বেইজিংয়ের সেই দিনগুলো: ৭ম ও শেষ পর্ব
চীন সরকারের বৃত্তিতে বেইজিং সফর। ভাষা শেখার পর বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্টস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন লেখক। সাত পর্বের সপ্তম পর্ব আজ
আমাদের ভাষাশিক্ষার কোর্স শুরু হয় ফল সেশনে। যেহেতু বছরের এ সময়ে গাছের পাতা সব ঝরে পড়ে, তাই আমেরিকানরা এই সিজনকে বলে ফল। আমরা বাংলাদেশে ফলকে ব্রিটিশদের মতন ‘অটাম’ বলে থাকি। বাংলায় বলি শরৎকাল। বাংলাদেশের শরৎকালে গ্রীষ্মের ভয়াবহ উত্তাপ কমে গিয়ে গা-জুড়ানো মৃদুমন্দ বাতাস বইতে শুরু করে। সেই সঙ্গে সাদা সুগন্ধি শিউলি ফুলের সমারোহ এবং খাল কিংবা নদীর দুই কূলজুড়ে সাদা কাশফুলের ঝোপ প্রকৃতিকে করে তোলে মোহনীয়। আর পরিষ্কার নীল আকাশে থাকে সাদা মেঘের ভেলা। শরৎকালে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে যেমন লাগে সাদা রঙের ছোঁয়া, তেমনি বেইজিংয়ের চারদিকে তখন দেখা যায় লাল পাতার আভা। কারণ, ঝরে যাওয়ার আগে তখন গাছের সবুজ পাতার রং বদলাতে শুরু হয়। বেইজিংয়ের প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ফ্রাগ্রেন্ট হিলস বা শিয়াংশান পাহাড় যেখানে গাছের পাতার এই রং বদলের অপরূপ রূপটি দেখা যায়। সেখানে যাওয়ার উপযুক্ত সময় অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের শুরু পর্যন্ত। বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউট থেকে আমাদের একদিন সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রকৃতির এই অপূর্ব রূপ দেখার জন্য পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হয়। হেঁটে ওঠার জন্য রয়েছে সিঁড়ি। তা ছাড়া রয়েছে কেব্ল কারের অপশন। আমরা হেঁটেই পাহাড়ে ওঠার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের বলা হলো যে পাহাড়ে ওঠা সহজ; কিন্তু নামা কঠিন। তবে তারুণ্যের মহিমায় পাহাড়ে ওঠা কিংবা নামা কোনোটাই আমাদের কাবু করতে পারেনি। শিয়াংশান পাহাড়ের গাছগুলোর মধ্যে রয়েছে ম্যাপলট্রি, স্মোকট্রি আর গিঙ্কোগাছ। এ সময়ে ম্যাপলের পাতা গাঢ় লাল ও কমলা রং ধারণ করে। স্মোকট্রির পাতা হয় গোলাপি লাল আর তাতে থাকে একধরনের ধোঁয়াশা ভাব। আর গিঙ্কো গাছের পাতা উজ্জ্বল হলুদ বর্ণ ধারণ করে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যখন দূরদিগন্তে চোখ রাখা যায়, তখন মনে হয় পুরো এলাকাটাই যেন আগুনরঙা লাল আভায় ভরে উঠেছে। সেই লাল আভার মধে৵ দেখা মেলে হলুদ আর কমলা রঙের মিশ্রণ, যা কিনা লাল রঙের একঘেয়েমি দূর করে এই তিন উজ্জ্বল রঙের মধে৵ তৈরি করেছে এক অপরূপ সমতা। প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্য দেখার মধে৵ রয়েছে এক মানসিক পরিপূর্ণতার আমেজ যা স্মৃতিপটে থেকে যায় চির ভাস্বর হয়ে। জীবনের এক পর্যায়ে আমি কানাডার টরন্টোয় স্থায়ী হয়েছি। ‘ফল’ সিজনে টরন্টোর প্রকৃতিও সেজে ওঠে পাতার রং বদলের অপূর্ব সৌন্দর্যে। প্রতিবছর সেই রূপের আস্বাদন নিতে বেরিয়ে পড়ি লং ড্রাইভে। রাস্তার দুই পাশজুড়ে থাকে বিভিন্ন শেডের পাতার সমারোহ। তার পরও আমার স্মৃতিপটে বেইজিংয়ের শিয়াংশান পাহাড়ে জীবনের প্রথম দেখা রঙিন পাতার নান্দনিক রূপের স্মৃতি চির অম্লান হয়ে আছে।
আমাদের ভাষাশিক্ষার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে জীবন আরও বেশি চায়নিজ সমাজে মিশে যেতে শুরু করে। তার কারণ হলো আমরা যেমন একদিকে তাদের সঙ্গে কথোপকথনে অংশ নিতে পারি, সেই সঙ্গে তাদের কালচারকেও গভীরভাবে অনুধাবন করা শুরু করি। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজের সঙ্গেও পরিচিত হতে শুরু করি। এভাবে ধীরে ধীরে তারা যে কথাটি মুখে অথবা আকারে–ইঙ্গিতে প্রকাশ করছে না; অর্থাৎ যেটা তাদের চিন্তার পর্যায়ে রয়েছে, সেটিও অনুধাবন করা শুরু করি। অর্থাৎ চায়নিজদের থিঙ্কিং প্রসেসটাও আমাদের কাছে আস্তে আস্তে খোলাসা হওয়া শুরু করে। একটি নতুন ভাষা কীভাবে একটি নতুন কালচারকে আমাদের সামনে ধীরে ধীরে উন্মুক্ত করে দেয়, সেটিই আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করছিলাম।
আমাদের কাছে ‘বেইজিং ফ্রেন্ডশিপ স্টোর’-এর মূল আকর্ষণ ছিল এর লাগোয়া একটি কফিশপ। আমরা বাংলাদেশে বিকেল বেলায় বন্ধুবান্ধব নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে চা সহযোগে আড্ডা দিতে অভ্যস্ত। এই কফিশপ আমাদের সেই অভ্যাসকে উসকে দিয়েছিল এই বিদেশ– বিভূঁইয়ে। তবে এই কফিশপের পরিবেশ আমাদের দেশের রেস্টুরেন্টের মতন গমগমে নয়।
আমরা নতুন শেখা চায়নিজ শব্দ কিংবা বাক্যের গঠন ইত্যাদি ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য বেশি করে ক্যাম্পাসের বাইরের চায়নিজদের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশন করা শুরু করি। প্রথম প্রথম ক্যাম্পাসের বাইরে আমাদের গন্তব্য ছিল সীমিত। কারণ, আমাদের তখনো বেইজিং শহরকে তেমন করে চেনা হয়ে ওঠেনি। প্রথম যে গন্তব্য আমাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, সেটি ছিল ‘বেইজিং ইয়ো ই শাংতিয়েন’ বা ‘বেইজিং ফ্রেন্ডশিপ স্টোর’। চীন সরকার এই রিটেইল স্টোরটি ১৯৬৪ সালে বেইজিংয়ের চিয়েনকোয়ামেন এলাকায় তৈরি করে। প্রাথমিকভাবে বেইজিংয়ে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের ডিপ্লোম্যাট, চীনে কর্মরত বিদেশি এক্সপার্ট এবং পর্যটকদের জন্য খোলা হয় এই স্টোর, যেখানে পাওয়া যেত বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য, লাক্সারি আইটেমস আর ট্র্যাডিশনাল চায়নিজ সিল্ক ও অন্যান্য স্যুভেনির সামগ্রী। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আমরা যখন বেইজিং যাই, তখন এই স্টোর একটি সুপারস্টোরে রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে গ্রোসারি আইটেমও পাওয়া যেত। সেই সঙ্গে ফরেন স্টুডেন্টদের জন্যও এই স্টোরের দুয়ার ছিল উন্মুক্ত।
এই স্টোর যেহেতু বিদেশিদের জন্য, তাই এখানে লোকাল চায়নিজদের ঢোকার ব্যাপারে ছিল কড়াকড়ি। কোনো বিদেশির সঙ্গী হয়ে ঢোকার ক্ষেত্রে চায়নিজদের এই স্টোরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হতো। এই স্টোরে ‘রেন মিন পি’ বা চীনের জনগণ যে কারেন্সি ব্যবহার করে, তা ছিল অচল। এই স্টোর থেকে কেনাকাটা করলে দাম পরিশোধ করতে হতো ‘এফইসি’ বা ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ সার্টিফিকেট’ নামক এক বিশেষ ধরনের কারেন্সিতে। চীনে যখন কোনো বিদেশি লেজিটিমেটভাবে ফরেন কারেন্সি চেঞ্জ করে চীনের কারেন্সি নেয়, তখন ব্যাংক অথবা যেকোনো সরকারি এজেন্সি তাকে ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ সার্টিফিকেট’ নামক সেই বিশেষ চীনা কারেন্সি দেয়। অর্থাৎ বিদেশিরা যখন চীনে কোনো কিছু কেনাকাটা করবে, তখন সেটির মূল্য চোকাতে হবে সেই বিশেষ কারেন্সিতে। সরকারিভাবে রেন মিন পি এবং এফইসি এই দুই প্রকার কারেন্সির মুদ্রামান সমান কিন্তু খোলাবাজারে এফইসির মুদ্রামান রেন মিন পির প্রায় দেড় গুণ। কারণ এফইসি দিয়ে স্পেশালাইজড কিছু দোকানে এমন কিছু পণ্য কিনতে পাওয়া যায় যা কি না, বাইরের কোনো দোকানে পাওয়া যায় না। তবে আমরা যারা চীন সরকারের বৃত্তিপ্রাপ্ত ফরেন স্টুডেন্ট, তারা অবশ্য ‘হোয়াইট কার্ড’ দিয়ে সেই সব পণ্য রেন মিন পি দিয়ে কিনতে পারতাম। ফলে অনেক বিদেশি ডিপ্লোম্যাট বা লোকাল চায়নিজ তাদের এফইসির সাশ্রয়ের জন্য আমাদের শরণাপন্ন হতেন।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আমাদের কাছে বেইজিং ফ্রেন্ডশিপ স্টোরের মূল আকর্ষণ ছিল এর লাগোয়া একটি কফিশপ। আমরা বাংলাদেশে বিকেল বেলাতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে চা সহযোগে আড্ডা দিতে অভ্যস্ত। এই কফিশপ আমাদের সেই অভ্যাসকে উসকে দিয়েছিল এই বিদেশ বিভূঁইয়ে। তবে এই কফিশপের পরিবেশ আমাদের দেশের রেস্টুরেন্টের মতন গমগমে নয়। আলোআঁধারি পরিবেশে নিরিবিলিতে বসে কফি খাওয়ার জন্য এই কফিশপ। কফির সঙ্গে অনেক ধরনের স্ন্যাক্সের সমাহার রয়েছে এখানে। এখানে আমি অনেককেই দেখেছি এক কাপ কফি নিয়ে অনেক সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে লেখালেখি করতে। অনেকের ধুঁমায়িত কফির কাপ ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেই দিকে নেই কোনো খেয়াল কারণ সে আপন মনে পড়ে যাচ্ছে কোনো এক পেপারব্যাক উপন্যাস। আমাদের জন্য এই নিরিবিলি পরিবেশ ছিল কিছুটা অস্বস্তিদায়ক; কারণ, আমরা সেখানে দল বেঁধে গিয়ে বড় একটা টেবিলে বসে হইহুল্লোড় করে আড্ডা দিতেই বেশি পছন্দ করতাম। তবে কথায় বলে, ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ ফলে ধীরে ধীরে আমরাও সেই পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম।
জীবনের এক পর্যায়ে আমি কানাডার টরন্টোয় স্থায়ী হয়েছি। ‘ফল’ সিজনে টরন্টোর প্রকৃতিও সেজে ওঠে পাতার রং বদলের অপূর্ব সৌন্দর্যে। প্রতিবছর সেই রূপের আস্বাদন নিতে বেরিয়ে পড়ি লং ড্রাইভে। রাস্তার দুই পাশ জুড়ে থাকে বিভিন্ন শেডের পাতার সমারোহ। তার পরও আমার স্মৃতিপটে বেইজিংয়ের শিয়াংশান পাহাড়ে জীবনের প্রথম দেখা রঙিন পাতার নান্দনিক রূপের স্মৃতি চির অম্লান হয়ে আছে।
ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটের ক্যাম্পাস থেকে বেইজিংয়ের ডিপ্লোম্যাটিক এরিয়া চিয়েনকোয়ামেন যেতে হলে আমাদের প্রথমে ৩৩১ কিংবা ৩৭৫ নম্বর বাসে চেপে যেতে হতো শিট্রিমেন নামক বাস স্টেশনে। সেখান থেকে সাবওয়ে বা তিথিয়েতে চড়ে যেতে হতো চিয়েনকোয়ামেন স্টেশনে। সাবওয়ে থেকে বের হয়ে কিছুদূর হাঁটলেই তবে পৌঁছানো যেত বেইজিং ফেন্ডশিপ স্টোরে। ফ্রেন্ডশিপ স্টোর ছাড়িয়ে আরেকটু হাঁটলে দেখা মিলত চিয়েনকোয়ামেনের বিখ্যাত সিল্ক মার্কেটের। এই মার্কেটের আসলে কোনো সাইনবোর্ড কিংবা ফরমাল কোনো নাম ছিল না। চিয়েনকোয়ামেন এলাকার শিউশুয়েইচিয়ে নামক একটি গলির দুই পাশে ছিল সারি সারি ছোট দোকান। আর সেই দোকানগুলোতে পাওয়া যেত নানা ধরনের সিল্কের কাপড়, স্যুভেনিরসহ অন্যান্য এক্সোটিক আইটেম; যেগুলো বেইজিংয়ের অন্য কোথাও দেখা যেত না। মূলত বিদেশিরা ছিল এই দোকানগুলোর কাস্টমার এবং তারাই এই মার্কেটের নাম দিয়েছিল সিল্ক মার্কেট। এই সব দোকানে চলত চূড়ান্ত রকমের দর–কষাকষি। অনেকটা আমাদের দেশের গুলিস্তান মার্কেটের মতন। এখানে বেচাকেনা হতো রেন মিন পি কারেন্সিতে। সেটির কারণেও বিদেশিরা এই দোকানগুলোতে ভিড় জমাত। এ ছাড়া তারা তাদের ডলার কিংবা এফইসি ব্যাংকের থেকে প্রায় দেড় বা দ্বিগুণ রেটে এখানে ভাঙিয়ে নিতে পারত। তবে যেসব চায়নিজ ডলার ভাঙানোর ব্যবসা করত, তাদের কোন দোকান ছিল না। তারা ছিল ভাসমান। তারা অনেক সময় তাদের কাস্টমারদের হাতের কারসাজিতে টাকা কম দিত। তাই ডলার ভাঙানোর সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হতো। তারপরও এই মার্কেটের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। চীন সরকারের বৃত্তির সঙ্গে আমাদের শীতের কাপড় কেনার জন্য এককালীন আশি রেন মিন পি দেওয়া হয়। আমি আমার প্রথম উইন্টার জ্যাকেটটি এই মার্কেট থেকেই কিনেছিলাম। এ ছাড়া সস্তায় বেশ কয়েকটা সিল্কের প্রিন্টেড শার্টও কেনা হয়েছিল এই মার্কেট থেকে। এই মার্কেটের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে এখানকার দোকানগুলো ছিল ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত। ব্যক্তিমালিকানায় ব্যবসার এই উদ্যোগ সেই সময়ে কমিউনিস্ট চীনের জন্য একদম একটি নতুন অর্থনৈতিক সংস্কার ছিল, যেটি কিনা প্যারামাউন্ট লিডার দেং শিয়াও পিং প্রবর্তন করেন। সেই সময়ে দেং শিয়াও পিংয়ের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা হাঁটি হাঁটি পা পা করে অগ্রসর হতে শুরু করে। কালের বিবর্তনে এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঠিক নেতৃত্বের কারণে চীন আজ বিশ্বের একটি অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তির দেশে পরিণত হয়েছে। আর গলির ধারের সারি সারি ছোট ছোট দোকানের সেই সিল্ক মার্কেটটি আজ পরিণত হয়েছে একটি মাল্টি স্টোরিড প্লাজায়। চীনের এই অর্থনৈতিক শক্তির উত্থানের শুরুটা আমাদের চোখের সামনে ঘটেছিল।
আমরা ১৯৮৭ সালে যখন বেইজিংয়ে যাই, চীন সেই সময়ে সবেমাত্র কালচারাল রেভল্যুশনের করাল থাবা থেকে বেরিয়ে এসেছে। চীনের প্রিমিয়ার পদে তখন রয়েছেন লি পেং, যিনি কিনা মাও সেতুংয়ের আমলের প্রিমিয়ার চৌ এনলাইয়ের পালক পুত্র। কিন্তু মূল ক্ষমতা রয়েছে প্যারামাউন্ট লিডার দেং শিয়াও পিংয়ের হাতে। দেং শিয়াও পিং ইতিমধ্যে চেয়ারম্যান মাওয়ের বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক দর্শন ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের ভিতর আমূল পরিবর্তন এনেছেন। কমিউনিস্ট চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় হচ্ছে কালচারাল রেভল্যুশন যা কিনা চীনের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট চায়নার গোড়া পত্তনের পরপরই চেয়ারম্যান মাও সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেন। যার মধ্যে ‘দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ ছিল অন্যতম। কিন্তু উপযুক্ত দূরদর্শিতার অভাবে এই প্রকল্পের ভরাডুবি হয় এবং স্মরণকালের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয় চীনজুড়ে। এই দুর্ভিক্ষে ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ মিলিয়ন লোকের মৃত্যু ঘটে। দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডের ব্যর্থতাকে অন্যের ঘাড়ে চাপানোর উদ্দেশ্যে চেয়ারম্যান মাও তখন কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরের এক দলকে ‘প্রতিবিপ্লবী’ বলে অভিহিত করলেন এবং তাদের নির্মূল করার জন্য নতুন এক ফর্মুলা দিলেন। সমাজ থেকে ‘পুরোনো আইডিয়া’, ‘পুরোনো কালচার', ‘পুরোনো প্রথা’ এবং ‘পুরোনো অভ্যাস’- এই ‘চার পুরোনো’কে দূর করার এই ফর্মুলাই ১৯৬৬ সালে কালচারাল রেভল্যুশনের সূচনা করে। শুরু থেকেই অবশ্য কালচারাল রেভল্যুশনের কন্ট্রোল চেয়ারম্যান মাওয়ের চতুর্থ স্ত্রী চিয়াং ছিং তার তিন সহযোগীর সহযোগিতায় নিজ কবজায় রাখেন। চিয়াং ছিং এবং তাঁর তিন সহযোগীর এই সমন্বয় ইতিহাসে কুখ্যাত ‘গ্যাং অব ফোর’ বা ‘চার কুচক্রী’ নামে অভিহিত। এ সময় অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা লিউ শাওচি এবং দেং শিয়াও পিং কালচারাল রেভল্যুশনের বিরোধিতা করেন। মাওয়ের আলট্রা লেফটিস্ট পলিসির বিপরীতে কনভেনশনাল ইকোনমিক পলিসি নেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করার কারণে তারা দুজনই চেয়ারম্যান মাওয়ের কোপানলে পড়েন। ফলে চেয়ারম্যান মাওয়ের জীবদ্দশায় তাদের দলের মধ্যে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল; কিন্তু ১৯৭৩ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত প্রিমিয়ার চৌ এনলাই দেং শিয়াওপিংকে চীনের অর্থনীতি ঢেলে সাজানোর জন্য বেইজিংয়ে ফিরিয়ে আনেন। একই সঙ্গে তিনি চেয়ারম্যান মাওকে কনভিন্স করতে সমর্থ হন যে দেং শিয়াও পিং তাঁর (চৌ এনলাই) মৃত্যুর পর প্রিমিয়ারের পদে বসার যোগ্যতা রাখেন। ফলে চেয়ারম্যান মাও দেং শিয়াও পিংকে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম ভাইস প্রিমিয়ার পদে নিয়োগ দেন। কিন্তু দেং শিয়াও পিংয়ের এই উত্থান গ্যাং অব ফোরের সদস্যরা ভালো চোখে দেখেনি। ফলে দেং শিয়াওপিংয়ের অবস্থান আবারও নড়বড়ে হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে মাও সে–তুংয়ের মৃত্যু এবং সেই সঙ্গে অক্টোবরে গ্যাং অব ফোরের পতনের পর দেং শিয়াও পিং দলের ভেতর তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের কঠোর হাতে মোকাবিলা করা শুরু করেন এবং কালচারাল রেভল্যুশনের ভুলগুলো নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করার জন্য দলের সবাইকে উৎসাহিত করেন। একটি জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতির মূল চাবিকাঠি যে শিক্ষা, সেটি সেই সময় দেং শিয়াও পিং খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই চেয়ারম্যান মাওয়ের মৃত্যুর পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৭৭ সালে ইউনিভার্সিটিগুলোতে স্বাভাবিক শিক্ষাক্রম আবার চালুর লক্ষ্যে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে চীন অর্থনৈতিকভাবে এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে যে মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়েছিল, সেটিকে পুষিয়ে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এটাই ছিল প্রথম পদক্ষেপ। শিক্ষার মাধ্যমে একটি জাতি যে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম, আজকের চীন সেটিই প্রমাণ করে দেখিয়েছে।
বামপন্থী বিশেষ কোনো নীতিকে আঁকড়ে ধরে রাখার চেয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোটাই যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি বোঝাতে দেং শিয়াও পিং তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেন ‘বিড়াল সাদা না কালো সেটি দেখার বিষয় নয়, সে ইঁদুর ধরতে সক্ষম কি না, সেটিই বিবেচ্য।’ ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে চেয়ারম্যান মাওয়ের নির্বাচিত উত্তরসূরি হুয়া কোয়াফেংকে সরিয়ে তিনি দলের নেতৃত্বে চলে আসেন। দলের নেতৃত্বে এসেই দেং শিয়াও পিং তাঁর বিখ্যাত ‘কায় গ খায় ফাং’ নীতির ঘোষণা দেন। চায়নিজ ভাষার চারটি শব্দ সংবলিত এই নীতির সরল বাংলা অর্থ হচ্ছে, ‘খোলাদুয়ার নীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন তথা উন্নয়ন।’ উল্লেখ্য যে, এ সময় অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে চীনের শতকরা ৯০ জন লোকের দৈনিক আয় ছিল ২ মার্কিন ডলারের কম। প্রথম রিফর্ম শুরু হয় কৃষিক্ষেত্রে। কালচারাল রেভল্যুশনের সময় গ্রামে গ্রামে যে কমিউনাল খামার গড়ে উঠেছিল, সেগুলোকে ব্যক্তিমালিকানার আওতায় আনা শুরু হয়। গ্রামভিত্তিক কৃষি খামারের সংস্কারের পর নজর দেওয়া হয় শহরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতির। তারই ধারাবাহিকতায় বেশ কিছু কোস্টাল সিটিতে গড়ে তোলা হয় স্পেশ্যাল ইকোনমিক জোন যার মধ্যে গোটা হাইনান প্রভিন্স এবং শেনট্রেন, ট্রুহাই, শানথৌ, শিয়ামেন ইত্যাদি শহরগুলো উল্লেখযোগ্য। এভাবে সমাজতান্ত্রিক বলয় থেকে চীনের সমাজ ধীরে ধীরে মার্কেট ইকোনমির দিকে যাত্রা শুরু করে এবং অচিরেই তার সুফল পেতে শুরু করে। ১৯৯০ সালে আমি ব্যক্তিগতভাবে হাইনান দ্বীপ এবং ম্যাকাওয়ের নিকটবর্তী ফুচিয়েন প্রভিন্সের শিয়ামেন শহর ভ্রমণ করেছিলাম। চীনের অন্যান্য শহরের চেয়ে সেখানকার জীবনযাত্রার মান যে অনেকখানিই উন্নত, সেটি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছিল।
দেং শিয়াও পিংয়ের নেতৃত্বে চীন যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে একটি পাকাপোক্ত অর্থনৈতিক বনিয়াদের সূচনা করে ঠিক সেই সময়ে রাশিয়া তথা সমগ্র ইস্ট ইউরোপের অর্থনীতিতে ভাঙন শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে ১৯৮৮ সালে যখন তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ১৩ ডলারে নেমে আসে, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতির মূল ভিত্তিই ছিল তেল রফতানির ওপর নির্ভরশীল। রুবেলের দাম যখন পাল্লা দিয়ে নিম্নমুখী তখন সোভিয়েত জনগণ উপায়ান্তর না দেখে অর্থ উপার্জনের জন্য নিজেরাই নানা রকম বুদ্ধি বের করা শুরু করে। তারই ফলে তারা মস্কো থেকে দলে দলে লাগেজ-ট্যুরিস্ট হিসেবে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলে চড়ে বেইজিংয়ে এসে উপস্থিত হয়। বেইজিং থেকে সস্তায় বড় বড় ব্যাগ ভরে বিভিন্ন ধরনের সিল্কের কাপড় এবং পোরসেলিনের তৈজসপত্র কিনে তারা ফিরে যেত রাশিয়ায়। তবে বেইজিং থেকে মালামাল কেনার সময় তারা সবচেয়ে বেশি ভিড় জমাতো চিয়েনকোয়ামেনের সেই সিল্ক মার্কেটে। আর আমরা তাদের কাছ থেকে দেখার সাক্ষী হয়ে রইলাম একটি পরাশক্তির পতনের পদরেখার। শেষ