কানাডা আগমনের নেপথ্য-কথা: পর্ব-৩

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কিন্তু মাস কয়েক যেতে না যেতেই শুরু হলো মালয়েশিয়াসহ এশিয়ার একটা অংশজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা। মন্দা শুরুর ঠিক আগে আগে ইসরায়েলি ছাত্রদের একটি ক্রিকেট টিমকে কুয়ালালামপুরে খেলার আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদকে পড়তে হয়েছিল রাজনৈতিক তোপের মুখে। মন্দা যখন শুরু, ঠিক সেই সময়টায় মাহাথির তাঁর ডেপুটি আনোয়ার ইব্রাহিমকে করলেন পদচ্যুত। মতপার্থক্যের কারণে তাঁদের ভেতর নাকি দিন দিন বাড়ছিল দূরত্ব। মাহাথিরের ইঙ্গিতে পুলিশ আনোয়ার ইব্রাহিমকে গ্রেপ্তার করে ‘সডোমি’ ও দুর্নীতির অভিযোগে। মামলা যখন কোর্টে উঠল, আনোয়ার ইব্রাহিমের চোখেমুখে পুলিশি অত্যাচারের চিহ্ন স্পস্ট। স্বাভাবিকভাবেই ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার’ জোরালো অভিযোগ উঠল মাহাথিরের বিরুদ্ধে। পরে অবশ্য হাইকোর্ট আনোয়ার ইব্রাহিমকে নির্যাতন করার অভিযোগে পুলিশ বিভাগকে দায়ী করেন এবং পরবর্তী সময়ে পুলিশের আইজি আবদুল রহিম নূর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সব মিলিয়ে মালয়েশিয়ার অবস্থা তখন টালমাটাল।

প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মার্কিন ইনভেস্টর ‘জর্জ সরোজ’–কে দায়ী করলেন অর্থনৈতিক এই মন্দার মূল হোতা হিসেবে এবং দৃঢ় হাতে আইএমএফের ঋণ ছাড়াই মন্দা কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হলেন। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নেওয়া হলো ‘বেল্ট টাইটেনিং’ নীতি। এর ফলে আমাদের ‘ক্যাটালগিং অব বায়ো-ডাইভার্সিটি ইন মালয়েশিয়া’ প্রকল্পের অবস্থা হলো ‘ হালুয়া টাইট’-গ্র্যান্ট বন্ধ, আমার পদ হয়ে গেল অবৈতনিক। চলমান অনেক উন্নয়ন প্রকল্পেরও ভাগ্য হলো অনিশ্চিত, কর্মচ্যুত হলো অনেকে। ঠিক এই সময় ইন্দোনেশিয়ার ‘ফরেস্ট ফায়ার’-এর কারণে কুয়ালালামপুর শহর ঢাকা পড়ল ‘হেইজ’-এ। দুই হাত দূরের জিনিসও চলে গেল দৃষ্টিসীমার আড়ালে। সবাই মুখে মাস্ক লাগানো শুরু করল অসহনীয় মাত্রার বায়ুদূষণের হাত থেকে বাঁচার জন্যে। প্রধানমন্ত্রী মাহাথির ‘অপারেশন হেইজ’ নামে ফায়ার ব্রিগেডের এক বিশেষ টিম পাঠালেন ইন্দোনেশিয়ায়, তাতে অবশ্য কুয়ালালামপুরের হেইজের কোনো প্রকার উনিশ-বিশ হলো না। পুরো শহরটার চেহারা পালটে যেতে শুরু করল। মালয়েশিয়ার সম্ভাবনাময় আলোকিত ভবিষ্যৎ যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ঘন কুয়াশার চাদরে। আমিও চিন্তিত হলাম আমার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

আরও পড়ুন

পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির এক গবেষণাপ্রকল্পের ‘রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার’-এর পদে আবেদন করি। গবেষণার বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘ই-লার্নিং’ এবং লক্ষ্য হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির শিক্ষাপদ্ধতিতে বাস্তবসম্মতভাবে কীভাবে ই-লার্নিং-কে সম্পৃক্ত করা যায়, সেই বিষয়ে অনুসন্ধান ও সুপারিশমালা প্রণয়ন। রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার পদে আসলে একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে খোঁজা হচ্ছিল, যাঁর কাজ হবে সুপারিশমালার ‘প্রুফ অব কনসেপ্ট’ তৈরি করা—ইন্টারনেট বা অনলাইনভিত্তিক সফটওয়্যারের মাধ্যমে। অ্যাপ্লাই করার সপ্তাহখানেকের মধ্যে ইন্টারভিউর ডাক এলো ই-মেইলের মাধ্যমে। ইতিপূর্বে ট্রেনে করে কুয়ালালামপুর থেকে সিঙ্গাপুর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়েছে একবার। সেটাকে পুঁজি করে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে কুয়ালালামপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম রাত দশটায়। এসি বগি, নরম গদির সিট। সকাল সাতটায় সিঙ্গাপুরের ‘তাংজং পাগার’ স্টেশনে এসে নামলাম। সেখান থেকে ‘কমফোর্ট’ কোম্পানির ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলাম ‘ডোভার’ রোডে—পুরোনো কিছু বন্ধু পাঁচ বেডরুমের বিশাল এক অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকে সেখানে। দুদিন পর নির্ধারিত সময়ে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির নির্ধারিত কক্ষে এসে উপস্থিত হলাম ইন্টারভিউর জন্য—পাঁচজনের বোর্ড, ফ্যাকাল্টি ডিনও উপস্থিত। কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম আমার চায়নিজ ভাষাজ্ঞান বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্যকে প্রভাবিত করল। ইন্টারভিউ শেষে তাঁরা আমাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন। কিছুক্ষণ পর রুমে ডেকে নিয়ে হাতে অফার লেটার ধরিয়ে দিলেন। মাসখানেক পর ডোভার রোডের পাঁচ বেডরুমের সেই অ্যাপার্টমেন্টের এক বেডরুম সাবলেট নিয়ে শুরু করি আমার নতুন কর্মজীবন।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কর্মক্ষেত্রে আমার বসার জায়গা হলো মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের একটি ল্যাবে। বিশাল ল্যাবের এক কোণে নতুন কম্পিউটার ও প্রিন্টারসহ ছিমছাম একটি কিউবিকল। কাজে যোগ দেওয়ার পর জানতে পারলাম যে ‘ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার অধ্যাপক ব্রায়ান স্টোন ও তাঁরই প্রাক্তন ছাত্র নেইথান স্কট নামক দুজন একাডেমিশিয়ানও এই গবেষণাপ্রকল্পের সঙ্গে জড়িত। স্কট তাঁর পিএইচডি প্রজেক্টে তৈরি করেছেন ‘জেলিফিশ’ নামের একটি সার্ভার-বেজড ‘অ্যাডাপ্টিভ লার্নিং সিস্টেম’, যা এখানে সেকেন্ড ইয়ার ‘ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিকস’ কোর্সে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হবে। ছাত্ররা যখন ‘জেলিফিশ’ সিস্টেমে ‘লগ-ইন’ করবে, তখন তাকে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিকস’-এর একটি অঙ্ক সমাধান করতে দেওয়া হবে। সে যদি সেটা সমাধান করতে পারে তবে তাকে দেওয়া পরবর্তী অঙ্কটি হবে অধিকতর জটিল। ‘অ্যাডাপ্টিভ লার্নিং সিস্টেম’–এর মূলকথা হলো শিক্ষার্থীর মেধানুসারে তাকে ধাপে ধাপে জটিলতর সমস্যা সমাধান করতে দেওয়া হয়। অধ্যাপক ব্রায়ান স্টোন এক সেমিস্টারের জন্য ‘ভিজিটিং প্রফেসর’ হিসেবে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিকস’ কোর্স পড়াতে এলেন এবং সফলভাবে ‘জেলিফিশ’ সিস্টেম ব্যবহার করলেন। আমার কাজ ছিল ‘জেলিফিশ’ সিস্টেমকে আমাদের সার্ভারে ইনস্টল করা ও সার্বক্ষণিকভাবে তাকে চালু রাখা। এই কাজ করতে গিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে প্রফেসর স্টোনকে জানার সুযোগ হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ক্যানটিনে আমরা প্রায়ই একসঙ্গে লাঞ্চ করতাম—মাঝেমধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতেন প্রফেসর মান্নান, যিনি এই প্রজেক্টের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর।

আরও পড়ুন

আমার কাজের ব্যাপারে আমাকে সরাসরি রিপোর্ট করতে হতো অধ্যাপক মান্নানকে। আমি যেদিন প্রথম তাঁর কাছে রিপোর্ট করতে যাই, সেদিনই তিনি আমাকে ‘রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার’-এর চাকরির পাশাপাশি ‘পার্টটাইম মাস্টার্স বাই রিসার্চ’ করার জন্য উৎসাহিত করেন। আমার পদবির কারণে আমাকে কোনো টিউশন ফি দিতে হবে না। তিনি আমাকে ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক আশরাফ কাসিমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে আমি অধ্যাপক আশরাফের তত্ত্বাবধানে আবারও পোস্টগ্র্যাজুয়েশন কোর্সে ভর্তি হই। ‘জেলিফিশ’ সিস্টেম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি আমার গবেষণার প্রস্তাবনা জমা দিলাম ‘ইন্টেলিজেন্ট টিউটরিং সিস্টেম’। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দীর্ঘ তিন বছর পর আমি অবশ্য এবার আমার ডিগ্রি সফলভাবে সম্পন্ন করতে সমর্থ হই। এই তিন বছরে আমাকে চারটি কোর্সওয়ার্ক শেষ করতে হয়, দুটি জার্নাল পেপার বের করতে হয় এবং সবশেষে আমার রিসার্চের ওপর একটা ডিসারটেশন লিখে জমা দিতে হয়। আমার দীর্ঘদিনের মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় অবশেষে।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

দেশ হিসেবে সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ারই ক্ষুদ্র সংস্করণ, তবে জনসংখ্যার অনুপাতে চায়নিজদের তুলনায় মালেয়দের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। সিঙ্গাপুরের মোট জনসংখ্যার জাতিগত অনুপাত হচ্ছে চায়নিজ শতকরা ৭০ ভাগ, মালেয় ২০ ভাগ এবং ইন্ডিয়ান ও অন্যরা হচ্ছে বাকি ১০ ভাগ। ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে মালয়েশিয়ান ফেডারেশন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে স্বাধীন সিঙ্গাপুরের জন্ম হয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তির ঠিক বছরখানেক আগে জুলাই মাসের ২১ তারিখে সংঘটিত মালেয় এবং চায়নিজদের মধ্যে হয় এক নৃশংস জাতিগত দাঙ্গা। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৬৯ সালে কুয়ালালামপুরেও সংঘটিত হয় একই ধরনের দাঙ্গা, যা ছিল আরও ভয়াবহ। এই দুটি দাঙ্গা পরবর্তীকালে দেশ হিসেবে সিঙ্গাপুরের গঠন প্রক্রিয়ায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

আরও পড়ুন

হঠাৎ স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সিঙ্গাপুরের অবকাঠামো ছিল খুবই নাজুক—শিক্ষাদীক্ষায় পশ্চাৎপদ, আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যাংদের দৌরাত্ম্য, সুপেয় পানি ও বিদ্যুতের অভাব এগুলো ছিল প্রাথমিক সমস্যা। আধুনিক সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত ‘লি কুয়ান ইউ’-এর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই সমস্যাগুলো একে একে কাটিয়ে ওঠে সিঙ্গাপুর। একসময় পরিণত হয় প্রথম বিশ্বের সমমানের একটি দেশে। সিঙ্গাপুরকে গড়ে তোলার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে লি কুয়ান ইউ বেশ কিছু বই লেখেন, যার মধ্যে ‘সিঙ্গাপুর স্টোরি’ ও ‘ফ্রম থার্ড ওয়ার্ল্ড টু ফার্স্ট: সিঙ্গাপুর অ্যান্ড এশিয়ান ইকোনমিক বুম’ উল্লেখযোগ্য।

স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরপরই সিঙ্গাপুর তার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে শুরু করে, আর এ ক্ষেত্রে তারা ইসরায়েলি মিলিটারি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী নিয়ে গঠিত ‘সিঙ্গাপুর আর্মস ফোর্সেস’। এর সঙ্গে আছে ‘সিভিল ডিফেন্স ফোর্স’, যা মূলত ‘ফায়ার সার্ভিস’ ও ‘অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস’-এর সেবা প্রদান করে। সিঙ্গাপুরের প্রত্যেক পুরুষ নাগরিকের জন্য দুই বছরের সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত সবাইকে বছরে অন্তত একবার রিপোর্ট করতে হয় তার সামরিক ইউনিটে। ফলে রেগুলার ফোর্সের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের প্রতিটি পুরুষ নাগরিকই হচ্ছে একজন পূর্ণাঙ্গ ট্রেনিংপ্রাপ্ত রিজার্ভ সৈনিক। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া মালেয় পুরুষদের যে শুধু ‘সিভিল ডিফেন্স ফোর্স’-এ নিয়োগ দেওয়া হয়, সেই বিষয়টি অল্পদিনের ভেতরই আমার নজরে পড়ে।

আরও পড়ুন

জাতিগত দাঙ্গা থেকে শিক্ষা নিয়ে সিঙ্গাপুর সরকার গ্রহণ করে ‘রেসিয়াল হারমনি’ নীতি, যার মূল লক্ষ্য হলো দেশের মোট জনসংখ্যার জাতিগত আনুপাতিক হার অনুসারে সুযোগের বণ্টন। সরকারি আবাসন প্রকল্পের ফ্ল্যাট বরাদ্দ থেকে শুরু করে সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বত্রই এই নীতি অনুসরণ করা হয়। তবে আমি চাকরির ক্ষেত্রে কখনোই মালেয়দের কোটা পূরণ হতে দেখিনি। ফলে ‘রেসিয়াল হারমনি’ নীতি আমার কাছে মালয়েশিয়ায় প্রচলিত ‘ভূমিপুত্রা’ নীতিরই ‘সুগারকোটেট’ রূপ বলেই মনে হয়েছে। ‘ভূমিপুত্রা’ নীতির কারণে মালয়েশিয়ায় সরকারি চাকরিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে মালেয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়ে থাকে। (চলবে)

*আগামীকাল পড়ুন: কানাডা আগমনের নেপথ্য-কথা: (পর্ব -৪)