ফানুস

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রহিমা বিবির শীত শীত লাগছে। একটা নীরব বিলের মধ্যে সে একাকী বসে আছে। তার ছেলে অনেকক্ষণ যাবৎ তাকে এখানে বসিয়ে রেখেছে; কিন্তু এখনো আসছে না। রহিমা বিবির চোখে ছানি পড়েছে। সামনে সবকিছুই কেমন ঝাপসা ঝাপসা লাগে। তার ছোট ছেলে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। রহিমা বিবির দীর্ঘদিন যাবৎ বাতের ব্যথা। কোনো এক কবিরাজ নাকি আছে বাতের ব্যথার ভলো পথ্য দেয়। দুবলার বিলের পাশে তার গ্রাম। বিল পাড়ি দিয়ে আড়াআড়িভাবে যেতে হয়। গাড়ির পথ নয়, হাঁটাপথ। মাত্র জ্যেষ্ঠ মাস। বিলে পানি আসতে আরও দুয়েক মাস লাগবে। রহিমা বিবি শুধায়—
তয় কয় দিন পড়েই যাই। ভাদ্র–আশ্বিন মাসে নৌকায় কইরা নিয়া যাইস।
না মা, তোমার বাতের ব্যথার যেই অবস্থা, বেশি দেরি করন যাইব না। দরকার অয় আমি তোমারে কান্দে কইরা নিয়া যাইমু।

সত্যই, তুই আমারে কান্দে কইরা নিয়া যাবি। রহিমা বিবি আপ্লুত হয়। আবেগে তার চোখ ছলছল করে। মনে মনে বলে, পোলায় আমার ডাঙর অইছে। অহন সে মায়েরে কোলে নিয়া হাঁটনের শক্তি রাহে। আল্লায় তোরে বাঁচায় রাহুক বাপ আল্লায় তোরে বাঁচায় রাহুক। যেই কথা সেই কাজ। রহিমা বিবির ছেলে রহিমা বিবিকে কাঁধে নিয়ে কবিরাজবাড়ি যাচ্ছে।  

বিশাল দুবলার বিল। কোনো কূলকিনার নাই। মানুষ কদাচিৎ এ পথে আসে। রহিমা বিবি তার ছেলের কাঁধে চড়ে দুবলার বিল পার হচ্ছে। দুদিকে পাটখেত। খেতের মধ্য দিয়ে সরু পথ। পথের ধারে পাটের পাতা রহিমা বিবির গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। রহিমা বিবির স্মৃতির পাতারা জেগে ওঠে। এই দুবলার বিল দিয়েই সে পালকিতে চড়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। ছয় বেহেরা নানা ধরনের গান গাইতে গাইতে রহিমা বিবি ও তার স্বামী গনি মুন্সিকে নিয়ে পাড়ি দিচ্ছিল দুবলার বিল। পালকিতে ওঠার পর রহিমা বিবি খুব কেঁদেছিল অনেকক্ষণ। তার বাপের ভিটা ছেড়ে সে চলে যাচ্ছে। তার মনটা হু হু করে ওঠে। ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সে জানে, এ যাত্রার পরে সে হবে বাবার বাড়ির ক্ষণিকের অতিথি। এই মায়াময় গ্রাম, এই চিরচেনা পথঘাট, বাড়ির পাশে শান্ত পুকুর, পুকুরপাড়ের তালগাছ, তালগাছে  বাবুই পাখির বাসা—সবই পর হয়ে যাবে নিমেষে। সে যাচ্ছে তার স্বামীর সংসারে।

বাবার সাজানো বাগান খালি করে আরেকজনের বাগান সাজাতে। এই যে জীবনের এক অদ্ভুত রহস্যময়তা; তা রহিমা বিবিকে চিন্তার সাগরে আছড়ে ফেলে।  চিন্তার সাগরে ঢেউ ওঠে। সে ঢেউ তীব্রতায় রহিমা বিবি ছুটে চলে অজানার পথে। গনি মুন্সির সংসারে রহিমা বিবি সুখেই ছিল। মানুষটা ছিল সহজ–সরল, কর্মঠ। বছর না যেতেই রহিমা বিবির কোল আলোকিত করে এক ছেলেসন্তান আসে। তাকে নিয়ে সবার সে কী উচ্ছ্বাস। কী আদর, কী ভালোবাসা!  রহিম বিবি বলে, তরে আমি কই রাহুম বাপ? মাথায় রাহি না উকুনের ডরে, মাটিতে রাহি না পিঁপড়ার ভয়ে। এই আদর–ভালোবাসার মধ্যেই আরও দুই সন্তানের জন্ম হয়। বড় দুই ছেলে, সবার ছোট মেয়ে। রহিমা বিবি মায়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে তাদের বড় করেছে। সংসারে অভাব ছিল, অভিযোগ ছিল; কিন্তু ভালোবাসার ঘাটতি ছিল না।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

একসময় মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। ছেলেরাও ঘরে বউ আনে। রহিমা বিবির সংসার এখন কানায় কানায় পূর্ণ। কিন্তু এ পূর্ণতার মধ্যেই বাজে বিষাদের সুর। গনি মুন্সি মারা যায়। একটা মানুষ যে রহিমা বিবির কতটা অস্তিত্বজুড়ে ছিল, তা রহিমা বিবি ধীরে ধীরে টের পায়। যত দিন স্বামী বেঁচেছিল, তত দিন সংসারের পুরো লাগাম ছিল রহিমা বিবির হাতে। তাকে কেন্দ্র করেই পুরো সংসার আবর্তিত হতো। স্বামী মারা যাওয়ায় পর সুতোয় টান লাগে। ছেলে ও ছেলের বউরা সংসারের দায়িত্ব বুঝে নেয়। রহিমা বিবি চলে যায় প্রদীপের আড়ালে। দিন যায়, মাস যায়। গাছে নতুন পাতা গজায়, আবার সে পাতা বছর শেষে ঝরে যায়। বিরহী পৌষের পর বসন্ত আসে; কিন্তু রহিমা বিবির জীবনে আর বসন্ত আসে না। তার বয়স হয়েছে।

সংসারে সে এখন অচল। বিছানায় শুয়ে প্রাকৃতিক কাজ সারতে হয়। এক দিন, দুই দিন, তিন দিনের দিন ছেলে ও ছেলের বউরা অসহ্য হয়ে ওঠে। এ আপদ আর রাখা যায় না! কিন্তু তার আগে একটা বিহিত করা দরকার। স্বামীর থেকে যে সম্পত্তি রহিমা বিবি পেয়েছিল, তা এক আঁধার রাতে কুপির মৃদু আলোয় রহিমা বিবির অবচেতন হাতের টিপসহিতে দুই ভাইয়ের নামে হয়ে যায়। বোনকে করা হয় বঞ্চিত। এবার আর কোনো চিন্তা নাই। রহিমা বিবির যতটুকু প্রয়োজনীয়তা এ সংসারে ছিল, তা–ও শেষ হয়ে গেল। ছেলেরা মাকে প্রস্তাব দেয়, মেয়ের বাড়ি যাওয়ার। রহিম বিবি রাজি হয় না। সে বিড়বিড় করে বলে, স্বামীর ভিটা রাইখা মাইয়ার বাড়ি থাকুম, মাইনষে কী কইব ক? হায়, রহিমা বিবি যদি জানত, এ ভিটা এখন আর তার স্বামীর নয়! দুই ভাই সিদ্ধান্তটা তখনই নিয়ে ফেলে।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

মা, তুমি একটু বহ, আমি একটু জিরায় লই।

হ বাপ, জিরায় ল একটু। তোর কান্দো তো ব্যথা অইয়া গেছে। একটা বিন্নাসোপার পাশে একটু উঁচু জায়গায় রহিমা বিবিকে বসায়। হালকা রোদ। রহিমা বিবির গরম লাগে। একটা মেছো বাঘ ডাকছে দূরে কোথাও। রহিমা বিবি ভয় পায়। এই নীরব বিলে বাঘ যদি হামলা করে।

মা, তুমি একটু বহ আমি আইতাছি। দেহি মাউচ্ছা বাঘটা কুনমিহি ডাকে।

তুই আবার বাঘের বেশি বোগলে যাইছ না।

ঠিক আছে, মা।

তাড়াতাড়ি আহিছ, বাপ।

কোনো চিন্তা কইরো না। আমি অহনই আইসা পরুম।

অনেক সময় বয়ে যায়। ছেলে আসে না। রহিমা বিবির ভয় হয়। পোলারে আবার মেছো বাঘে ধরল না তো! রহিমা বিবির বুকটা কেঁপে ওঠে। ছেলের আসন্ন বিপদের ভাবনায় সে মুষড়ে পড়ে। এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে রাত। প্রচণ্ড ক্ষুধা, তৃষ্ণা—দুবলার বিলের একাকিত্ব আর ছেলে হারানোর শোক রহিমা বিবিকে কাতর করে তোলে। গভীর রাতের আঁধার ভেদ করে রহিমা বিবি ডুকরে কেঁদে ওঠে। একসময় তার ঘুম আসে। বিন্নাসোপার পাশে শুয়ে তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে।

আরও পড়ুন

গনি মুন্সিকে দেখে রহিমা বিবি চমকে ওঠে। তার মুখটা বড্ড শুকনো। চেহারায় চিন্তার ছাপ। মানুষটার জন্য মায়া হয় রহিমা বিবির। এই একটা মানুষের জন্য রহিমা বিবি হাজার বছর অপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু সে–ও একদিন তারে ফাঁকি দিয়া চইলা গেল।

তুমি কইতন আইলা এত দিন পর?

সে অনেক দূর। সাত আসমান পার হইয়া আইতে অয়।

অত দূর থাইকা কেন আইলা?

তোমারে দেখবার মন চাইল, তাই চইলা আইলাম।

তোমারে আমি কত ডাকি, তুমি আহো না, আইজ যে হঠাৎ আইলা?

আইতে তো মন চায়, তয় ছুটি পাওয়া যায় না। যেহানে থাকি, ওইহানেন নিয়মকানুন খুব কড়া। ভাবছি, আমার লগে আইজ তোমারে নিয়া যাইমু। তুমি যাইবা আমার লগে?

কেমনে যাই কও তো, আমার পোলায় তো পরে আমারে আইসা খুঁজব।

তোমার পোলা আর কোনো দিন আইব না রহিমা, কোনো দিন আইব না।

কেন আইব না?

সেই কথা আমারে আর জিগাইয়ো না, আমি জানি, তয় কইতে পারুম না।

আরও পড়ুন

গনি মুন্সি কেঁদে ওঠে। রহিমা বিবি এ কান্নার মানে বোঝে না। ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নঘোর কেটে বাস্তবে ফিরে আসে। তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। বিশাল দুবলার বিলে রহিমা বিবি পড়ে আছে একা। তাকে দেখার কেউ নেই।

এভাবে তিন দিন কেটে যায়। এ সময় কেউ এদিকটায় আসেনি। রহিমা বিবির অর্ধমৃত অবস্থা। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, একাকিত্ব বোধ তাকে কাবু করে ফেলেছে। সে শুধু প্রলাপ বকছে। একজন পথচারী ঘটনাক্রমে এদিকে এসেছিল। রহিমা বিবিকে এ অবস্থায় দেখে পুলিশকে জানায় বিষয়টা। পুলিশ রহিমা বিবিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রেরণ করে। পুলিশের বিশেষ তদন্ত টিম রহিমা বিবির ছেলেদের ঠিকানা উদ্ধার করে। ছেলেরা জানায়, মায়ের খবর তারা জানে না। বেশ কিছুদিন হয় মা রাগ করে বাসা থেকে চলে গেছে। এখন কিছুতেই মাকে তারা বাড়ি ওঠাতে রাজি নয়। মাকে ঘিরে তাদের সংসারে নাকি নানা অশান্তি!

রহিমা বিবির মেয়ে হাসপাতালে মাকে নিতে এসেছে। রহিমা বিবি কিছুতেই মেয়ের সঙ্গে যাবে না। তার এক কথা, পোলারা থাকতে মাইয়ার বাসায় থাকলে মাইনষে কী কইব? মেয়ে জোর করে রহিমা বিবিকে গাড়িতে ওঠায়। রহিমা বিবি বিড়বিড় করে বলে, আমি তর লগে যামু না, যামু না।

*লেখক: সুলতান মাহমুদ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, শরীয়তপুর।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন