অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন ও আবদুল্লাহ আল-হারুন
ছাত্রজীবনে ছিলেন মনেপ্রাণে বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক।
মেহনতি মানুষের অধিকার, শ্রেণিহীন ও শোষণহীন সমাজ গঠনে ছিল দেশ গড়ার অঙ্গীকার। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য পরিস্থিতি ও বামপন্থীদের ওপর আঘাত নেমে আসার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পরিবার–পরিজন ও সন্তানদের ফেলে দেশত্যাগ করে বেছে নিতে হয় ফেরারি জীবন। গ্রিসের এথেন্স হয়ে চলে আসেন জার্মানি। অপরিচিত দেশ, অপরিচিত সমাজ হতাশাময় জীবনে নেমে আসে অবসাদ। রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও বিশ্বাসে প্রবল আঘাত আসে যখন নব্বই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে খানখান হয়ে যায়। আশাভঙ্গের মর্মান্তিক দুঃখ ও অনিশ্চিত জীবনে নেমে আসে উদাসীনতা।
১৯৯৭ সালের ঘটনা।
উদাসীনতা ও দীর্ঘ বেকারত্বের পর হাতে আসে একটি বিজ্ঞাপন। স্থানীয় কয়েকজন এই শহরে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে একটি হজপিস গ্রুপ গঠন করতে চান। হজপিসদের কী কাজ, সেটা অনেক দেশেই অজানা। হজপিস সদস্যরা মৃত্যুপথযাত্রীদের সঙ্গদান করেন, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। মৃত্যুর পর মৃতদেহ সাজিয়ে রেখে তাদের কাজ সমাধা হয়। এ যেন মৃতের সঙ্গে বসবাস। মৃতের সঙ্গে বসবাসে প্রায় সবাই অপারগ, এর জন্য প্রয়োজন বিশেষ মানসিক প্রস্তুতি ও সাহস। মৃত্যু নিয়ে, হজপিস নিয়ে পাতার পর পাতা প্রবন্ধ লেখা যায়, কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রীর সঙ্গে সময় কাটানো বা মৃতের সঙ্গে বসবাস—এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ এক ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ আবদুল্লাহ আল-হারুন।
হজপিস সংগঠনে যোগাযোগের পর মৃত্যু নিয়ে প্রচলিত ধ্যান–ধারণা পেছনে ফেলে এক নবদিগন্তের মুখোমুখি হলেন আবদুল্লাহ আল-হারুন। জীবন ও মৃত্যু কেউ কারও শত্রু নয়, উভয়েই হাত ধরাধরি করে চলে, উভয়েই আমৃত্যু পরম বন্ধু। মৃত্যু দেহকে মুক্তি দিয়ে অবিনশ্বর আত্মাকে অন্য এক লোকে নিয়ে যায়।
সক্রেটিস বলেছেন, মৃত্যু এক অমোঘ নিয়তি।
এই নিয়তিকে পাল্টানো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই মৃত্যুর নিয়ম মেনে নিতেই হয়। সক্রেটিস মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার কারণ হিসেবে দেখেননি, বরং জীবনের গভীরতা, নৈতিকতা ও আত্মার স্থানান্তরের কথা বলেছেন।
মৃত্যুর আগে তিনি বলেছিলেন, এখন যাওয়ার সময় হয়েছে, আমার মৃত্যুর সময় উপস্থিত, আপনারা বেঁচে থাকবেন। কিন্তু আমি, কিংবা আপনারা কে যে ভালো অবস্থানে থাকব, সেটা জানেন ঈশ্বর। ইংরেজিতে এই কথাটিকে বলা হয়েছে ‘আই টু ডাই, অ্যান্ড ইউ টু লিভ। হুইচ অব দিজ টু ইজ বেটার অনলি গড নোজ।’
মৃত্যুর ভয় মানুষের সবচেয়ে বড় ভয়।
মানুষ মৃত্যুকে এড়াতে চেষ্টা করে, পেছনে ফেলতে চেষ্টা করে, তবু মৃত্যু সঠিক সময়ে উপস্থিত হয়। হজপিস সংগঠনের নিবেদিত কর্মীরা মৃত্যুপথযাত্রীদের সঙ্গদানে মৃত্যুকে ভয়হীন করতে সচেষ্ট থাকেন। হজপিসের মূল দায়িত্ব মৃত্যুপথযাত্রীদের মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। এমনই এক দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে গেছেন আবদুল্লাহ আল-হারুন।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
এভাবে কেটেছে অনেক দিন।
দিন গড়িয়ে বছর, হতাশাময় অতীত ফেলে নতুন করে বাঁচতে চেয়েছেন, নতুন বন্ধুত্বে আপ্লুত হয়েছেন, পরিচিত হয়েছেন জুলিয়ানা বা জুলির সঙ্গে। উভয়েই বয়সের সীমানা অতিক্রম করে হয়ে গেলেন অকৃত্রিম বন্ধু। দুজন দুজনকে জানলেন চিনলেন, দুঃখ–বেদনার ভাগীদার হলেন। অবশেষে উভয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন একে অপরের শেষযাত্রায় উপস্থিত থাকার। কালের চক্রে জুলিয়ানা এগিয়ে গেলেন মৃত্যুর শেষযাত্রায়। এবার তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার পালা আল-হারুনের।
জীবনের শেষপ্রান্তে জুলিয়ানা উঠে এসেছেন হজপিস ভবনে।
ডাক্তার জবাব দিয়েছেন, প্রিয়জন আত্মীয়স্বজন কেউ কাছে নেই, শুধু অপেক্ষা একজনের। কিন্তু সে–ও নেই, বিশেষ প্রয়োজনে জার্মানির বাইরে। তাকে খুঁজে পেতে কয়েক দিন গেল, খবর পেয়েই ছুটে এলেন আল-হারুন। হজপিস ভবনে কেউ কাউকে এড়িয়ে চলেন না, সবাই সবাইকে জানেন, শুধু রাতের ডিনার শেষে বিদায় নেওয়ার সময় সহজভাবে বলেন, কাল দেখা হবে কি না জানিনে, হয়তো অন্য দুনিয়ায় চলে যাব, ব্যবহারে ব্যথা পেলে মনে রেখো না। জুলিয়ানাকে দেখে তাঁর নিষ্প্রভ চোখের তারার দিকে তাকিয়ে আল-হারুন বুঝতে পারেন, জুলিয়ানার যাওয়ার সময় হয়েছে। রাতে বিছানার প্রান্তে কিছু কথা বলার পর জুলিয়ানা বলেন, এখন ঘুমাব, ভয় পেয়ো না, আজ বা কাল রাতেও রওনা হব না, তবে পরশুর কথা বলতে পারছি না। তোমাকে বিশেষ কিছু কথা বলার আছে, আজ লম্বা হয়ে চেয়ারে শুয়ে পড়। হজপিস ভবনের কক্ষগুলোতে বিশেষ চেয়ারের ব্যবস্থা আছে আধাশোয়া হয়ে ঘুমানো যায়। অল্প সময়ে ঘুমিয়ে গেলেন জুলিয়ানা। ও চেয়ারে আধা শোয়ায় আল-হারুন।
পরদিন
আলো–আঁধারির রাতে বিছানায় শুয়ে আছেন জুলিয়ানা। হঠাৎ সরাসরি তাকিয়ে বললেন, আমি বিয়ে করিনি, কিন্তু মাদার মেরি নই। রুশফ্রন্টে যুদ্ধে গিয়ে বাবা নিখোঁজ হয়ে যান। যুদ্ধ শেষে আফ্রো-আমেরিকান সৈনিক ডেভিডের সঙ্গে পরিচয়, জুলিয়ানার বয়স তখন বাইশ, পূর্ণ যৌবন, কিছুদিনের মধ্যে গর্ভবতী হয়ে জন্ম দেন এক কন্যাসন্তানের। সন্তান জন্মের পরই কিছু না বলে ডেভিড চুপিসারে আমেরিকায় চলে যায়, সেই থেকে কোনো পুরুষের সঙ্গে প্রেমে অনুপ্রাণিত হননি। মেয়েকে দত্তক দিয়ে জীবন কাটিয়েছেন একা। শেষ রাতের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য অবলোকন করে জুলিয়ানা বললেন, ওই দেশে গিয়ে তোমার মা–বাবাকে খুঁজে বের করব। তাঁদের বলব তোমার দুঃখ–বেদনার কথা। আর সবাই মিলে আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
তৃতীয় দিনে জুলিয়ানা আর বিছানা থেকে উঠতে পারলেন না।
দিন গড়িয়ে রাত, জুলিয়ানার চোখের তারা নিষ্প্রভ হয়ে গেছে, আল-হারুন বুঝলেন আজ রাতই শেষ রাত। ছাদের দিকে তাকিয়ে জুলিয়ানা বললেন, তোমার অতীতের দুঃখ, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা–বেদনা আমি আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি, আমার সুখ–শান্তি তোমায় দিয়ে যাচ্ছি, ভালো থেকো। জুলিয়ানার চোখের জ্যোতি এক ফুঁতে নিভে গেল। কী যেন এক অদৃশ্য অস্তিত্ব এক নতুন জীবনের দোরগোড়ায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অসীম অতলে প্রবেশ করল এবং নিঃশব্দে শশব্যস্তে হারিয়ে গেল। কিছু একটা অদৃশ্য বর্ণনার অতীত মৃতদেহ থেকে বেরিয়ে মহালোকে অন্তর্ধান করল। আল-হারুন জুলিয়ানার মৃতদেহ চাদরে ঢেকে উঠে দাঁড়ালেন, হাউসপ্রধানকে খবরটা দিতে হবে।
আল-হারুন পা বাড়াতে যেয়েই শুনতে পেলেন, একটু দাড়াও, একটা দীর্ঘশ্বাস কানে এল, একটা ছায়ার মতো অবয়ব এগিয়ে এল, জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করল আল-হারুনকে। দুই গালে ঠোঁটের পরশ, কপালে আলতো চুমুর পরশ পেলেন। আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন, এ যেন অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন।
জুলিয়ানা শেষযাত্রায় রওনা হয়ে গেলেন।