গ্রিনকার্ড
১.
কনেপক্ষের বিয়ের ব্যাপারে এ মুহূর্তে কোনো প্রস্তুতি না থাকলেও বরপক্ষের অনুরোধে পিছু হটা সম্ভব হয়নি। কনেপক্ষের যুক্তি ছিল মেয়ের সামনে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা, এ সময়ে বিয়ের ঝামেলায় তার পড়াশোনার ক্ষতি হতে পারে। বরপক্ষ কোনো যুক্তি মানতে নারাজ। মেয়েপক্ষও অবশ্য পাত্র হাত ছাড়া করতে চায়নি। তা ছাড়া আজকাল যে যুগ পড়েছে, ভালো পাত্র খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। ছেলে দেখতে সুন্দর, বছরখানেক হলো ইতালি আছে। এখনো গ্রিনকার্ড পায়নি, তবে সেটা নিয়ে অতটা ভাবার কিছু নেই। পায়নি তো পেয়ে যাবে। ছেলে যেহেতু দেশের বাইরে, তাই বিয়ের কাজটা মোবাইলের মাধ্যমেই সারতে হবে। মেয়েপক্ষের দু–একজন অবশ্য আমতা আমতা করছিল। আরে এসব তো এখন হামেশাই হচ্ছে, এটা কোনো ব্যাপারই না। শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষই শুভদিনে শুভ কাজের অপেক্ষায় দিন গুনতে লাগল।
হাস্যোজ্জ্বল একটা ছবি। নীলা অপলক তাকিয়ে আছে। বাইরে বসন্তের কোকিলটা অবিরাম ডেকে চলছে। হে বসন্তের কোকিল, তুমি কোন নতুন বসন্তের গান নিয়ে আমার জীবনে এলে। মনে মনে হাসে নীলা। আচ্ছা, ছবি কি কথা বলে? হয়তো বলে, কিন্তু সে কথা বোঝার মতো উপলব্ধি শক্তি সবার থাকে না। সে কথা লুকানো থাকে সাগরের গভীরতম স্থানে, যেখানে পৃথিবীর আলো পৌঁছায় না, ঢেউয়ের তীব্রতা আঘাত হানে না, সেখানে কোনো এক সোনালি ঝিনুকের মাঝে ঘুমন্ত মুক্তা হয়ে। যে সাহস করে, সে মুক্তার ঘুম ভাঙাতে সেই পারে প্রকৃতির নীরব মনের গভীরতম অনুভূতির ভাষা বুঝতে। ওই যে রাতের আকাশের শুকতারাটা সারা রাত একা একা জ্বলে, সাথি হারা পাপিয়া দূর বনে বেদনায় কাঁদে, পাইনবনের মৌনতায় বীণার বাণী ওঠে। পথিকের ব্যস্ত পদভারে কখনো হয়তো প্রকৃতির এ গোপন কথা শোনার সময় হয় না, কিন্তু প্রকৃতি প্রতিনিয়তই তার কথা প্রকাশ করে যাচ্ছে। নীলা প্রকৃতির এ নীরব বাণীর মতোই তার সামনে রাখা ছবিটার নীরব মনের ভাষা খোঁজার চেষ্টা করছে।
নীলা অবাক হয়ে অনুভব করে নির্বাক ছবির মুখে ভালোবাসার গান। যার সঙ্গে কোনো দিন দেখা হয়নি, কথা হয়নি, হাত ধরে দুদণ্ড পথচলা হয়নি, সে–ই কিনা আজ নীলার জীবনে প্রেমের ডালি নিয়ে হাজির হয়েছে। যে ফুল নীলা দেখেনি, যার ঘ্রাণে মন মাতেনি, সেই অদেখা ফুল অদেখা প্রেমের মালা গেঁথে নীলার গলায় জড়িয়ে দিয়েছে এক অমোচনীয় প্রেমের বন্ধন। প্রেম কি তবে এভাবেই ধরা দেয় কোনো এক গোপন পথের গোপন কুঠুরি বেয়ে। এ যেন এক বিশাল রংধনু! সাত রঙের ছোঁয়ায় সমুদ্রের সঙ্গে আকাশের মেলবন্ধন, যেখানে দূরত্বের প্রশ্ন অবান্তর। নীলা প্রেমাস্পদ দৃষ্টিতে তার আগত প্রেমদূতের ছবির দিকে তাকায়। অভিমান ভরা চোখে প্রশ্নের মালা গাঁথে। আমি যেমন সাত সমুদ্র তেরো নদীর ধারে কোনো এক অজপাড়াগাঁয়ে তোমার প্রেমের সাগরে ডুবে ডুবে দিশাহারা, তুমি কি তেমনি ভাবছ আমায়? নাকি ভূমধ্যসাগরের লোনাজল পেরিয়ে ইতালির কোনো এক ব্যস্ত শহরে তুমি মিশে গেছ জীবনের ব্যস্ততায়, যেখানে অবলা নারীর প্রেম মিছেই কড়া নাড়ে বদ্ধ দরজার কিনারে। যে প্রেম কেড়েছে আমার ঘুম নগরের চাবি, তালাবদ্ধ প্রেমের ঘরেতে শুধুই তোমার ছবি, সে প্রেম কি তোমার মনকে এতটুকুও ছুঁয়ে যায় নাকি প্রেম নামের অলীক কল্পনা তোমায় বারবার হাসায়। নীলা ভাবে, ভাবনার নদীতে জাল ফেলে। কখনো দূর্বাঘাস, কখনো শূন্য জাল আবার কখনো রুপালি মাছ! ভাবনার নদীতে ঝড় ওঠে, ঢেউ জাগে, সে ঢেউ নীলাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, তা তার জানা নেই।
বিকেলে ম্লান আলোটুকুও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। টকটকে লাল সূর্যটা ডুব দিয়েছে দূর পদ্মার বুকে। কাকের কালো পালকের মতো ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। নীলার ঘরে জ্বলে উঠছে সন্ধ্যা প্রদীপ। কিছুক্ষণ আগে কাঁচা হলুদ গায়ে মেখে গোসল করেছে সে। তার দুধে আলতা রঙের সঙ্গে কাঁচা হলুদ মিশে যেন অপরূপ এক রঙের সৃষ্টি হয়েছে। নতুন পাড়ের শাড়িটা পরে নীলা বসে আছে সুদূর ইথারে ভেসে আসা কোনো বার্তার অপেক্ষায়। এই সন্ধ্যা মালতিতে হাজার মাইলের ব্যবধান ঘুচে হবে দুটি মনের সঙ্গে মনের বিনিময়, কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠের বিনিময়। মালাবদল হবে না, কিন্তু কণ্ঠের বদল হয়ে যাবে নীরবেই! দূর থেকে ভেসে আসা একটা বুনোফুলের গন্ধ নীলাকে মাতাল করে তুলছে। একটা অচেনা পাখি জানালার কার্নিশে বসে মিষ্টি সুরে ডেকে যাচ্ছে। নীলা মনে মনে হাসে। আজ নীলার বিয়ে অথচ সানাইয়ের সুর নেই, অহেতুক ব্যস্ততা নেই, কোনো সাজসজ্জা নেই; কিন্তু প্রকৃতি যেন তার মতো করে নীলার বিয়ের আনন্দে নিজেকে সাজিয়েছে।
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে সময়ের কাঁটাকে বয়ে নিয়ে চলছে। আর কিছুক্ষণ পরেই টেলিফোন করবে সুদূর ইতালিতে বসে থাকা নীলার হবু বর। নীলার হৃৎস্পন্দন যেন থেমে গেছে। একটা কঠিন সিদ্ধান্ত, সারা জীবনের ব্যাপারটা কত সহজেই টেলিফোনের শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে তাকে নিতে হবে। অথচ যাকে সে চোখে দেখিনি, যার চোখে চোখ পড়েনি, তাকেই অদেখা মনের বন্ধনে বাঁধতে হবে। দূর নদীতে কে যেন গেয়ে যাচ্ছে—যে যারে ভালোবাসে সে তারে পায় না...। বড় কঠিন গান! নীলা তো ভালোবাসারই সুযোগ পায়নি, সেখানে পাওয়া না পাওয়ার প্রশ্ন তো অনেক দূরের ব্যাপার। তবু আনমনা হয়ে যায় সে। সত্যিই কি তাই? তবে এ পৃথিবীতে ভালোবাসাবাসি নিয়ে কেন এত হাহাকার? কেন এত গল্প কবিতা গান? এসব উত্তর নীলার জানা নেই, কারণ যেখানে জীবনের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নই বড় ব্যাপার, সেখানে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় কই? নীলা কোথাও পড়েছিল, যখন অভাব আসে তখন ভালোবাসা পেছনের দরজা দিয়ে পালায়। সে কারণেই হয়তো নীলাকে ভালোবাসার মিশ্রণে আর্থিক নিরাপত্তার দিকেও লক্ষ রাখতে হচ্ছে। নীলার হাসি পায় ভালোবাসার এ নবতর ভাবনার আড়ালে। হঠাৎ মায়ের ডাকে ঘোর কাটে তার। ইতালি থেকে ফোন এসেছে। ধীরপায়ে এগিয়ে যায় নীলা।
গভীর রাত। নিস্তব্ধ নীরব চারদিক। নীলা বসে আছে এক টুকরো অনুভূতির পালকের ওপরে! কিছুক্ষণ আগে টেলিফোনের মাধ্যমে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে তার। খুব অল্প সময়, ছোট্ট একটি শব্দ ‘কবুল’। অথচ এ সামান্য শব্দটি কিনা তার জীবনে এক অসামান্য শব্দ হয়ে ধরা দিয়েছে। সে এখন আর বাবার ছোট্ট খুকি নয়, মায়ের দুষ্টু মেয়ে নয় কিংবা ভাইয়ের লক্ষ্মী বোন নয়, সে এখন একজন পরিপূর্ণ রমণী। এই বিশ্বসংসারে পূর্ণ দায়িত্বশীলা! অথচ কিছুক্ষণ আগেও সে ছিল এসব হিসাব–নিকাশের ঊর্ধ্বে।
সবকিছু ছাপিয়ে বেদনায় নীলার মুখ নীল হয়ে গেছে। সব মেয়ের জীবনেই একটি স্বপ্ন থাকে, জীবনে আগত নতুন মানুষের সঙ্গে ফুলশয্যায় বসে গল্প বোনার কল্প থাকে; কিন্তু নীলার জীবনে এ স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের বারতা হয়ে এসেছে। এই ফুলশয্যা, পাখির গান অজানা ফুলের গন্ধ সবকিছু অর্থহীন মনে হয় তার কাছে।
নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
মোবাইলটা বেজে ওঠে। একটা অপরিচিত নাম্বার। নীলা অবাক হয়। এত রাতে কে হতে পারে। কিছুটা দ্বিধা, কিছুটা সংশয় নিয়ে নীলা ফোনটা ধরে।
—এ মিষ্টি রাতে কে তুমি সুন্দরী ভাবছ আমায়?
নীলা বুঝতে পারে এ কার ফোন। লজ্জা রাঙা মিষ্টি হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটে।
—মিষ্টি রাত না ছাই, আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্বিষহ রাত। আর কারও কথা ভাবতে আমার বয়েই গেছে। ওসব ভাবাভাবির মাঝে আমি নেই। আমার এখন ঘুম পাচ্ছে।
—জীবনটা তো ঘুমিয়েই কাটালে, আজ কিছুটা জাগলে ক্ষতি কি?
—আমি যেমন ছিলাম তেমনি থাকব। আমি নিশীথ রাতের পাখি নই যে রাত জেগে গান শোনাব।
—অমন অভিমানের মালা গেঁথে কী লাভ বল? তার চেয়ে বরং ক্ষণিক হারাই অচেনা পথে।
—ঠিক আছে মালা ছিঁড়ে ফেললাম। কী বলবে বল?
—আজ আকাশে চাঁদ উঠেছে তাই না?
—হুম, স্বচ্ছ গোলগাল রুপালি চাঁদ
—তোমার জানালাটা খোলা তাই না?
—হুম।
—জানালার ফাঁক গলে তোমার ঘরটা ভরে গেছে জ্যোৎস্নার আলোতে। রুপালি চাঁদ নীল জ্যোৎস্নায় তোমাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। অপরূপা চাঁদ তোমার অবর্ণনীয় সুন্দর মুখে এঁকে দিয়েছে ভালোবাসার জলছাপ। তোমার অদ্ভুত সুন্দর মুখে চাঁদের আলো যেন ফুলের গায়ে মূর্ছা গিয়ে লজ্জা পাচ্ছে। যেন বলতে চাচ্ছে হে মানবী তোমার সৌন্দর্য আজ চাঁদের সব অহংকার ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। তখন আমি সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে লোনা বাতাসের সঙ্গে উড়ে উড়ে তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি অতিথির বেশে। তুমি কি আমায় সঙ্গে নেবে? নাকি আমি হারিয়ে যাব ওই দূর নক্ষত্রের সঙ্গে, যেখান থেকে আর ফিরে আসার পথ নেই।
—ওগো নীরব অতিথি, আমার সাধ্য কি তোমাকে ফিরিয়ে দিই। তবে কবির কবিতা কি এ অবলা নারীর প্রেমের আগুন নেভাতে পারবে? কারণ, সে তো তোমার কবিতার কথা মালার মতো ছন্দময় নয়, এতটা শক্তিও তার নেই। সে চায় একটি ছোট্ট বাবুই পাখির বাসা, যেখানে ঝড় হবে, বৃষ্টি হবে, মান থাকবে, অভিমান থাকবে, থাকবে আশা–নিরাশার দোলাচল আর থাকবে দুটি পাখি, থাকবে ছোট্ট বুকের ছোট ছোট স্বপ্ন।
—সে স্বপ্ন ছোঁয়ার প্রত্যাশা রইল। যেথায় থাকবে অর্ধেক মানবী আর অর্ধেক কল্পনায় মেশানো তুমি।
—কল্পনা তো থাকল কিন্তু মানবীর কী হবে? সেকি পারবে বাস্তবতার এ দুঃসহ ভার বইতে?
—জীবনের প্রয়োজনে সবটাই পারতে হয়। আচ্ছা আজ না হয় থাক ওসব কথা। আজ এ স্মরণীয় রাতে আমি তোমায় দিলাম ভুবন ভোলা হাসি। এবার তুমি আমায় কি দেবে বলো?
হঠাৎ নীলা ফুঁফিয়ে কেঁদে ওঠে। গলাটা ধরে আসে তার।
—বুঝেছি নীলা তুমি কান্নার মধ্য দিয়েই গভীরতম ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে চাচ্ছ। আমি আমার জবাব পেয়ে গেছি। অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন ঘুমাও। আল্লাহ হাফেজ।
একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙল নীলার। ততক্ষণে মোরগের ডাক থেমে গেছে। জানা–অজানা পাখির মিষ্টি ডাক থেমে থেমে নীলার কানে অনুরণিত হচ্ছে। একটি টুনটুনি কোথা থেকে নীলার জানালার কার্নিশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে পিটপিট করে নীলার পানে তাকাচ্ছে। পাখিটার তাকানোর অদ্ভুত ভঙ্গি দেখে নীলা ফিক করে হেসে ওঠে। নীলার হাসিতে পাখিটা বোধ হয় লজ্জা পেল। মুর্হূতেই ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল সে। পাখিরা এমনি। ধরা দেয় না। ক্ষণিকের মায়া বাড়িয়ে পালিয়ে যায় দূর আকাশে। ভাবতেই কিছুটা আনমনা হয়ে যায় সে। সূর্যের স্নিগ্ধ আলো নীলার জানালায় এসে পড়েছে। নীলার বাসন্তী শাড়ি আর সূর্যের লালিমা মিশে যেন একাকার হয়ে গেছে।
আজকের সকালটা যেন একটু অন্য রূপে ধরা দিয়েছে তার জীবনে। বিয়ের পরে প্রথম সকাল, প্রথম ভোর, নতুন যাত্রার সূচনা। কোনো হইচই নেই, বাড়িভর্তি লোক নেই, নতুন বউ দেখার আকুতি নেই। অথচ আজ এমনটিই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি, কেউ আসেনি, কথা বলেনি, কৌতূহলভরা দৃষ্টিতে তাকায়নি। সে নিয়ে তার মনে কোনো খেদ নেই। সব পাখি সব সময় গায় না, সব ফুল সব সময় ফোটে না। কিছু পাখি অবেলায় গায়, কিছু ফুল অবেলায় ফোটে। নীলা না হয় তাদেরই একজন হয়ে রইল! সে না হয় তার জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণ একটু ভিন্নভাবে শুরু করল, একটু ভিন্ন আলোয় আলোকিত হলো। ওই তো জানালার পাশে বনফুলগুলো কী চমৎকারভাবে ফুটে আছে। নীলার এ শুভলগ্নে নতুনভাবে নিজেদের সাজিয়েছে। নীলা সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
২.
কথায় আছে, জীবন থেমে থাকে না। সে বয়ে যায় তার আপন গতিতে। সময় এবং স্রোত কারও অপেক্ষায় পড়ে থাকে না। কারও আবেগের মায়াজাল, প্রেমের পিছুটান, ভালোবাসার আহ্বান তার চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। সে চলে যায়। এ সত্যিটা নীলার জীবনে অনেক বড় হয়ে ধরা দিয়েছে। দেখতে দেখতে নীলার জীবনের আটটি বছর কেটে গেছে; কিন্তু স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কটা তার ইথারেই রয়ে গেছে। কারণ, তার স্বামী এখনো গ্রিনকার্ড পায়নি। চাইলে যেকোনো সময় সে চলে আসতে পারে; তবে তারপর আবার ইতালিতে ফিরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দেরি হলেও গ্রিনকার্ড নিয়েই সে আসতে চায়। বাস্তবতার কাছে নীলা নামক এক অবলা নারী তাই হার মেনেছে। জীবনের সোনালি সময়গুলো হারিয়ে গেছে। বিয়ের পরে নীলা মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। একটি বেসরকারি স্কুলে চাকরিতেও জয়েন করেছিল; কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ির আপত্তিতে সে চাকরিটাও করা হয়ে ওঠেনি। নীলা নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে। পরিচিত সমাজ, বন্ধু, স্বজন সবার কাছ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন দিয়েছে। নীলার মনে হয় এই সমাজের মানুষগুলো অবিরাম তার পানে তাকিয়ে আছে। সে যেন একটি বড় মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। মাঠের চারপাশে হাজারো মানুষ। তারা নীলার প্রতিটি স্পন্দন, প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছে। তারা যেন বলছে—মেয়েটি অপয়া, অলুক্ষণে, অভাগা। নীলা কানে আঙুল দিয়ে কথাগুলো না শোনার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় মুখ গুঁজে বসে আছে।
গোধূলি বিকেল। নীলাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কীর্তিনাশা নদীর তীরে বসে আছে সে। নদীর পাড়ে কিছু অতিথি পাখি দেখা যায়। ওরা এসেছে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে। নীলা মুগ্ধতার আবেশে পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। এ নদী নিয়ে একটি চমৎকার কল্পকাহিনি আছে। নীলা তার দাদির কাছে শোনেছে। কথিত আছে, একসময় কীর্তিনাশা ছিল পদ্মার তুলনায় স্রোতস্বিনী নদী। তো পদ্মা ছিল মেয়ে আর কীর্তিনাশা ছিল ছেলে। একসময় কীর্তিনাশা চাইল যে পদ্মাকে সে বিয়ে করবে; অন্যদিকে পদ্মা চাচ্ছিল না কীর্তিনাশার সঙ্গে তার বিয়ে হোক। কিন্তু কীর্তিনাশাকে সে সরাসরি ফিরিয়েও দিতে পারছিল না। একদিন বিয়ে করার উদ্দেশ্যে কীর্তিনাশা গেল পদ্মার বাড়িতে। ওদিকে পদ্মা তার মায়ের কাপড় পরে বসে রইল। কীর্তিনাশা যখন পদ্মার বাড়ি পৌঁছাল, তখন পদ্মাকে তার মায়ের কাপড় পরা অবস্থায় চিনতে না পেরে কীর্তিনাশা ভুলে পদ্মাকে বলল, মা কেমন আছেন? পদ্মা তখন মাথার কাপড় সরিয়ে বলল, এই তো বাবা ভালো আছি। সেই থেকে পদ্মা হয়ে গেল তেজস্বিনী নদী; অন্যদিকে কীর্তিনাশা হয়ে গেল ক্ষীণাঙ্গিনী নদী। নীলার হাসি পায়, কত অদ্ভুত গল্পই–না পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। নীলা নিজেকেও সে অদ্ভুত গল্পের নায়িকা ভাবে। চেনা নেই, জানা নেই, টেলিফোনে বিয়ে তারপর স্বামীকে ফিরে পাওয়ার দীর্ঘ প্রতীক্ষা। সে জানে না এ প্রতীক্ষার শেষ কোথায়? কত দিন কেটে গেছে নীরবে, কত রাত ভেসে গেছে আঁখি জলে। অথচ এমনটা না হলেও তো পারত। কী নেই তার। নীলা শিক্ষিতা, যথেষ্ট সুন্দরীও বটে। বিয়ের বাজারে তার জন্য পাত্রের অভাব হতো না। একজন শিক্ষিত গরিব ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হতে পারত। যে হয়তো ব্যাগভর্তি বাজার করতে পারত না, তবে ডাল–ভাত তো খাওয়াতে পারত।
শীতের সকালগুলো দিন দিন কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সে হারিয়ে ফেলছে তার পুরোনো জৌলুশ, রং, রূপ। শীতের সকাল আছে কিন্তু খেজুরের রস নেই, কুয়াশা ভেদ করে আসা এক চিলতে সোনালি আলোর অপেক্ষায় ব্যস্ততা নেই, খেজুরের গুড়ের পিঠা খাওয়ার আকুলতা নেই, রসের নাশতা খাওয়ার ব্যাকুলতা নেই। যান্ত্রিক নিয়মে শীতের সকালগুলো যেন কালের গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। নীরব অভিমানে সবার অগোচরে! এ বিষয়টা হয়তো কেউ তেমন করে ভাবে না তবে নীলা ভাবে। তার অখণ্ড অবসরে যেসব নিভৃত ভাবনা বাসা বাঁধে, সেখানে শীতের সকালও আছে। কুয়াশা ভেজা ভোরে সে নদীতীরে এসে দাঁড়ায়। একটি ছোট্ট নৌকা ঘাটে বাঁধা। কুয়াশার আড়ালে নৌকাটা অস্পষ্ট মনে হয়। স্থির, নীরব যেন তুলির আঁচড়ে আঁকা ছবি।
কোকিলটা একনাগাড়ে ডেকে ডেকে বসন্তের আগমনী গান শুনিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে গানের প্রতি নীলার কোনো আগ্রহ নেই। কারণ, গত ১০টি বছর কোনো বসন্তই তার কাছে বসন্ত হয়ে ধরা দেয়নি, মনেতে লাগেনি কোনো বাসন্তি রং! কিন্তু আজ হঠাৎ নীলার এত আনমনা লাগছে কেন? শিমুলের ফুলগুলো এত লাল দেখাচ্ছে কেন? প্রজাপতিরা এমন করে উড়ছে কেন? তবে কি নীলার জীবনের বাসন্তি ফুল ফুটতে যাচ্ছে? অবসান হতে যাচ্ছে গত ১০ বছরের গ্লানিময় জীবনের? হঠাৎ ফোনটি বেজে ওঠে। নীলার স্বামীর ফোন। কাঁপা কাঁপা হাতে নীলা ফোনটা রিসিভ করে? ওপাশে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ—নীলা, আমি গ্রিনকার্ড পেয়েছি নীলা! আমাদের দুঃখের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। আমি আগামী সপ্তাহেই বাড়ি আসছি। আরও কী সব বল যাচ্ছিল সে; কিন্তু কোনো কথাই তার কানে যায় না। তার মনে শুধু একটা কথাই দোল খাচ্ছে—নীলা, আমি গ্রিনকার্ড পেয়েছি নীলা। নীলার হাত থেকে মোবাইলটি খসে পড়ে। তার দুচোখে অশ্রুর ফোয়ারা। দখিনা বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে বিগত জীবনের দুঃখ-কষ্ট।
শাঁ শাঁ করে এগিয়ে চলছে মাইক্রোবাসটি। গন্তব্য বিমানবন্দর। নীলা মাইক্রোবাসের সামনের সিটে একপাশে বসেছে। তার চোখেমুখে অদ্ভুত লাবণ্যতা। মা–বাবা পেছনের সিটে বসেছে। মেয়ের এ শুভক্ষণে তাদের মনেও বাড়তি আমেজ। নীলার ছোট ভাই বসেছে ড্রাইভারের সঙ্গে। অপেক্ষার প্রহর বড় কষ্টের। এই ছোট্ট পথটুকুও যেন শেষ হতে চায় না। আচ্ছা প্রথম দেখায় নীলা তার স্বামীকে কী বলবে? সেকি গাল ফুলিয়ে টোল উঁচিয়ে বসে থাকবে? তখন তার স্বামী এসে মান ভাঙানোর গল্প শোনাবে। বলবে—হে অভিমানী রাজকন্যা, আমি হাজার পথের বাধা টপকে তোমার কাছে এলাম আর তুমি কিনা অভিমানের ডালা সাজিয়ে বসে আছ? নাকি সে কিছুই করবে না, শুধু চোখ দিয়ে বইয়ে দেবে শ্রাবণের কান্না। তখন তার স্বামী নরম হাতের ছোঁয়ায় তার অশ্রু মুছে দিয়ে বলবে—আর শ্রাবণ নয়, এখন বসন্ত। সব কষ্ট ভুলে গিয়ে এবার হাসো প্লিজ। এফএম রেডিওতে একটা গান বাজছে—তুমি আসবে বলে, ভালোবাসবে বলে, কাছে ডাকবে বলে ওগো মোরে...আজ চম্পা-বকুল দেখ গন্ধে আকুল...। আসলে ভালোবাসার একটা মিষ্টি সুবাস আছে, আছে আলাদা রং। ভালোবাসা যেন ঝরনা থেকে নেমে আসা ছন্দময় পানি। সে কলকল করে ছুটে চলছে। কখনো সে বাধা পাচ্ছে, তবু অভীষ্ট লক্ষ্যপানে সে এগিয়ে চলছে। নীলার স্বামী সর্বশেষ জানিয়েছে সে টার্কিশ এয়ারলাইনসে উঠছে। এই তো আর মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা। নীলার যেন বিশ্বাসই হতে চাচ্ছে না। তার কাছে এখনো স্বপ্নের মতো লাগছে। গত ১০ বছর আগে টেলিফোনে বিয়ে তারপরে শুধুই অপেক্ষা। নীলা এটাই তার জীবনের নিয়তি ভেবে নিয়েছিল। কিন্তু আজ অপেক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। নীলা নিজেকে চিমটি কাটে। সত্যিই কি এমনটা হতে যাচ্ছে? গানের মাঝে রেডিওতে একটা ঘোষণা আসে। ব্রেকিং নিউজ—বাংলাদেশি যাত্রীসহ টার্কিশ এয়ারলাইনসের একটি বিমান কিছুক্ষণ আগে বিধ্বস্ত হয়েছে। যাত্রীদের সবাই নিহত হয়েছে। ঘোষণাটি নীলার কানে যেন বুলেটের মতো আঘাত হানে। ঘটনার আকস্মিকতা হতভম্ব করে দিয়েছে তাকে। হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকারে জ্ঞান হারায় সে।
* লেখক: সুলতান মাহমুদ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, শরীয়তপুর