বেইজিংয়ের সেই দিনগুলো: পর্ব-২

চীন সরকারের বৃত্তিতে বেইজিং সফর। ভাষা শেখার পরে বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্টস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন লেখক। সাত পর্বের দ্বিতীয় পর্ব আজ

১৯৮৬ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ডের সম্মিলিত মেধাতালিকায় সপ্তম স্থান অধিকার করায় তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর কাছ থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ কর্তৃক প্রবর্তিত চ্যান্সেলর পুরস্কার গ্রহণ করার মুহূর্তছবি: লেখকের পাঠানো

আমি যে সময়ে আন্ডারগ্র্যাড করার জন্য বেইজিং যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সেই সময়ে দেশ হিসেবে চীনের তেমন কদর ছিল না। অন্তত আমাদের দেশে। কমিউনিস্ট ব্লকের দেশ হিসেবে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও আমাদের দেশের অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। তা ছাড়া কেউ চীনে পড়তে যাচ্ছে সেই সময়, সেটা সহজে শোনা যেত না। ভালো ছাত্রদের তখন দেখা যেত যুক্তরাষ্ট্রের কোনো একটা ইউনিভার্সিটির আই-টুয়েন্টি জোগাড় করে ভিসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে লাইনে দাঁড়াতে। আর যারা অতটা ভালো ছাত্র নয়, তাদের অনেককেই দেখা যেত আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে ভর্তি হতে। অনেকে অবশ্য বাংলাদেশের কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স না পাওয়ার কারণেই ভারতমুখী হতো। তবে ভারতের আইআইটিএর কথা ভিন্ন। সেই সময়ে ভারত সরকার প্রতিবছর কিছুসংখ্যক মেধাবী বাংলাদেশি ছাত্রকে আইআইটি-তে পড়ার জন্য স্কলারশিপ দিত। আমি সেই স্কলারশিপের ফরম আনতে ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাজির হই একদিন। আমাদের সময়েই তারা প্রথম ইংরেজিতে লেটার মার্কস থাকতে হবে, এই নিয়ম চালু করে। ইংরেজির দুই পেপার মিলিয়ে আমার লেটার মার্কসের চেয়ে দুই মার্কস কম ছিল, ফলে মেধাতালিকায় আমার ঠিক পেছনে থাকা রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের পরিচিত এক ছেলে চান্স পেয়ে গেল, অথচ আমি অ্যাপ্লিকেশন করার ফরমই পেলাম না। সেই ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ‘চ্যান্সেলর’ পুরস্কার আনার সময়। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ আমরা যে বছর ম্যাট্রিক পাস করি, সেই বছর থেকে এই পুরস্কার চালু করেন। আমি আমার জীবনে রাষ্ট্রপতি এরশাদকে সামনাসামনি মোট তিনবার দেখেছি। দু’বার চ্যান্সেলর পুরস্কার নিতে গিয়ে, আর একবার বেইজিংয়ে।

বাসে ওঠার সময় খেয়াল করলাম প্রায় আট-দশজন ছেলেমেয়ের আরেকটি দল বাসে উঠেছে। কথাবার্তা শুনে মনে হলো তারা ভারতীয়। দ্বিধা সংকোচ কাটিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম তারা কি আমদের মতো আন্ডারগ্র্যাড করতে চীনে যাচ্ছে?

রাজশাহী বোর্ডের মেধাতালিকায় যেহেতু আমি সপ্তম হই এবং পরীক্ষা দিয়ে বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পাই, সেই হিসেবে আমাকে নিশ্চয় ভালো ছাত্রদের দলে ফেলাই যায়। ফলে আমার উচ্চশিক্ষার জন্য চীনে যাওয়ার ব্যাপারটা সেই সময়কালের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটাই গতানুগতিক ধারার বাইরে ছিল। তাই চীনে যাওয়াটা ঠিক হবে কি হবে না, সেই চিন্তাটাই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। চীনের পরীক্ষায় যে ছেলেটি মেধাতালিকায় দ্বিতীয় হয়েছিল, সে ইতিমধ্যেই চায়নিজ কর্তৃপক্ষকে তার না যাওয়ার সিদ্ধান্তকে জানিয়ে দিয়েছে। এহেন দোটানা অবস্থায় চীনে যাওয়ার পাকা সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে দুটি কারণ সাহায্য করেছিল।

এক. বুয়েটে তখন ভীষণ সেশনজট। কানাঘুষা চলছে যে আমাদের ক্লাস শুরু হতে নাকি দুই বছর লেগে যেতে পারে। আমার সঙ্গে যারা বুয়েটে ভর্তি হয়েছে, তাদের অনেককেই দেখলাম বসে না থেকে দুই বছরের ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হয়ে যেতে। মনে মনে ভাবলাম তাহলে আমিও কেন বসে থাকব? বরং চীনে চলে যাই। কোনো কারণে যদি চীনের সিস্টেমকে পছন্দ না হয়, তবে বুয়েটের দুয়ার তো খোলা।

দ্বিতীয়ত, যেহেতু চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে যাব, তাই আমার কোনো খরচ বহন করতে হবে না। বর্তমানের চিত্র অবশ্য ভিন্ন। চীন আজ একটি উদীয়মান পরাশক্তি ও চীনের শিক্ষাব্যবস্থার মান যে বিশ্বমানের, সেটাও প্রমাণিত। শুনেছি এখন নাকি বাংলাদেশ থেকে নিজ খরচে উচ্চশিক্ষার জন্য অনেকেই চীনে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

চীনে যাওয়ার প্রস্তুতিস্বরূপ প্রথম যে কাজটি করার জন্য পরিকল্পনা করলাম সেটা হলো বোর্ড থেকে ম্যাট্রিক আর ইন্টারমিডিয়েটের মার্কশিট ও সার্টিফিকেটের ইংরেজি ভার্সন সংগ্রহ করা। রংপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে রাজশাহী বোর্ডের অধীনে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি, তাই এগুলো সংগ্রহে শশরীরে যেতে হবে বোর্ডে। তবে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে রংপুর ক্যাডেট কলেজের টেস্টিমোনিয়াল ও প্রিন্সিপালের অনুমতিপত্র। রংপুর ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুবাদে দীর্ঘ ছয় বছর আমি ঢাকা-রংপুর করেছি। তবে তখন ঢাকার সব সহপাঠী একসঙ্গে যাতায়াত করতাম। কখনোই একা যাওয়া–আসা করিনি। তা ছাড়া রাজশাহীতে আগে কখনো যাওয়াই হয়নি। এবার নিজ প্রয়োজনে একা একা যেতে হবে ভাবতেই একটু ভয় ভয় লাগছিল। আমাকে এই অসহায় অবস্থা থেকে পরিত্রাণ করতে এগিয়ে আসে কলেজজীবনের ছয় বছরের রুমমেট ফয়সল। সে–ও এই সুযোগে টেস্টিমোনিয়াল, মার্কশিট আর সার্টিফিকেটের ইংরেজি ভার্সন করিয়ে নেবে। আমাদের জার্নিটা অভিজ্ঞতার ঝুলিকে বেশ সমৃদ্ধ করেছিল নানা কারণে। প্রথমেই ট্রেনে রংপুরে যাই। কলেজের আরেক সহপাঠী হুমায়ূনদের বাসায় ছিলাম সপ্তাহখানেক। যদিও কলেজের কাজ প্রথম দুদিনেই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু খালাম্মার বিশেষ আতিথেয়তার কারণে অতিরিক্ত তিন-চার দিন থেকে যাই। রাজশাহীতে গিয়ে উঠি হোটেল অমরাবতীতে। বোর্ড অফিস থেকে কাছেই সেই হোটেল। বোর্ডের কাজ শেষে গোল বাধে ফিরতি যাত্রায়। বন্যার কারণে রাজশাহী টু ঢাকার বাস চলাচল বন্ধ। অনেক কষ্টে আমরা দুজন লোকাল বাসে ভেঙে ভেঙে নগরবাড়ী এলাম। বন্যার তোপে ফেরি বন্ধ। তাই জান হাতে নিয়ে স্টিমারে চেপে আরিচা পৌঁছাই। আবার বাসে করে ঢাকায় এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি দুজনে।

প্রস্তুতির দ্বিতীয় পর্ব ছিল কিছু কাপড় কেনা। আমাদের বলা হয়েছিল যে বেইজিংয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের বাড়তি টাকা দেওয়া হবে শীতের উপযোগী জ্যাকেট ও অন্যান্য কাপড়চোপড় কেনার জন্য। ফয়সল তাদের ‘ফিবকো গার্মেন্টস’ থেকে আমার জন্য একটা লং স্লিভ পোলো শার্ট বানিয়ে দেয়। এই শার্টটা বেইজিংয়ের নাতিশীতোষ্ণ ‘ফল ওয়েদারে’ খুব কাজে এসেছিল।

চীনে যাওয়ার দিন যখন ঘনিয়ে আসতে লাগল তখন একদিন আমাদেরকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হলো আমাদের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ‘গ্র্যাটিস পাসপোর্ট’ দেওয়া হবে। বিধি মোতাবেক এ পাসপোর্ট শুধু সরকারি কাজে বা মিশনে দেশের বাইরে যাওয়ায় ব্যবহার করা যায়। তাই এই পাসপোর্ট ব্যবহারের জন্য আমাদের প্রত্যেককেই একটি করে সরকারি অনুমতিপত্র বা জিও (গভ. অর্ডার) দেওয়া হলো। পাসপোর্ট আর জিও হাতে আসার পরপরই চায়নিজ কালচারাল সেন্টার আমাদের থাইল্যান্ডের ভিসা বিনা খরচে জোগাড় করে দেয়। কারণ, পথিমধ্যে ব্যাঙ্ককে দুই রাতের যাত্রাবিরতি। একসময় যাত্রার দিন ধার্য হয় ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭। আমাদের ব্যাঙ্কক হয়ে বেইজিংয়ে যেতে থাই এয়ারওয়েজের টিকিট দেওয়া হয়।

প্রস্তুতির দ্বিতীয় পর্ব ছিল কিছু কাপড় কেনা। আমাদের বলা হয়েছিল ইজিংয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়তি টাকা দেওয়া হবে শীতের উপযোগী জ্যাকেট ও অন্য কাপড় কেনার জন্য। ফয়সল তাদের ‘ফিবকো গার্মেন্টস’ থেকে আমার জন্য একটা লং স্লিভ পোলো শার্ট বানিয়ে দেয়। শার্টটা বেইজিংয়ের নাতিশীতোষ্ণ ‘ফল ওয়েদারে’ খুব কাজে এসেছিল।

কারও বিদেশযাত্রা আমাদের দেশের যেকোনো পরিবারের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সবার সঙ্গে দেখা করে বিদায় নেওয়ার রেওয়াজ আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে। তবে সাধারণত ভিসা আর টিকিট হাতে আসার পরই নিকটাত্মীয়দের জানানো হয় সেই সংবাদ। আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে উপদেশ, দোয়া ও উপকারী কিছু উপহার পেলাম। এই উপহারের মধ্যে ছিল কিছু জামাকাপড় আর একটি সিলেক্টেড বাংলা গানের ক্যাসেট। উপদেশের মধ্যে যেটা মনে রেখেছিলাম কিন্তু পালন করতে পারিনি সেটা হলো চীন–জীবনের অভিজ্ঞতা ডায়েরিতে লিখে রাখা। খোদা তাআলা প্রদত্ত আমার স্মরণশক্তির ওপর আমি আস্থা রেখেছি সব সময়। তাই তো চীন–জীবনের প্রায় প্রতিটি ঘটনাই স্মৃতির মানসপটে এখনো উজ্জ্বল। সেই স্মৃতি ধূসর হওয়ার আগেই সেটাকে লিখে রাখাটাই হবে খোদার প্রতি বান্দার শোকর গুজরান।

বেইজিং যাত্রার প্রাক্কালে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমাকে সি-অফ করতে আসা আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু
ছবি: লেখকের পাঠানো

বেইজিং যাত্রার নির্ধারিত দিনে হাতে পর্যাপ্ত সময় রেখেই তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে উপস্থিত হই। সঙ্গে আব্বা-আম্মা, ভাই-বোন, ভাই-বোনদের স্পাউস এবং ছেলেমেয়েরা অর্থাৎ আমার ভাগনে-ভাগনি, ভাতিজা-ভাতিজিদের বিরাট বহর। সেটাই ছিল সেই সময়ের জন্য স্বাভাবিক। আমাকে বিদায় জানাতে ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও এসে উপস্থিত। তাদের এই আন্তরিকতা আমার জন্য ছিল বিরাট প্রাপ্তি। বোর্ডিংয়ের সময় হয়ে এলে আমরা যারা চীনে যাচ্ছি তারা সবাই একত্রিত হই। সেখানে চায়নিজ কালচারাল সেন্টারের ফার্স্ট সেক্রেটারিও উপস্থিত। তিনি আমাদের ও আমাদের পরিবারের সবাইকে আশ্বাস দিলেন, আমাদের যাত্রার সমস্ত খুঁটিনাটি সুন্দরভাবে ব্যবস্থা করা আছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। একসময় সবাইকে বিদায় জানিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে থাই এয়ারওয়েজের বিমানের দোরগোড়ায় পৌঁছি। জীবনের প্রথম বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে, তাই স্বভাবতই সবাই রোমাঞ্চিত। সেই রোমাঞ্চের মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলল যখন বিমানের দরজায় দাঁড়ানো একজন থাই এয়ারহোস্টেস আমাদের ‘সা-ওয়াত-ডি কা’ (ওয়েলকাম এবং গুডবাই দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়) বলে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে নির্ধারিত সিট দেখিয়ে দিলেন। বিমানের ঠান্ডা হাওয়ায় মনে হলো সত্যিই ‘স্মুথ অ্যাজ সিল্ক’—সেই সময়কার থাই এয়ারওয়েজের বিজ্ঞাপনের বিখ্যাত পাঞ্চ লাইন। এই পাঞ্চ লাইন তারা কিন্তু এখনো ব্যবহার করে। দুই ঘণ্টার কিছু বেশি সময়ের এই বিমান ভ্রমণ ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। কারণ, সবকিছুই ছিল নতুন। এয়ারহোস্টেসদের সার্ভিস ছিল চমৎকার। খাবার পরিবেশনের সময় মেন্যু সিলেকশনে আনাড়িপনাতে তাদের মোটেও বিরক্ত হতে দেখেনি। বিমান যখন ব্যাঙ্কক ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে টারমার্ক স্পর্শ করে, তখন দুপুর আর বিকেলের মাঝামাঝি একটা সময়। বিমানের দোরগোড়ায় লাগানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাসে উঠতে হবে। বাস আমাদের নিয়ে যাবে ভেতর। বিমান থেকে নামার মুখে আবারও সেই এয়ারহোস্টেসদের বিদায় সম্ভাষণ। হাসিমুখে তাদের বিদায় জানিয়ে বিমানের বাইরে পা দিতেই গরম বাতাসের হল্কা মুখে যেন এক ঝাপটা দিল। বুঝতে পারলাম ব্যাঙ্কক আমাদের ঢাকা থেকে বেশ অনেকটাই গরম। তবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে চড়তেই স্বস্তি ফিরে পেলাম। আমাদের বলা হয়েছিল, ইমিগ্রেশন পার হয়ে সোজা চলে যেতে হবে থাই এয়ারওয়েজের কাউন্টারে। তারাই আমাদের হোটেলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। থাই এয়ারওয়েজের কাউন্টারে যেতেই তারা মাইক্রোবাসে করে ৩০ কিলোমিটার দূরের ‘হোটেল এশিয়া’-তে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিল। হোটেলে কে কোন রুমে থাকবে, সেটাও তারা ঠিক করে দিল। মাইক্রোবাসে করে যখন ব্যাঙ্কক শহরের রাস্তায় বের হলাম তখন প্রথমেই যে জিনিসটা চোখে পড়েছিল সেটা ছিল ট্রাফিক জ্যাম। ঢাকা তখনো ট্রাফিক জ্যামের শহর হয়ে ওঠেনি। খেয়াল করে দেখলাম, এই ট্রাফিক জ্যামের ভেতর অন্য গাড়িগুলোকে এঁকেবেঁকে পাশ কাটিয়ে তির বেগে ছুটে যাচ্ছে কিছু মোটরবাইক। পরে জেনেছি তারা নাকি ভাড়ার বিনিময়ে যাত্রী বহন করে। যাদের খুব তাড়া, তারা মোটরবাইকে সওয়ার হন। এখন যেমনটি দেখা যায় আমাদের ঢাকা শহরে। ঘণ্টাখানেক লেগে গেল হোটেলে পৌঁছাতে। হোটেলের রিসিপশনে রিপোর্ট করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হাতে রুমের চাবি দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে দেওয়া হলো খাবারের কুপন। এই হোটেলের বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। কুপনগুলো সেই রেস্টুরেন্টগুলোর একটির জন্য প্রযোজ্য।

আরও পড়ুন

দেশে থাকতে আমার বেশ কয়েকবার ঢাকার বাইরের সাধারণ মানের আবাসিক হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতা রয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাজশাহী ও বগুড়ায় হোটেলে থেকেছি। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো লেগেছিল বগুড়ার হোটেল আকবরিয়া। কারণ, হোটেলে একটি উন্নতমানের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে আমি বেশ তৃপ্তিসহকারে ডিনার করেছিলাম। শুনেছি প্রতি রাতে এই রেস্তোরাঁর খাবার দিয়ে শ খানেক গরিব লোককে বিনামূল্যে খাওয়ানো হয়। ব্যাঙ্ককের হোটেলটি থ্রি-স্টার হোটেল। আগে কখনো এ রকম লাক্সারিয়াস হোটেলে থাকা হয়নি আমার। ফলে প্রথম বিমান ভ্রমণের মতোই বিলাসবহুল হোটেলবাসের অভিজ্ঞতাও আমার জন্য নতুন। দলের অন্যদেরও একই অবস্থা। ফলে হোটেলের রুমে ঢুকে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম কীভাবে এয়ারকন রেগুলেট করতে হয় কিংবা ফ্রিজের ভেতর দেওয়া ড্রিংকসগুলো কি ফ্রি ইত্যাদি নিয়ে। যাই হোক, হাতমুখ ধুয়ে ফেশ হতে না হতেই সন্ধ্যা ছয়টা বেজে গেল। ডিনার টাইম। সবাই মিলে কুপন হাতে ছুটলাম নির্ধারিত রেস্তোরাঁয়। ক্যাডেট কলেজে পড়ার কারণে কাঁটা-চামচ দিয়ে খাওয়াসহ অন্য টেবিল ম্যানারিজমের ব্যাপারে অভ্যস্ত। ডিনারের পর রুমে এসে ঘুম। পরদিন সকালে নাশতা সেরে আমরা ছোট ছোট দলে বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে। অল্প কিছু ডলার আমরা ভাঙিয়ে নিয়েছিলাম হোটেলের রিসিপশনের লাগোয়া মানি এক্সচেঞ্জ থেকে। হোটেল থেকে বেরুতেই দেখতে পেলাম রাস্তার দুই পাশে অসংখ্য দোকানপাট। রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম। পথে এক দোকান থেকে কিছুটা দামাদামি করে ‘লাকোস্টে’ ব্র্যান্ডের সাদা একটি টি-শার্ট কিনে ফেললাম। দেশের বঙ্গবাজার টাইপের দোকান, তাই এত দামি ব্র্যান্ডের টি-শার্ট খুব কম দামে পেয়ে গেলাম। দলের অন্যরাও কেনাকাটায় মশগুল। আমাদের একজন তো একটা ক্যামেরা এবং সেই সঙ্গে একটা টু-ইন-ওয়ান ক্যাসেট প্লেয়ার কিনে ফেলল। একসময় টের পেলাম যে আমরা হোটেল থেকে বেশ দূরে চলে এসেছি এবং কীভাবে ফিরতে হবে সেই রাস্তাও গুলিয়ে ফেলেছি। তার ওপর কখন যে দুপুর গড়িয়ে গেছে, সেটাও টের পাইনি। হোটেলের রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ ধরার একমাত্র ভরসা ‘টুকটুক’। ‘টুকটুক’ অবিকল আমাদের বেবিট্যাক্সির মতো বাহন। টুকটুকে চেপে যখন আমরা হোটেলে ফিরলাম, তখন দেখি নির্ধারিত রেস্তোরাঁটির লাঞ্চ আওয়ার পার হয়ে গেছে। রিসিপশন ডেস্কে এসে সেটা জানাতেই তারা আমাদের অন্য একটি রেস্তোরাঁর কুপন দেয়। সেখানে গিয়ে দুপুরে খাবার খেলাম। সত্যিই হোটেল এশিয়ার সার্ভিস ছিল অতি চমৎকার।

পরদিন সকালে আমাদের ব্যাঙ্কক টু বেইজিং ফ্লাইট। আমাদের রিসিপশন ডেস্ক থেকে বলা হলো যে সাতসকালেই এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়ার জন্য থাই এয়ারওয়েজের মাইক্রোবাস রেডি থাকবে। রিসিপশন থেকে ভোরে আমাদের ফোন করে জাগিয়ে দেওয়া হবে যাতে আমরা সময়মতো বাস ধরতে পারি। ডিনারের পর সবাই একটি রুমে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আড্ডায় মেতে উঠলাম। সদ্য কেনা ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজানো হলো বাংলা গান। নতুন দেশ দেখার উত্তেজনায় সবাই বেশ অধীর। একসময় যে যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল রিসিপশন ডেস্ক থেকে আসা ফোনে। প্ল্যান অনুসারে থাই এয়ারওয়েজের মাইক্রোবাস আমাদের পৌঁছে দিল বিমানবন্দরে। আমাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ পাসপোর্ট আর রয়েছে ঢাকা থেকে ইস্যু করা চীনের ভিসা। তাই কোনো রকম ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেলাম। এবার বিমানবন্দরে বাস আমাদের নিয়ে যাবে বিমানের সঙ্গে লাগানো সিঁড়ির কাছে। বাসে ওঠার সময় খেয়াল করলাম আমাদের বয়সী প্রায় আট-দশজন ছেলেমেয়ের আরেকটি দল সেই বাসে উঠেছে। দূর থেকে তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হলো তারা ভারতীয়। দ্বিধা সংকোচ কাটিয়ে তাদের ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম তারা কি আমদের মতো আন্ডারগ্র্যাড করতে চীনে যাচ্ছে? আমাদের দেখে তাদের মনেও একই প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছিল। তাই আগ বাড়িয়ে কথা বলাতে তারা বেশ খুশিই হলো। জানা গেল তারা নেপালি, তারাও চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে আন্ডারগ্র্যাড করতে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে তাদের সঙ্গে আমাদের বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বেইজিংয়ে।

আরও পড়ুন

সবাই বাস থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম বিমানের দোরগোড়ায়। আবারও সেই এয়ারহোস্টেসদের সাদর সম্ভাষণ ‘সা-ওয়াত-ডি কা’। আমরাও বিনয়ের সঙ্গে মাথা নুইয়ে তার প্রত্যুত্তর দিয়ে এগিয়ে গেলাম আমাদের নির্দিষ্ট সিটের দিকে। যেহেতু দুদিন আগে আমাদের প্রথম বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে, তাই এবার হাবভাব এবং চালচলনে আমরা সবাই বেশ কনফিডেন্ট। যথাসময়ে বিমান যাত্রা শুরু করল বেইজিংয়ের উদ্দেশে। চলবে....

*বেইজিংয়ের সেই দিনগুলো: পর্ব-৩

আরও পড়ুন
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]