প্যারিসের প্রতিবিম্ব
আমরা সিচুয়েসানশিপে যেতে পারি। হালকা করে বললেও কণ্ঠ হাসিতে ভরে গেল। বিছানায় শুয়ে ছিল দানেস, কথা শুনে হেসে ফেলল, ‘সে আবার কী।’ বললাম, ‘সিচুয়েসানশিপ’ কোনো কমিটমেন্ট ছাড়া দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক আরকি। এর বেশি নয়। যত দিন ইচ্ছা একসঙ্গে থাকলাম, সব কিছু শেয়ার করলাম, বাড়ি গাড়ি বিছানা, তার আর পর বলে কিছু নেই, বন্ধনহীন জীবন। কথা শুনে চিৎ হয়ে শুয়ে হাত দুটি মাথার পেছনে নিয়ে বলে, ‘কী সাংঘাতিক, ভোগী সাহসী তুমি।’ হাসিতে অনাবৃত বুক লাফিয়ে উঠে দানেসের। গত সন্ধ্যায় পানশালায় গিয়েছিলাম আমরা। মাথাটা ভারী হয়ে গিয়েছিল, তখনি কথাটা বলেছিল দানেস। কোনো রকম সর্ম্পকে জড়াতে চায়না সে। পানশালার মেঝেয় পড়ে যেতে যেতে জড়িয়ে ধরেছিলাম দানেসকে। কোলেতুলে ওভাবেই আমাকে ঘরে নিয়ে এসেছিল।
চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর আর সেমিস্টার নেওয়া হয়নি। দানেসই ফোন করে বলেছিল, সেমিস্টার নেওয়ার কথা ও সমুদ্রের ধারে হোটেল নিয়ে কিছুটা সময় কাটানোর কথা। ছুটি নিয়ে চলে এসেছিলাম ক্রিট দ্বীপে। ক্রিট ভূমধ্যসাগরের ভেতর গ্রিসের ছোট এক দ্বীপ। ছুটি কাটানোর উপযুক্ত জায়গা। চার দিক নীল জল আর জল। মন হালকা করে দেয়। দানেস উড়ে এসেছিল ডেনমার্ক থেকে, ওখানেই একটি ফার্মে চাকরি করে। দানেসের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো স্টকহোমে, সেই থেকে পরিচয়।
হালকা পাতলা ছিপছিপে সাদাকালো মিশ্র বর্ণের দানেসকে দেখেই ভালো লেগেছিল। পরে জেনেছিলাম দানেসের মা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার এক গোত্র প্রধানের মেয়ে আর বাবা ছিলেন শেতাঙ্গ। বাবাকে দেখেনি দানেস, দেখার চেষ্টা করেনি, খোঁজার চেষ্টাও করেনি। একফোঁটার প্রতিদানে পিতা হওয়া যায় না।
পিতা হওয়া অনেক কঠিন। পিতা প্রসঙ্গে খুব একটা বলে না দানেস, তবে ভেতরে ক্রোধ ছিল। ক্রোধের প্রতিফলন চোখে মুখে ফেলতে দেয় না। মা মারা যাওয়ার পর নানা-নানির কাছেই মানুষ। জানি না দানেসের প্রতি কেন আকৃষ্ট হয়েছিলাম তবে সে এক অদ্ভুত গল্প শুনিয়েছিল।
গ্রামের স্কুলে যেত। বিশাল গ্রাম, কয়েক হাজার লোকের বাস। নানা গোত্র প্রধান। সবুজ গাছগাছালিতে পূর্ণ গ্রামে হাজারো গরু, ভেড়া, ছাগল। স্কুলে যাওয়া ছাড়া গরু ভেড়া ও চড়াতে হতো। দানেসের বাল্যকাল এভাবেই কেটেছে। তবে গোত্রের প্রথানুযায়ী বালক থেকে পুরুষে পরিণত হতে বিশেষ এক বয়েসে শিশ্নের অগ্রভাগের অতিরিক্ত চামড়া কেটে ফেলতে হত। দানেসের মুখে এই কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের সমাজে কোন বালককে এই প্রথার মধ্য দিয়ে যেতে হয় না। দানেসের গল্পটা শুনতে উদগ্রীব হলাম।
দানেসের বয়েস ১১ হতেই শিশ্ন পরিশুদ্ধ করার সময় এল। গ্রামে এগারো বছর বয়েসী বালকদের সামাজিক প্রথানুযায়ী বিশেষ দিনে গ্রামের শেষ মাথায় নদীর ধারে নির্জন কুটিরে নিয়ে যাওয়া হল। গোত্র প্রধান সাড়ম্বরে দানেসসহ বালকদের বিদায় জানালেন। সবার গলায় মালা পরিয়ে দেয়া হল। গ্রামজুড়ে উৎসব। নির্জন কুটিরবাসের দুদিন পর হাজাম এলেন। সঙ্গে লাল কাপড়ে মোড়ানো চিকন বাঁশের চিলতে। ছোট বাঁশের চিলতে ছুরির থেকেও ধার। ভোরে সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে বালকদের নদীর জলে গোসল করিয়ে পবিত্র করা হল। প্রত্যেকে এক একটি কম্বলে নিজেদের আবৃত করে নিতে হল। রৌদ্রে শরীর শুকানের পর বালকদের সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে কম্বল ফেলে দিয়ে নগ্ন হয়ে বসে পরতে বলা হলো।
হাজাম পবিত্র চিলতে হাতে কাজ শুরু করলেন। শিশ্নের অগ্রভাগ কেটে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথার মধ্যেও এক একজনকে বলতে হত, ‘আমি পুরুষ হলাম।’ পুরুষ হওয়া ছিল সমাজের প্রধান প্রথার একটি।
ওটা না হলে সমাজে সে পুরুষ বলে গন্য হতো না। বিয়েশাদি বা সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে তাকে প্রাধান্য দেওয়া হতো না। এখানেই শেষ নয়। দিন পনের নির্জন কুটির বাসের পর শিশ্ন শুকিয়ে গেলে তার কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য প্রথানুযায়ী গ্রামের কুমারী মেয়েদের পাঠানো হতো। রাত্রীযাপন শেষে রাতের সঙ্গিনীকে কেউ কেউ জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিতো। তবে নিতেই হবে, এমন কোনো নিয়ম ছিল না।
দানেস এর মধ্য দিয়ে যায়নি। গল্প শোনার পর তলপেটে শুরশুরি অনুভব করেছিলাম। তখনি ইচ্ছে জেগেছিল দানেসের শিশ্নের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার।
ভোরে ঘুম ভাঙে। সাগরের ঢেউয়ের শব্দ আসছে। রাতে আমার ২৩ বছরের কুমারী দেহটা তছনছ করে দিয়েছে দানেস। বিছানায় একটু গড়াগড়ি দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। ঘারে গলায় চিবুকে নীল রক্ত জমাটের চিহ্ন। পাতলা ঠোঁট দুটো ফুলে গেছে। হালকা জামা গায়ে বাইরে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালাম। দানেসকে দেখতে পেলাম না। বেলকনিতে ঝিরঝিরে হাওয়া। ভোরের সূর্য উকি দিয়েছে। যতদূর চোখ যায়, শুধু সমুদ্র আর সমুদ্র। নীল জলের উঁচু উচু ঢেউ। এই উত্তল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে স্পার্টার রাজা মেলেনিয়াসকে স্ক্রিটে আসতে হয়েছিল। আসতে হয়েছিল দাদার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ গ্রহণে। ঘটনা ঘটে তখনি।
র্স্পাটার সঙ্গে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সর্ম্পক দৃঢ় করনে ট্রয়ের রাজকুমার হেকটর ও ছোটভাই প্যারিস ভ্রমণে এলে তাঁদের উভয়কে সাদরে বরন করে নেয় র্স্পাটা। ট্রয় সে সময় এজিয়ন সাগরবাণিজ্যে সমৃদ্ধশালী। র্স্পাটার রাজা মেলেনিয়াস রাজপরিসদ, গণ্যমান্য রাজন্যবর্গ ও রুপবতী স্ত্রী হেলেনের সঙ্গে ট্রয়ের রাজকুমারদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। কিন্তু দাদার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণে মেলেনিয়াসকে ক্রিট দ্বীপে যেতে হলো। দেবতা জিউসের কন্যা হেলেন ছিলেন অপূর্ব রূপবতী। রূপবান রাজকুমার প্যারিস তাঁর প্রেমে পড়ে গেলেন। হেলেন ও ঝাপিয়ে পড়লেন প্যারিসের বুকে।
দাদার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে দেশে ফিরে মেলেনিয়াস স্ত্রীকে ফিরে পাননি। প্যারিসের সঙ্গে হেলেন ট্রয়য়ে চলে গেছেন। সূচনা হল ট্রয় যুদ্ধ। মেলেনিয়াস অভিযোগ আনলেন, ‘আমার সংসার ছেড়ে স্বেচ্ছায় গিয়েছে পরপুরুষের শয্যায়।’ বিশাল গ্রিক বাহিনী নিয়ে ট্রয় আক্রমণ করলেন। সঙ্গে যোগ দিলেন ক্রিটের রাজা ইডোমেনিয়াস কারণ তিনিও ছিলেন রূপবতী হেলেনের পাণিপ্রার্থী। যোগ দিলেন আগামেনন, একিলিস। যুদ্ধ চলল দীর্ঘ ১০ বছর। যুদ্ধে নিহত হলেন ট্রয়ের রাজা প্রীয়ম, রাজকুমার হেকটর, প্যারিসকে হত্যা করলেন মেলেনিয়াস, ট্রয় হল ধ্বংস আর হেলেন ফিরে গেলেন র্স্পাটায়।
মেলেনিয়াসের অভিযোগটি কেন জানি সত্য মনে হলো। আমিওতো স্বেচ্ছায় গিয়েছি দানেসের শয্যায়।
হেলেনকি শুধু ভালোবাসার টানে প্যারিসের কাছে গিয়েছিলো? দেহের টান ছিল না? হেলেনের ভেতর নিজেকে খুঁজে পেলাম। আমি নিজেই যেন নবযুগের হেলেন। শরীরের ভেতরটা শির শিরিয়ে উঠলো।
হেলেনের মত আফ্রোডাইস কি আমার ভেতরেও ভর করেছে? দীর্ঘক্ষণ পর সমুদ্রের ধারে প্রবাল পাহাড়ের পাশে দানেসের দেখা পেলাম। একদৃষ্টে সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে। পায়ের পাশে আছড়ে পরছে সাগর ফেরা ঢেউ। সাদা শার্টটি বাতাশে ট্রয়ের পতাকার মতো উড়ছে। যেন প্রেমিক প্যারিসের প্রতিবিম্ব।
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]