ে থাকল।

তানজিলের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল আমাদের নঈম ভাইয়ের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার। লক্ষ্মীপুরের ছেলে তানজিল নিউইয়র্কে থাকেন, ম্যানহাটানে তাঁর অফিস। আইটি এক্সপার্ট, কাজ করেন সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে। ব্রুকলিনে ডা. মুনমুনের বাসা থেকে তাঁর গাড়িতেই আমরা কুইন্স প্যালেসে গেলাম চিটাগং ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই নাইটে। আমাদের বন্ধু মঞ্জুর আলম শাহীনের অনেক আত্মীয়স্বজন, বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী আছে এই শহরে। অতিথিদের সহায়তা করার ক্ষেত্রে তারা খুবই আন্তরিক। তানজিল তাদেরই একজন।

—নিউইয়র্কে আগে আর আসেননি? সেরীন আর আমার কথাবার্তার সূত্র ধরেই জানতে চায় তানজিল।

না।—আমাদের উত্তর শুনে আরও মনোযোগী হয়ে ওঠে তানজিল।

—তাহলে তো বাঙালি পাড়াও দেখেননি।

আরও পড়ুন
হঠাৎ ঘুম ভেঙে বিহ্বল হয়ে থাকা লোকটা তখনো জানালায় দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে আছে। কী ঘটেছে, সম্ভবত সেটা বোঝার চেষ্টা করছে। এত রাতে বাড়ির সামনে গাড়ি, দু–তিনজন অপরিচিত লোক, কলিং বেলে চাপ—তাঁর তো নির্ঘাত ৯১১ কল করার কথা! ভাগ্যিস, তিনি এসবের কিছুই করেননি!

নিউইয়র্কের বাঙালি পাড়া বলতে তো জ্যাকসন হাইট! জ্যাকসন হাইটের গল্প শোনেনি এমন মানুষ খুবই কম পাওয়া যাবে। আমাদের অবশ্য করণীয় তালিকায়ও জ্যাকসন হাইট আছে—ম্যান্ডেটরি মার্ক করা।

জ্যাকসন হাইট তো বটেই, জ্যামাইকাও এখন বাঙালি পাড়া হয়ে উঠেছে। আমি আপনাদের জ্যামাইকার পাড়াটা ঘুরিয়ে নিয়ে যাব। এখন তো রাত হয়ে গেছে, গাড়ি থেকেই দেখে নেবেন।

তানজিলের গাড়ি চলতে থাকে। আমি আর সেরীন দুই পাশের অট্টালিকা দেখি। নিউইয়র্ক শহর দেখা মানেই তো অট্টালিকা দেখা। অন্তত চলন্ত গাড়ি থেকে দেখলে। অট্টালিকা, গাড়ি আর মানুষ—এইভাবে কি নিউইয়র্ককে চিত্রিত করা যায়!—মনে মনে ভাবি। রাতের নিউইয়র্কে নানা রঙের আলোয় বিল্ডিংগুলো যেন এক অপরূপ রূপ ধারণ করেছে। আমরা সেই রূপে ডুবে থাকি।

৩.

কোনো নতুন এলাকায় ভ্রমণে গেলে নাকি সেই এলাকার ভূগোল, ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞান ভালোভাবে জেনে নিতে হয়। নইলে এলাকাটার রস পুরোপুরি আস্বাদন করা যায় না। এগুলো জ্ঞানী লোকদের কথা। আমি বুঝি আনন্দ পাওয়া। একটা নতুন জায়গা আমাকে কীভাবে, কতটা আনন্দ দিচ্ছে, সেটাকেই গুরুত্ব দিই আমি। আমাকে বেশি টানে গল্প, শহর আর শহরের মানুষের গল্প।

এই নিউইয়র্কের কথাই ধরুন না। আমরা যে এলাকাটাকে নিউইয়র্ক হিসেবে চিনি, এই জনপদে আদি আমেরিকানদের প্রথম পদচারণ ঘটেছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। তারপর আজকের নিউইয়র্কে পৌঁছুতে তাকে কত গল্পের জন্ম দিতে হয়েছে! অনেক ইতিহাসও তো গড়িয়েছে। আর বর্তমানের নিউইয়র্কেও তো প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে কতশত গল্প, আনন্দ–বেদনা–পরাজয়–সাফল্যের গল্প।

কোনো নতুন এলাকায় ভ্রমণে গেলে নাকি সেই এলাকার ভূগোল, ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞান ভালোভাবে জেনে নিতে হয়। নইলে এলাকাটার রস পুরোপুরি আস্বাদন করা যায় না। এগুলো জ্ঞানী লোকদের কথা। আমি বুঝি আনন্দ পাওয়া। একটা নতুন জায়গা আমাকে কীভাবে, কতটা আনন্দ দিচ্ছে, সেটাকেই গুরুত্ব দিই আমি। আমাকে বেশি টানে গল্প, শহর আর শহরের মানুষের গল্প।

দ্বীপ আর ভূখণ্ডের ওপর গড়ে উঠেছে এই নিউইয়র্ক শহর, তার অবস্থানটা একেবারে হাডসন নদীর মোহনায়। এই নদী আবার আটলান্টিকে মিশেছে। শহরটিও গড়ে উঠেছে মূল ভূমি আর দ্বীপ মিলিয়ে। নিউইয়র্কের কেবল ব্রঙ্কসই মেইনল্যান্ড, ম্যানহাটান, কুইন্স, স্টাটেন আইল্যান্ড—এগুলো তো একেকটি দ্বীপ। আর এই শহরগুলোর এক অংশের সঙ্গে আরেক অংশের সংযোগ ঘটাতে হয়েছে বিশাল বিশাল ব্রিজ আর টানেল দিয়ে। হাডসন নদীর পেট চিরে টানেল আর ওপর দিয়ে ব্রিজ শহর নিউইয়র্কটাকে যেন এক পালকের ভেতর আগলে রাখা হয়েছে। আর এই ব্রিজগুলো, এই টানেলগুলোও তো নিউইয়র্কের দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। জেহাদ তো আমাদের জানিয়েছিল, ব্রকলিন ব্রিজ দেখতে কী রকম মানুষের ভিড় জমে।

নিউইয়র্কের আবার পাঁচটি বরো আছে ম্যানহাটান, ব্রুকলিন, কুইন্স, ব্রঙ্কস, স্টেটেন দ্বীপ। এই বরোগুলো হচ্ছে নিউইয়র্কের একেকটি জেলা, বলা যায় প্রশাসনিক ইউনিট। তবে এগুলো আলাদা মিউনিসিপ্যালিটি নয়। এগুলো নিউইয়র্ক শহরের অধীনেই এবং নিউইয়র্কের মেয়রই তাদের মেয়র। নিউইয়র্ক সিটির একজন মেয়র এবং ৫১ জন সিটি কাউন্সিলর আছে, প্রতিটি বোরোর আছে একজন করে প্রেসিডেন্ট, যিনি সরাসরি নির্বাচিত হন। তবে তার ভূমিকা অনেকটা আলংকারিক, তিনি কেবল তাঁর এলাকার প্রয়োজন নিয়ে পরামর্শ দিতে পারেন।

আরও পড়ুন
নিউইয়র্কে লেখক
ছবি: লেখকের পাঠানো

৪.

নিউইয়র্ক শহর তো পুরোটাই দেখার মতো স্থান। কিন্তু কয়েক দিনের পর্যটকের পক্ষে কি আর সবকিছু দেখা সম্ভব! এ নিয়ে কথা হয়েছিল দেবাশীষের সঙ্গে। আমাদের নিউইয়র্ক ট্যুরের শুরুটাই হয়েছিল দেবাশীষের সঙ্গে আলাপ করেই। স্ট্যাচু অব লিবার্টি তো নিউইয়র্কের আইকনিক স্পট, ম্যানহাটান, টাইম স্কয়ার, মেমোরিয়াল মিউজিয়াম, সেন্ট্রাল পার্ক, মিউজিয়াম আর নিউইয়র্কের থিয়েটার—কত কিছু নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা। বাঙালি পাড়া জ্যাকসন হাইট, নিউইয়র্কের স্ট্রিট ফুড, কোনো কিছুই তালিকার বাইরে নেই।

—আপনাদের প্ল্যান করে নিতে হবে, আগে থেকে ঠিক করে নিতে হবে কোথায় যেতে চান। নইলে হজপজ লেগে যাবে, তানজিল পরামর্শ দেয়।

—আমার একটা লিস্ট আছে। আমি আমার চেনাজানা যাঁরা নিউইয়র্কে আসেন, তাঁদের এটা দিই। এক দিনের প্ল্যান, দুই দিনের প্ল্যান, তিন দিনের প্ল্যান—এইভাবে সাজানো।—তানজিদের কথা শুনে সেরীন আমি দুজনেই আগ্রহী হয়ে উঠি।

—আমাদের পাঠিয়ে দিন—সেরীনের তুমুল আগ্রহ।

তানজিল হোয়াটসঅ্যাপে তার নিউইয়র্ক দেখার এক্সপার্ট গাইডটা ফরোয়ার্ড করে দেয়। গাইড তো নয়, যেন একেবারে হাতে–কলমে শেখানোর ওয়ার্ক বুক। কোন জায়গায় থেকে কোন ট্রেন ধরে কোথায় যেতে হবে, কতটুকু হাঁটতে হবে, কী দেখতে হবে—বিস্তারিত উল্লেখ আছে তার এই ওয়ার্ক বুকে।

তানজিলের ওয়ার্ক বুক, দেবাশীষের সঙ্গে আলোচনার সূত্র ধরে আমাদের শর্টলিস্ট, সব হাতে নিয়ে বসে থাকে সেরীন। এত কিছুর ভেতর থেকে কীভাবে শুরু করব আমরা, কোত্থেকে শুরু করব। এর মাঝে গোলাপ (গোলাম মোস্তফা গোলাপ) বার্তা পাঠায়—সকাল সকাল রেডি থাকবেন মামা, স্ট্যাচু অব লিবার্টি যাব। সেখানে যেতে একটু সময় লাগবে। তাহলে স্ট্যাচু লিবার্টি দিয়েই শুরু হচ্ছে নিউইয়র্ক অ্যাডভেঞ্চার! স্ট্যাচু অব লিবার্টিই যেন হাতছানি দিচ্ছে। চলবে...

আরও পড়ুন