সুইডিস সংসদ ভবনে একদিন
কর্মস্থল থেকে ফিরে একটি চিঠি পেলাম।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন পার্লামেন্ট সদস্য ক্রিস্টিনা অক্সেলসন। একান্ত অনুরোধ জানিয়েছেন সংসদ ভবনে তাঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করার। সময়, দিনক্ষণও জানিয়েছেন। চিঠিতে কোনো বিষয়বস্তু নেই, শুধু দেখা করার আমন্ত্রণ। কোনো কিছু বুঝতে না পেরে ভাবতে হলো। সংসদ সদস্য ক্রিস্টিনা অক্সেলসন আমাদের এলাকার সাংসদ, তবে কোনো পরিচয় নেই, পরিচিত হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমন্ত্রণ গৃহীত হলো কি না, তা আবার তাঁকে বিশেষ সময়ের মধ্যে টেলিফোন অথবা ফ্যাক্সে জানাতে হবে। তারিখের ওপর চোখ বুলিয়ে দেখলাম ভাবার সময় আছে বেশ, প্রায় পাঁচ দিন। পাঁচ দিন অনেক সময়।
কাজের ফাঁকে চিঠিটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, মনে হলো শেষের দিন তা–ও আবার দুপুর পেরিয়ে গেছে। এক অসম্পূর্ণ ভাবনা নিয়েই টেলিফোন উঠিয়ে ক্রিস্টিনাকে চাইলাম। ওপার থেকে ক্রিস্টিনার সাড়া পেতেই নিজের নাম জানিয়ে বললাম, আমি আসছি। ক্রিস্টিনা জানালেন, নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে তিনি সংসদ ভবনের দরজায় তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।
নির্দিষ্ট দিনে নির্ধারিত সময়ে সংসদে উপস্থিত হতেই ক্রিস্টিনা এগিয়ে এলেন। তাঁর জন্য বরাদ্দকৃত রুমটায় নিয়ে এলেন। বেশ বড় রুম, বই, টেলিফোন, টেলিপ্রিন্টার এবং বিভিন্ন কাগজপত্রে পরিপূর্ণ। এক পাশে সেক্রেটারিয়েট টেবিল ও অন্য পাশে সোফা সেট। পরে আর একটা হলঘরে নিয়ে এলেন, প্রবেশপথেই পেস্টি ও কফি সাজানো। বললেন, কিছু নিয়ে নাও খেতে খেতে আলাপ করব। হলরুমে লম্বা টেবিল, আমি একা নই আরও বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ বসে। কেউবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কেউবা সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন ক্রিস্টিনা। কফির পেয়ালায় চুমুক দেওয়ার পর ক্রিস্টিনাই শুরু করলেন, ‘সংসদ সদস্যা হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কিছু বিষয় আমার ওপর বিশেষভাবে ন্যস্ত। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আমরা আলাপ করব, তোমরাও খোলামেলা তোমাদের মতামত জানাবে। তোমাদের মতামতগুলো লিপিবদ্ধ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। তিনি জানতে চান নাগরিকেরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে কী ভাবছে?’
ইউরোপে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কর্যক্রম দ্রুতগতিতেই বাড়ছে। ১৯৯৫ সালে সুইডেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য পদ লাভ করে, তবে ‘ইউরো’ এখনো গ্রহণ করেনি। সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী সুইডিশ মুদ্রা ক্রেনারের পরিবর্তে ইউরোকে গ্রহণ করার সপক্ষে জোর প্রচারণা চালালেও মন্ত্রিপরিষদের অনেকেই এর বিপক্ষে। জনগণও ‘না’ ভোট দিয়ে ইউরোকে গ্রহণের বিপক্ষে রায় দিয়েছে।
ক্রিস্টিনা বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানচিত্রের পরিধি বাড়ছে। আরও ১০টি দেশ সদস্য পদ লাভ করেছে। আমরা চাই সদস্যভুক্ত দেশগুলো থেকে যে কেউ সুইডেনে এসে চাকরি ও বাসস্থানের আবেদন করতে পারবে। সোসালডেমোক্রেট ছাড়া অনান্য দলগুলোর ভিন্ন মত, তোমাদের মত কী?’
ক্রিস্টিনা সোসালডেমোক্রেট দলীয় সংসদ সদস্য, তাই দলীয় কার্যক্রমগুলো ধীরে ধীরে তুলে ধরলেন। সমগ্র ইউরোপ নিয়ে একটি ইউনিয়নের গঠনপ্রক্রিয়া চলছিল অনেক দিন ধরেই। ওই গঠনপ্রক্রিয়ার ফলে ১৯৫২ সালে নেদারল্যান্ডস, পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স, লুকসেমবার্গ, ইতালি ও বেলজিয়াম এই ছয়টি দেশ নিয়ে গঠিত হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের ২১ বছর পর ১৯৭৩ সালে ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড ও ডেনমার্ক ইউনিয়নের সদস্য পদ গ্রহণ করে। এরপর ১৯৮১ সালে গ্রিস, ১৯৮৬ সালে পর্তুগাল ও স্পেন, ১৯৯০ সালে পূর্ব জার্মানি, ১৯৯৫ সালে সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও অস্ট্রিয়া এবং ২০০৪ সালের ১ মে থেকে সদস্য পদ লাভ করে সাইপ্রাস, ইস্টল্যান্ড, ল্যাতলান্ড, লিথুয়েন, মাল্টা, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, স্লাভানিয়া, চেচেন ও হাঙ্গেরিসহ ১০টি দেশ। এই ১০টি দেশের ৭৪.৭ মিলিয়ন অধিবাসী ইউনিয়নের সদস্য পদ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এই ১০টি দেশের অধিকাংশ দেশেরই অর্থনৈতিক কাঠামো দুর্বল। সদস্য চাঁদা দেওয়ার সময় হয়তো কোনো কোনো দেশের ট্রেজারি প্রায় শূন্য হয়ে যেতে পারে, কিন্তু ছোট দেশ ও বড় দেশগুলোর মধ্যে সবাই সমান সুযোগ–সুবিধা ভোগ করবে। প্রাথমিক অবস্থায় সম্পদশালী দেশগুলো অর্থ দিয়ে আর্থিকভাবে দুর্বল দেশগুলোকে সাহায্য করবে, আর্থিক সফলতা লাভে সহায়তা করবে। পত্রপত্রিকাগুলো এখন থেকেই প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে, ‘চাকরি করুন সুইডেনে, পেনশনের টাকা জমা রাখুন মাল্টায় বা স্লোভাকিয়ায়, ১০ লিটার হুইসকি নিন পোল্যান্ড থেকে এবং পেনশন জীবন কাটান সাইপ্রাসে।’
ক্রিস্টিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রশ্ন রাখলাম, বললাম, সোসালডেমোক্রেট দল চাচ্ছে সদস্যদেশগুলোর যে কেউ সুইডেনে এসে বিনা দ্বিধায় চাকরি করতে পারবে, ভালো কথা, তবে প্রশ্নটা হলো সুইডিশ চাকরির আইনগত কাঠামো অন্য দেশগুলোর মতো কি না? উত্তরে ক্রিস্টিনা বলেন, ‘না তা নয়, সুইডিশ চাকরির কাঠামো অত্যন্ত সবল, ইউরোপের অন্যান্য দেশের চাকরির আইন বা কাঠামো ততটা সবল নয়, তবে আমরা এই দিকটা নিয়ে ভেবেছি। মোটামুটি একটি গ্রহণযোগ্য কাঠামো তৈরি করার চেষ্টা চলছে।’
প্রশ্ন রাখলাম, সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পর আর্থিকভাবে দুর্বল ইস্টার্নব্লক দেশগুলো থেকে অনেকেই সুইডেনে প্রবেশ করছে, এতে করে সুইডেনে অপরাধ বেড়ে গেছে প্রচুর। একটি বিশেষ দেশের বেশ কিছু নাগরিককে পুলিশ একবার বের করেও দিয়েছিল, কেননা তারাই স্টকহোমসহ সমগ্র সুইডেনে ক্রাইম ছড়িয়ে দিয়েছিল। ওই বিশেষ দেশটিসহ আরও ৯টি দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পদ লাভ করেছে, সুইডেনে প্রবেশের অধিকার পেয়েছে, এতে করে ক্রাইম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে কি না?
ক্রিস্টিনা বললেন, প্রাথমিক অবস্থায় হয়তো বাড়বে, তবে ইউনিয়নের সবগুলো দেশের সহায়তায় বিষয়টি দেখবে পুলিশ। ক্রিস্টিনা আরও জানালেন, আগামী দিনে আরও পাঁচটি দেশ রুমানিয়া, বুলগারিয়া, টার্কি, ক্রোয়েশিয়া ও মেসিডোনিয়া ইউনিয়নে আসতে চাচ্ছে।’
ক্রিস্টিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রশ্ন রাখলাম, ‘আগামী দিনে যে দেশগুলো সদস্য পদ লাভ করতে যাচ্ছে, তাতে বলার কিছু নেই তবে টার্কি কীভাবে সদস্য পদ লাভ করবে বা সদস্য পদের জন্য আবেদন করে আমার বোধগম্য নয়। কেননা টার্কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পদ চাচ্ছে, আবার ওদিকে ইউরোপেরই অপর একটি দেশ সাইপ্রাসের একটি অংশ দখল করে বসে আছে। টার্কি কি তার দখলত্ব ছাড়বে?’ ক্রিস্টিনা প্রশ্নটা শোনার পর কয়েক মূহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘তোমার প্রশ্নটা খুব যৌক্তিক, তবে এই নিয়ে জাতিসংঘ কাজ করে যাচ্ছে। দেখা যাক জাতিসংঘ এই সমস্যার কতটুকু সমাধান করতে পারে।’
এরপর ক্রিস্টিনা আহ্বান জানালেন সংসদ ভবন ঘুরে দেখার। ১৮৬৬ সালে অ্যাসেম্বলি গঠন হওয়ার পর মেলারেন হ্রদের দুই পারে গড়ে ওঠে সংসদ ভবন। মেলারেনের লবণাক্ত জল ও মিঠা জলকে ভাগ করা হয়েছে সংসদ ভবনের কাছ থেকেই। বিশেষ এক তথ্যে দেখা যায়, প্রথম সুইডিশ সংসদ বসেছিল ১৪৩৫ সালে তবে ‘সংসদ’ শব্দট ব্যবহার করা হয় ১৫৪০ সালে। সে সময় ছিল রাজতন্ত্র। ১৮০৯ সালে রাজকীয় ক্ষমতা ও সংসদীয় ক্ষমতা বণ্টন করে ১৮১০ সালে সংবিধান রচনা করা হয়। ১৯ শতকে দ্রুত শিল্পায়ন ও শ্রমিক সংগঠন প্রভাব বিস্তার করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমিক সংগঠনগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সাধারণ জনগণের সুযোগ বৃদ্ধি কল্পে ১৯৭০ সালে সংবিধানে কিছু নতুন ধারা সংযোজিত হয়। এ সময় সর্বসম্মতিক্রমে ভোটারদের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ এবং ১৮ হলে শুধু ভোট প্রদান ক্ষমতাই নয় সংসদ সদস্য হওয়ারও যোগ্যতা স্বীকৃত হয়।
ক্রিস্টিনা আমাদের নিয়ে এলেন সংসদ ভবনের একটি কক্ষে। কক্ষটি ছোটখাটো এক সংসদ ভবন। এই কক্ষে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও সাংসদেরা মিলে দ্রুত কোনো বিষয়ে মতবিনিময় করেন। লাল কার্পেট দিয়ে মোড়া মেঝে। প্রতিটি ডেস্কে দুজন করে বসার জায়গা। ডেস্কের ওপর মাইক্রোফোন। সম্মুখে ডায়েস, স্পিকারের বসার জায়গা। মাথার ওপর বড় স্ক্রিন। একটি গদিমোড়া চেয়ারে বসে সামনে বড় স্ক্রিনটার দিকে তাকালাম। এই কক্ষেই সুইডেনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়গুলোর ওপর দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে। ক্রিস্টিনা আঙুল তুলে বললেন,‘তুমি যে চেয়ারটায় বসে আছো, ওখানে আন্নালিন্দ এসে বসতেন।’ আন্নালিন্দ ছিলেন সুইডেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে জনৈক মানসিক রোগী তাঁকে ছুরিকাহত করে হত্যা করে। তাঁর অভাবনীয় মৃত্যু চোখের সামনে ভেসে উঠল।
ক্রিস্টিনা এরপর আমাদের নিয়ে এলেন কিচেনের বিশাল কক্ষে। সাংসদেরা এখানেই লাঞ্চ ও ডিনার করেন। তবে প্রতিটি ডিশ তাঁদের কিনে খেতে হয়। টেলিফোন বিল নিজেদের পরিশোধ করতে হয়, এমনকি বিভিন্ন চিঠির স্ট্যাম্প খরচও নিজেদের বহন করতে হয়। এবং সব খরচ বছর শেষে আয়কর রিটার্ন দিতে হয়।
ক্রিস্টিনা আহ্বান জানালেন মূল সংসদ কক্ষটি দেখার। এই কক্ষটি আরও বড়। শুধু বড় নয়, বিশাল বলা যায়। কক্ষটি ওভাল টাইপ। চার বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে ৩৪৯ জন সাংসদ এখানেই বসেন। প্রতি সাংসদের জন্য নির্ধারিত নম্বরযুক্ত একটি আসন। সাংসদ ক্রিস্টিনা অক্সেলসনের আসনসংখ্যা ৪৬। সে সময় সংসদে বিবাহবিষয়ক একটি আলোচনার প্রশ্ন-উত্তর চলছিল। আলোচনার বিষয়, বক্তাদের নাম এবং সময় আগে থেকেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যার ফলে উটকো ঝামেলা সংসদে হয় না বললেই চলে। ক্রিস্টিনা ডেমোক্রেট দলীয় জনৈক সাংসদ বরাদ্দ করা সময়ের মধ্যে বক্তব্য রেখে এলেন। সোসালডেমোক্রেট দল ওই বক্ত্যকে দ্বিমত পোষণ করলেও কোনো প্রকার তিক্ততা হলো না। এরপর আরও কয়েকজন বক্তা বিষয়টির ওপর বক্তব্য রাখেন।
এ সময় দেখা করতে এলেন সংসদের স্পিকার বিয়র্ন ভন সিদ। মাঝারি উচ্চতার ছোট করে ছাঁটা সাদা দাড়িতে হাস্য উজ্জ্বল বিয়র্নকে খুব স্মার্ট দেখাচ্ছিল। হাত মিলিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি এই প্রথম সংসদ ভবনে এসেছ?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, যদিও আমার দেশের সংসদ ভবনটা এখনো দেখা হয়নি।’ শুনে মুচকি হাসলেন বিয়র্ন। প্রশ্ন করলাম, ‘যদি আমার দেশ থেকে তোমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তাহলে কি তুমি যাবে?’ ‘অবশ্যই’, উত্তর দেন বীয়র্ন।
*লেখক: লিয়াকত হোসেন, স্টকহোম, সুইডেন।
দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]