অসমাপ্ত
ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে হসপিটাল থেকে বের হয় আন্দ্রিয়াস।
বাসস্টেশন খুব কাছে নয়। কিছুটা হেঁটে টানেলের ভেতর দিয়ে রাস্তার ওপাশে যেতে হবে। আকাশে শীতের রোদ থাকলেও ভেতরটা গরম লাগছে। এক সপ্তাহ আগে বিভিন্ন পরীক্ষাসহ রক্ত দিয়ে এসেছিল, আজ ডাক্তার রিপোর্টগুলো দেখে ভালো করে জানিয়েছেন। আন্দ্রিয়াস কি বিষণ্ন? চোখ দুটো কি ফ্যাকাশে? কিছুই অনুভব হচ্ছে না। বাড়ি ফিরতে হবে। লিসা অপেক্ষায় আছে।
লিসার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল নরওয়েতে।
একটা বিশেষ অনুষ্ঠানে স্টাভাগনার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল আন্দ্রিয়াস। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল লিসা। পরিচয়পর্বে লিসার ডরমিটরিতেও গিয়েছিল। দুটি দিন ভালোই কেটেছিল। লিসার সান্নিধ্য ভালো লেগেছিল। স্টকহোম ফিরে পড়ার চাপে সব ভুলে গিয়েছিল আন্দ্রিয়াস। লিসার সঙ্গে যোগাযোগটা প্রায় ছিন্নই হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ একদিন লিসার মেইল, ‘আমি আসছি।’ লিসা এল ঠিকই, তবে নরওয়ের পাট চুকিয়ে। সেই থেকে দুজন একসঙ্গেই আছে। একটি কাজ জুটিয়ে নিয়েছে লিসা, হাসপাতালের সহকারী নার্স। পূর্ণ নার্স হওয়ার ইচ্ছা। তবে তার আগে পরিপূর্ণ সংসারের প্রাধান্য দিতে চায়। কিন্তু আন্দ্রিয়াস এখনই পিতা হতে চায় না। চায় একটু গুছিয়ে নেওয়ার পর। বাসে ওঠে আন্দ্রিয়াস, বিভিন্ন জায়গা ঘুরে আন্দ্রিয়াসের বাড়ির কাছাকাছি নামবে। তারপর একটু হেঁটেই বাড়ি। ডাক্তারের দেওয়া রিপোর্ট ফেলে এসেছে, উত্তেজনায় নেওয়া হয়নি। ফিরে গিয়ে আনতে ইচ্ছা হয়নি।
দরজা খুলে ঘরে ঢুকে আন্দ্রিয়াস।
‘তুমি কোথায়?’ ড্রয়িংরুমের কোনায় হ্যাঙ্গারে জ্যাকেট ঝুলিয়ে রাখে। অনেকটা সহজ হয়ে উঠেছে। কিচেন থেকে এগিয়ে আসে লিসা, ‘এত দেরি হলো?‘ আন্দ্রিয়াসের ঠোঁটে ছোট একটা চুমু দেয়, ‘এসো লাঞ্চ তৈরি।’ শনি ও রোববার লিসাই সাধারণত লাঞ্চ ও ডিনার তৈরি করে। আন্দ্রিয়াস বিশেষ একধরনের বাগেট খেতে পছন্দ করে। বাগেটের ভেতর পাতলা করে কাটা ধোঁয়ায় ঝলসানো সলমন, লেটুসপাতা, ছোট মিষ্টি টমেটো আর সস। আন্দ্রিয়াস পছন্দ করে বলেই মাঝেমধ্যেই নরওয়ে থেকে সলমন নিয়ে আসে লিসা। নরওয়ের সলমন খুবই উপাদেয়।
‘গোসল সেরে আসি’ বলেই আন্দ্রিয়াস হালকা কাচ দিয়ে ঘেরা ডুসকেবিনে ঢোকে, ‘তোয়ালেটা দিয়ে যেয়ো’। খাবার টেবিল সাজিয়ে তোয়ালে নিয়ে এগিয়ে আসে লিসা। ভেপারে ভরে গেছে ডুসকেবিন।
আন্দ্রিয়াসের সুঠাম নগ্ন দেহ হালকা দেখা যায়। লিসারও ইচ্ছা করে একই সঙ্গে গোসল করতে। করেছেও কয়েকবার, তবে আন্দ্রিয়াস খুব একটা পছন্দ করে না। লিসার নগ্ন পিঠে সুগন্ধি সাবান লাগিয়ে ছোট তোয়ালে দিয়ে পিঠ ঘষে দিলেও কাছে ঘেঁষতে দেয় না লিসাকে। আন্দ্রিয়াস জানে লিসা কী চায়, কিন্তু অনেক সময় নিজের চাওয়ার সঙ্গে মেলাতে পারে না। বিশেষ কিছু দিনের আলো নয়, আঁধারেই ভালো।
‘সালাদটা খুব ভালো হয়েছে, সেই সঙ্গে বাগেট’, খেতে খেতে বলে আন্দ্রিয়াস। হালকা মেরুন টপে অপূর্ব লাগছে লিসাকে। হালকা-পাতলা দেহ বাঁকিয়ে হাসে লিসা। শুধু প্রশংসাই নয়, আজ সে আরও কিছু চায়।
এটা-ওটা এগিয়ে দিয়ে আন্দ্রিয়াসের চুল, হাত ছুঁয়ে দেয়।
লাঞ্চের পর দুজন নেটফ্লিক্সে ফিল্ম দেখে সময় কাটায়। আন্দ্রিয়াসের গা ঘেঁষে বসে লিসা। দুজনার হাতে কচের গ্লাস। লিসার চোখে তন্দ্রা, আন্দ্রিয়াসের কোলেই শুয়ে পড়ে। লিসার সোনালি চুল, পিঠ, মুখ, নাক, ঠোঁট, গলায় হাত বুলিয়ে দেয় আন্দ্রিয়াস। সে চায় না লিসা তাকে ছেড়ে চলে যাক। লিসার খোলা চুলের ঘুমন্ত মাথাটা বুকে চেপে ধরে। জানে, লিসা কী চায়, না পেলে তো চলে যেতেই পারে। চোখ মেলে তাকায় লিসা। ততক্ষণে ফিল্ম শেষ হয়ে গেছে। লিসার ঠোঁটে ছোট একটা চুমু দিয়ে বলে, ‘চলো বাইরে ফ্রেশ বাতাসে বেরিয়ে আসি।’
বাড়ির পাশেই পাইনবন।
গাছের শুকনা পাতা একটি-দুটি করে ঝরে পড়তে শুরু করেছে। ঝরাপাতার ওপর দিয়ে হাঁটতে ভালোই লাগে। পায়ের পাতায় পাতার শব্দ হয়। দুজনে হাত ধরে এগিয়ে যায়। শেষ বিকেলের আলো। পাখিরা কিচিরমিচির করে ঘরে ফিরছে। লিসাকে নিবিড় করে বুকে টেনে নেয় আন্দ্রিয়াস। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘তোমাকে হারাতে চাই না।’ লিসার ভেতরটা কেঁপে ওঠে।
বনের ভেতর গাছের গোড়ায় ও ফাঁকা জায়গায় শীতের কুয়াশা নেমে এসেছে।
বাড়ি ফেরে দুজন। লিসা বড় তোয়ালেটা নিয়ে ডুসকেবিনে ঢোকে। গোসল করে নেওয়া যাক। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে, আন্দ্রিয়াস ও কথা বলল কেন? সে তো আন্দ্রিয়াসকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি। সোফায় গা এলিয়ে দেয় আন্দ্রিয়াস। ঘরের ভেতর শেষ বিকেলের আলো-ছায়া। ডুসকেবিনে জল পড়ার শব্দ। আজ মনে হয় লিসা একটু বেশি সময় নিচ্ছে। জল পড়ার শব্দ বন্ধ হয়। একটু পরই বেরিয়ে আসে লিসা। বুক থেকে হাঁটু অবধি সাদা তোয়ালে দিয়ে জড়ানো সদ্যঃস্নাত ভেজা শরীর।
‘একী, জানালার পর্দা ফেলোনি?’ পর্দা ফেলতে এগিয়ে যায় আন্দ্রিয়াস। ‘না না না ওভাবেই থাক’ বলতে বলতে এগিয়ে আসে লিসা, আন্দ্রিয়াসকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে বেডরুমে নিয়ে যায়। আন্দ্রিয়াসও শরীরটা বিছানায় ছেড়ে দেয়। গভীরভাবে আলিঙ্গন করে লিসাকে। লিসার দেহ থেকে তোয়ালে সরে গেছে। হঠাৎ করেই লিসার আলিঙ্গন ছেড়ে নিজেকে মুক্ত করে আন্দ্রিয়াস। বিছানার ওপর দুই পা মুড়িয়ে দুই হাতে চোখ বন্ধ করে বসে পড়ে।
অবাক হয় লিসা। ভীষণ অবাক হয়।
আন্দ্রিয়াসের হাত জড়িয়ে ধরে জানতে চায়, ‘কী হয়েছে?’
‘আজ ডাক্তারের ডেট ছিল। ডাক্তার বলেছে, ‘শক্তিহীন গমের বীজ থেকে ফসলের সম্ভাবনা নেই।’
লিসার ভিতটা হালকা হয়ে যায়। হাত দুটি পড়ে যায় শুভ্র বিছানার ওপর।
সুইডিশ লেখক Tony Samuelsson-এর লেখা গল্পের ছায়া অবলম্বনে।