ঘোলা জল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পদ্মা নদী। হাজারো গল্পের, হাজারো জীবনের, হাজারো কাব্যের এক জীবন্ত উপমা। পদ্মা যেন নিজেই একটি কবিতা, একটি মহাকাব্য। সে কাব্যের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ভালোবাসার ইতিহাস, ভালো লাগার ইতিহাস, আছে বিরহ-বিলাপ আর দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাস। পৃথিবীর নিষ্ঠুর সব রমণী যেমন তাদের রূপের মায়াজালে হাজারো প্রেম–উন্মাদ যুবকদের কাছে টেনে নেয় অথচ একদিন সব হিসাব–নিকাশকে পাল্টে দিয়ে দূরে সরে যায় তেমনি পদ্মাও যুগে যুগে তার দুরন্ত যৌবন দিয়ে মানুষকে কাছে টেনেছে অতঃপর তাদের হৃদয়ে এঁকে দিয়েছে অব্যক্ত যন্ত্রণার পাহাড়। সব হারিয়ে উদ্‌ভ্রান্ত যুবকেরা তবু ওই সব রমণীর পিছু নেয় তেমনি পদ্মার প্রচণ্ড ছোবলে পোর খাওয়া মানুষগুলো তাকেই আশ্রয় করে বেঁচে থাকতে চায়। পদ্মার ঘোলা জলে তারা খুঁজে ফেরে জীবনের সন্ধান।

রহিম শেখ আজও নিয়মমতো পদ্মার পাড়ে বসে আছে। পদ্মার ভাঙন আর তার জীবন যেন এক সুতোয় গেঁথে আছে। জন্মের পর থেকে এ পদ্মাকে সে চিনেছে। পদ্মার ঘোলা জলকেই পরম আদরে কাছে টেনে নিয়েছে। অথচ নিষ্ঠুর পদ্মা তাকে কখনোই কাছে টেনে নেয়নি। পদ্মাকে সে যতই ভালোবেসেছে, ততই যেন পদ্মা তার বুকে এক একটি শেল বিদ্ধ করেছে। সেই ছোটবেলাতেই সে দেখেছে তার দাদা ভাঙনের সময় মাটি চাপা পড়ে মারা গেছে, মাছ ধরতে গিয়ে প্রচণ্ড ঝড়ে পরে বাবা আর ফিরে আসেনি, চোখের সামনে পদ্মার সর্বগ্রাসী ভাঙনের সময় ছেলেকে পানিতে তলিয়ে যেতে দেখেছে। নিজের গড়া সুখের সংসার বিনা নোটিশেই পদ্মার বুকে বারবার সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। সুদীর্ঘ এ জীবনে সে দেখেছে হাজারো মানুষের বোবা কান্না, হাজারো সম্পদশালীকে দেখেছে পথের ফকির হতে, যার সবকিছুই ছিল এ সর্বগ্রাসী পদ্মার অবদান। অথচ নদীর তীরের আর সব মানুষের মতো রহিম শেখ পদ্মাকে ভালোবেসে গেছে। পদ্মা বারবার তার ঘর ভেঙেছে, ভিটাবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে। তবু সেই পদ্মার তীরেই বারবার ফিরে এসেছে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

আরও পড়ুন

রহিম শেখের ছোটবেলার গ্রামটি ছিল কল্পনার চেয়েও বেশি সুন্দর। পৃথিবীর সব সৌন্দর্যের নির্যাস যেন তাদের গ্রামে এসে মিলিত হয়েছিল। গ্রামের মানুষগুলো ছিল আরও সুন্দর। প্রকৃতির উদারতা তাদের মনমানসে একে দিয়েছিল সরলতার জলছাপ। রহিম শেখ তখন ছোট। বয়স পাঁচ কি ছয়। মাঝেমধ্যে স্কুলে যেত বলে মনে পড়ে। তাদের বাড়ির সামনে ছিল রাস্তা। রাস্তার পাশে ছিল প্রশস্ত একটি খাল। এ খালে প্রায় সারা বছরই পানি থাকত। রহিম শেখ কত দিন যে তার চাচার সঙ্গে এ খালে মাছ ধরেছে, তার ইয়ত্তা নেই। একবার মাছ ধরতে গিয়ে নৌকাডুবি হয়েছিল। রহিম শেখ তলিয়ে যাচ্ছে হাঠাৎ তার চাচা তাকে ধরে ফেল্ল। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল সেদিন। তাদের গ্রামে ছিল বিভিন্ন ধরনের ফল গাছ। সবাই সবার গাছ থেকে ফল পাড়ত। বিশেষ করে তখন প্রচুর খেজুরগাছ দেখা যেত। খেজুরের রসের ম ম সুরভিতে সারা গাঁয়ে একটা উৎসবের আমেজ তৈরি হতো। কারও বিয়ের অনুষ্ঠান হলে সারা গাঁয়ের সব মানুষ যেন উৎসবের আনন্দে একাকার হয়ে যেত। রহিম শেখের মনে আছে তখন বাঁশের চটির ওপর নানা রকম কাগজ দিয়ে বিয়ের গেট বানানো হতো। তারা একবার এক বিয়ের গেটে অনেকগুলো জোনাকি পোকা লাগিয়ে দিয়েছিল বলে মনে পড়ে। বিকেলে গ্রমে নানা রকম খেলা হতো। এই যেমন হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্দা, বরফপানি, বউআছি, চোর-পুলিশ, সাত চারা, ফুল টোক্কা ইত্যাদি। গ্রামে অনেক ছেলেমেয়ে ছিল, যারা সারা গ্রামকে মাতিয়ে রাখত। এর মধ্যে রাসেল, মামুন, মাছুম, ঝর্ণা, শিউলীর কথা রহিম শেখের বিশেষভাবে মনে পড়ে। বৃষ্টি নামতে দেরি হলে তারা কুলা নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে চাল উঠাত আর গীত গাইত—আল্লাহ মেঘ দে, পনি দে, ছায়া দেরে তুই, আল্লাহ মেঘ দে...। অনেক সময় তাদের গানের মাঝখানে প্রচণ্ড কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গিয়ে বৃষ্টি নামত। গাঁয়ের খালে যখন পানি কমে যেত, তখন সারা গ্রামবাসী মাছ ধরার উৎসবে মেতে উঠত। দিন নেই, রাত নেই সবাই মাছ ধরত। মা-চাচিরা মাছ কুটতে কুটতে আর জ্বাল দিতে দিতে সময় পার করে দিত।

আরও পড়ুন

গ্রামের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি ঘটনা রহিম শেখের মনে এক স্বর্গীয় অনুভূতি সৃষ্টি করত। জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলার রূপের ছটায় সে যেন বিভোর হয়ে থাকত। কিন্তু সময়ের হিসাব–নিকাশ কখনোই সরল পথে চলেনি। রহিম শেখদের বাড়ির পেছনেই ছিল পদ্মা নদী। তখন নদীটা এত বড় ছিল না। ছিল শান্তশিষ্ট। কিন্তু হঠাৎই একদিন সে অশান্ত হয়ে উঠল। প্রচণ্ড ভাঙনে পুরো গ্রামবাসীকে দিশাহারা করে ফেলল। ঘটনার সূত্রপাত রাসেল, মামুন, মাছুম, ঝর্ণা ও শিউলীকে নিয়ে। তারা নদীতীরে খেলাধুলা করছিল। হঠাৎই তাদেরসহ বিশাল জায়গা নিয়ে মাটি নিচে নেমে যেতে লাগল। তারা সব বুঝতে পেরে দৌড় দিয়ে ওপরে উঠতে ছিল; কিন্তু তার আগেই প্রচণ্ড বেগে তারা পদ্মার বুকে আছড়ে পড়ল। পানির প্রচণ্ড স্রোত আর পাক তাদের একটানে নদীর মাঝখানে নিয়ে ফেলল। মুহূর্তেই গ্রামে বিষয়টা ছড়িয়ে পড়ল। সবাই পাগলের মতো ছুটে এল, কিন্তু সব শেষ। সর্বগ্রাসী পদ্মার বুকে তখন পাঁচটি লাশ ভেসে উঠেছে। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গ্রামের সবচেয়ে প্রিয় ছেলেমেয়েগুলো পদ্মার বুকে আশ্রয় নিয়েছে আর পদ্মা যেন প্রচণ্ড হাসিতে তীরে দাঁড়ানো মানুষগুলোর প্রতি বিদ্রূপ করছে।

তার পরের ইতিহাস বুকে পাথর বাঁধার ইতিহাস। সর্বগ্রাসী ভাঙনের ইতিহাস। পদ্মার প্রচণ্ড উন্মত্ততা রহিম শেখের আজও মনে পড়ে। মাঠের পরে মাঠ, বাড়ির পরে বাড়ি সে ভেঙে চলছে। সে কাউকে বিশ্রাম দেয়নি, ভাবার সুযোগ দেয়নি শুধুই পেছন থেকে তাড়া করছে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো পদ্মার এ উন্মত্ত আচরণে দিশাহারা, বিধ্বস্ত। বাড়িতে ডাকাত এলে কিছু রেখে যায়; কিন্তু পদ্মা কিছুই রেখে যায়নি। সে সব কেড়ে নিয়েছে। সে কেড়েছে মানুষের সম্পদ, সুখ, একতা, বুকভরা আবেগ, মুখভরা হাসি দিয়েছে বেদনা, দীর্ঘশ্বাস আর অনিশ্চিত যাত্রার বার্তা। গাঁয়ের কত মানুষ রহিম শেখের বাবার কাছ থেকে বিদায় নিল, তার ইয়ত্তা নেই। ছমির মাঝি রহিম শেখের বাড়ি এসে হাউমাউ করে কেঁদেছিল। বুক চাপড়ে বলেছিল, ভাই রে আর দেহা অইব না, ঢাহা যাইতাছিগা। কিছু নিতে পারি নাই রে ভাই, সব গাঙের পেডে গেছে গা। বাবার হাত ধরে বলেছিল, আমাগো ভুইল্যা যাইসনারে ভাই। বাবা ছমির মাঝিকে ধরে শিশুর মতো কেঁদেছিল। এ রকম হাজারো ছমির মাঝি আজ গ্রাম থেকে বিদায় নিয়েছে, যারা গতকালও ভাবেনি এই ছায়া-সুনিবিড় সুন্দর গ্রাম ছেড়ে তাদের চলে যেতে হবে। তারা জানে না তাদের যাত্রার শেষ কোথায়, জানে যেতে হবে বহুদূরে, যেখানে পদ্মা তাদের স্বপ্নের বুকে আর দুঃস্বপ্নের ছবি আঁকার সাহস দেখাবে না।

আরও পড়ুন

গ্রামের সেই সহজ-সরল মানুষগুলো চিরদিনের জন্য রহিম শেখদের সামনে থেকে হারিয়ে গেল। শুধু মানুষই হারায়নি, হারিয়েছে সেই সুন্দর গ্রাম, প্রচণ্ড বড় বড় আম, কাঁঠাল আর জামগাছ। শিমুল, পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে কোকিলের মন ভোলানো সুর। কত চেনা মুখ যে কত সহজে অচেনা হয়ে গেল, কিন্তু অচেনা হয়নি রহিম শেখদের মতো কিছু হতভাগা, পোর খাওয়া মানুষ। তারা ঘুরেফিরে পদ্মার তীরে এসেই ঠেকেছে। একবার ভাঙনে পড়ে আবার তারা বাড়ি করেছে। আবার নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মিতালি গড়েছে, বাড়ির আঙিনায় আবার বেড়ে উঠেছে নানান ফল গাছ, আবার তারা সুখ স্বপ্নের দোলায় বিভোর হয়েছে। কিন্তু পদ্মা তাদের সে সুখ সইবে কেন? সে শুধু তাড়া করে ফিরেছে। সে তালিকায় রহিম শেখ নিজেকে বরাবরই প্রথম দিকে দেখে এসেছে।

ভাঙাগড়ার হিসাব মেলাতে আজও রহিম শেখ পদ্মার পাড়ে এসে বসে থাকে। পদ্মার ঘোলা জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু পদ্মার ঘোলা জল থেমে থাকে না। সে নদীতীরে বারবার আছড়ে পড়ে। রহিম শেখ যেখানে বসেছে, তার সামনে আরেক দলা মাটি চিরকালের জন্য বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু বিলীন হয় না রহিম শেখদের মতো মানুষদের কান্নার ইতিহাস, বুক ভাঙা হাহাকারের ইতিহাস। তারা নদীভাঙা মানুষদের সার্থক উপমা হয়ে হয়ে বারবার নদীতীরে ফিরে আসে।

* লেখক: সুলতান মাহমুদ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, শরীয়তপুর

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]