নইরার মিষ্টি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নইরা বাজারের পূব মাথায় বিশাল বটগাছ। বটগাছের ছায়া পড়েছে নদীর গায়। বিশাল নদী। পদ্মা। নদীর কিনারে একটা স্টিমার বাঁধা। স্টিমার যাবে কলকাতায়। মাঝে এখানে কয়েক ঘণ্টার যাত্রাবিরতি। স্টিমার ঘিরে অনেক ভাসমান ব্যবসায়ী ভিড় জমিয়েছেন। মিরছিকানি আখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক আখচাষি। তাঁর হাতে একটা কাচি। এ কাচিকে বলা হয় বগা কাচি। তিনি স্টিমারের ক্রেতাদের কাছে আখ বিক্রি করছেন। প্রতি আখ চার আনা। শুকনা মরিচ, কলমিশাক, মাছসহ নানা পণ্য নিয়ে বিক্রেতারা এসেছেন। চরের লাল মরিচ এখানে খুব বিখ্যাত। পদ্মার ইলিশের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। এখানকার নদীর ইলিশের স্বাদই আলাদা। ইলিশ মাছে প্রচুর তেল হয়। মাছ কেটে হালকা জ্বাল দিলেই ভাতের সঙ্গে খাওয়া যায়। ইলিশের ঘ্রাণে রসনা বিলাসে অন্য এক মাত্রা যোগ হয়। এসবের মধ্য দিয়ে স্টিমার থেকে এক ক্রেতা টুপ করে নইরা বাজারে ঢুকে গেলেন। নইরার রসগোল্লা ও সন্দেশের কথা তিনি অনেক শুনেছেন।

কলকাতার ঘরে ঘরে নইরার রসগোল্লা ও সন্দেশের সুনাম। এ জিনিস না চেখে তিনি যেতে চাচ্ছেন না। তিনি নইরা বাজারের বিখ্যাত মিষ্টির দোকান হরিপদ মিষ্টি ভান্ডারে যান। থরে থরে সন্দেশ সাজানো রয়েছে দোকানে। দোকানের কর্মচারীরা ক্রমাগত সন্দেশ তৈরি করছেন। কলকাতার বাবুকে দেখে হরিপদ খুব তাজিমের সঙ্গে তাঁকে বসতে দেন। একটা প্লেটে দুটি গরম সন্দেশ এগিয়ে দেন। সন্দেশের ঘ্রাণই আলাদা। সন্দেশের মাঝখানে চমৎকারভাবে একটা কিশমিশ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সন্দেশের টুকরা মুখে দিয়ে বাবু যেন অমৃতের স্বাদ পান। সন্দেশ পর্ব শেষে কয়েকটি রসগোল্লাও চালান দেন পেটে। আহ্‌ নইরার সন্দেশ আর রসগোল্লা খেয়ে আমার জীবন ধন্য। বাবু ২০ কেজি সন্দেশ ও ২০ কেজি রসগোল্লা নিয়ে স্টিমারের পানে ছোটে। কলকাতায় আত্মীয়স্বজনকে এবার তিনি বিশাল সারপ্রাইজ দেবেন।

হরিপদের দোকানে ব্যস্ততা লেগেই থাকে। নিত্য এ ব্যস্ততা তাঁকে ক্লান্ত করে না। তাঁর দোকানের মিষ্টি খেয়ে ক্রেতাদের তৃপ্তি দেখলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। হরিপদ এ ব্যবসা পৈতৃক সূত্রে পেয়েছেন। এটা তাঁদের আদি ব্যবসা। বিশেষ করে সন্দেশ বানানোতে হরিপদ খুব সিদ্ধহস্ত। গুরুর খাঁটি দুধ হতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছানা তৈরি করা হয়। সেই ছানা থেকে তৈরি হয় সন্দেশ। সন্দেশের ঘ্রাণে পুরো দোকানে ছড়িয়ে থাকে। পুরো দেশে আজ নইরার সন্দেশের সুনাম। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে কলকাতার বাবুদের মুখে মুখে এ সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। এ যে কত বড় গৌরবের, তা ভাবতেই হরিপদের চোখেমুখে এক তৃপ্তির আভা দেখা যায়। এ অঞ্চলের মুক্তারের চর, চরআত্রা, নওপাড়া হতে প্রচুর পরিমাণ খাঁটি দুধ আসে নইরা বাজারে। সেই দুধ হতে তৈরি হয় এ মিষ্টি। এ অঞ্চলের জন্য এটা এক বিশাল সম্ভাবনাময় শিল্প।

আরও পড়ুন

অনেক রাত। ক্রেতার সমাগম কমে এসেছে। দোকান বন্ধ করার সময় আগত। হরিপদ প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময় এক ক্রেতা এলো। গায়ে লম্বা আলখেল্লা। তাঁর পোশাক ধবধবে সাদা। মুখটা খুব কালো। এত কালো যে রাতের হ্যাজাকের আলোতেও তা স্পষ্ট বোঝা যায় না।

হরিপদ ভাই কি চইলা যাইতাছেন? একটা গম্ভীর কণ্ঠ মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে।

জি ভাই। হরিপদের ছোট্ট জবাব।

আমি তো ভাই সেই সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হইয়া আপনার দোকানে আসলাম। আমার রাজ্যে তো আপনার মিষ্টির অনেক সুনাম। হরিপদ ভাবে লোকটা হয়তো এ মাঝ রাতে ঠাট্টা করছে।

আচ্ছা মিষ্টি খাবেন তো, তাহলে বসেন। আমার কষ্ট হবে না। ক্রেতাদের মিষ্টি খাওয়ানোই তো আমার কাজ।

ঠিক আছে আনেন আপনার মিষ্টি।

একটা প্লেটে লোকটাকে দুটি সন্দেশ দেওয়া হয়। দুটি শেষ হতে আরও চান। এভাবে আরও, এরপর আরও। তাঁর খাওয়া চলছেই। হরিপদ তাজ্জব হয়ে যান লোকটার খাওয়া দেখে। এমন মানুষ তো সে আগে দেখে নাই। একটা মানুষ কীভাবে এত মিষ্টি খেতে পারেন! হরিপদ ঘেমে উঠেছেন। দেখতে দেখতে লোকটা এক মণ সন্দেশ সাবাড় করে ফেলেন! এ লোক কি মানুষ না রাক্ষস, হরিপদ ভেবে পান না! সন্দেশ খাওয়া শেষ, এবার তিনি রসগোল্লার দিকে দৃষ্টি দেন। এক বসাতেই সে দোকানের সব মিষ্টি সাবাড় করেন। হরিপদের অবস্থা তখন দেখার মতো। তিনি বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছেন।

হরিপদ ভাই আর নাই?

না ভাই, সব তো শেষ।

আরও বানানো উচিত ছিল, এত কম মিষ্টি বানালে হয়?

হরিপদ কী বলবেন, বুঝতে পারছেন না।

হরিপদ, ভাই আপনি ভাবতাছেন, এই লোক মানুষ না অন্যকিছু। আপনি ঠিকই ধরেছেন আমি মানুষ না, আমি একজন জিন। কোহেকাফ নগরের জিন।

জিন!

হুম। সাধারণ জিন নয়। কোহেকাফ নগরের বাদশা। আমার রাজ্যের প্রজাদের কাছে আপনার মিষ্টির অনেক সুনাম, তাই নিজে আজ পরখ করতে এলাম। হরিপদ ভয় পেয়েছেন ভেতরে–ভেতরে, কিন্তু বাইরে প্রকাশ করছেন না।

আরও পড়ুন

হরিপদ ভাই ভয় পাবেন না। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না। আপনি একজন সম্মানিত ইনসান। আপনার দোকানের মিষ্টি খেয়ে আজ আমি ধন্য। আপনার মিষ্টির দাম হিসেবে কিছু স্বর্ণমুদ্রা এনেছি বলেই একটি থলি এগিয়ে দেয় হরিপদের হাতে। আমি আবার আসব। তবে একা নয় কোহেকাফ নগরের রাণীও থাকবে আমার সঙ্গে। আপনার মিষ্টি খাওয়ার তার অনেক সখ। বিবির সখ পূরণ করা দরকার, কী বলেন?

হরিপদ মাথা নাড়ান।

গেলাম ভাইজান। আপনার দোকানের মিষ্টি খেয়ে তৃপ্তি পেলাম। ভালো থাকবেন। হরিপদ প্রণাম জানান।

আবার আসবেন।

জি, অবশ্যই।

হরিপদের রাতে আর বাসায় যাওয়া হবে না। দোকানের সব মিষ্টি শেষ। সকালে ক্রেতারা মিষ্টি না পেয়ে মন খারাপ করবেন—এ দৃশ্য তিনি দেখতে চান না। হ্যাজাকের আলো জেলে তিনি পুরোদমে নেমে পড়েন মিষ্টি বানানোর কাজে।

*লেখক: সুলতান মাহমুদ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, শরীয়তপুর

নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]