কানাডা আগমনের নেপথ্যকথা: পর্ব-৪

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমি ধীরে ধীরে সিঙ্গাপুরের জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে শুরু করি। ইতিমধ্যে ‘ফরেন ট্যালেন্ট’ ক্যাটাগরিতে সিঙ্গাপুরের পার্মান্যান্ট রেসিডেন্সশিপ পেয়ে যাই। দুই বেডরুমের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিই ‘বুকিত পানজাং’ এলাকায়। সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী ঢাকা থেকে এসে উঠে সেই অ্যাপার্টমেন্টে। আমি এবং বউ দুজনেই অবশ্য একই ব্যাচে চীনে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়তে যাই, তার বিষয় ছিল মেডিকেল সায়েন্স। সিঙ্গাপুরে আসার কিছুদিন পরই স্ত্রী ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের মলিউকুলার বায়োলজি ডিপার্টমেন্টে ‘রিসার্চ স্কলার’ হিসেবে যোগ দেয়, তার গবেষণার বিষয় হলো ‘ক্যানসার সেল’।

আমাদের দুজনের কর্মস্থল একই জায়গায় হওয়াতে সকালে একসঙ্গে ঘর থেকে বের হতাম, প্রায়ই দুপুরে একসঙ্গে লাঞ্চ করতাম ক্যান্টিনে, আবার দিন শেষে একসঙ্গে ঘরে ফিরতাম। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমাদের একমাত্র সন্তানের জন্ম হলো সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত ‘কানডাং কারবাও’ হাসপাতালে। ঐতিহ্যবাহী এই হাসপাতালের নাম পরবর্তীকালে ইংরেজিতে রাখা হয় ‘কে. কে. উইমেন্স অ্যান্ড চিল্ড্রেন’স হসপিটাল’। আমি লক্ষ করে দেখলাম যে কালের প্রবাহে সিঙ্গাপুরের মালয় ঐতিহ্যগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক বিশ্বের অনেকের কাছেই আজ অজানা যে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ হচ্ছে ‘মালয়’–অথচ এই ভাষাকে ধীরে ধীরে করা হয়েছে গুরুত্বহীন। সিঙ্গাপুরের জাতীয় সংগীত হচ্ছে মালয় ভাষাতে। আমি সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন সেই জাতীয় সংগীতের সুরের পরিবর্তন আনা হয়—আবার অনেক ক্ষেত্রেই যন্ত্রসংগীতের আকারে জাতীয় সংগীত বাজাতে শুনেছি।

সিঙ্গাপুরকে বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রদের কাতারে নিয়ে আসতে ‘তেমাসেক হোল্ডিংস’-এর অবদান অপরিসীম।

সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রায় দুই মাস পর আমার স্ত্রী আবার তার রিসার্চের কাজ শুরু করে। আমাদের সন্তানের দেখাশোনার জন্য শরণাপন্ন হই প্রতিবেশী এক একান্নবর্তী মালয় পরিবারের কাছে। দিনের শুরুতে কাজে যাওয়ার সময় আমাদের সন্তানকে রেখে যাই সেই মালয় পরিবারের কাছে, আর দিন শেষে তাকে নিয়ে আসি আমাদের কাছে। কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা যেমন সেই মালয় পরিবারকে আপন করে নিয়েছিলাম, তারাও তেমনি আমাদের সন্তানসহ আমদের তাদেরই একজন করে নিয়েছিল। এতটাই আপন হয়েছিলাম যে সেই পরিবারের ছোট মেয়ের বিয়ের মেনুতে তাদের অনুরোধে আমি যোগ করেছিলাম শসা, টমেটো, কাঁচা মরিচ আর ধনিয়াপাতা দিয়ে বানানো একটি সালাদ। কোনো এক অজানা কারণে আমার তৈরি অতি সাধারণ এই সালাদের বিশেষ ভক্ত ছিলেন তারা। আমাদের সন্তানও তাদের একান্ত আপনজন জেনেই বড় হতে লাগল এবং ধীরে ধীরে তার মুখে মালয় ভাষা ফুটতে শুরু করল। তার সঙ্গে সঙ্গে আমার স্ত্রীও মালয় ভাষা শিখা শুরু করল। যার ফলে পানাস (গরম), বান্তাল (বালিশ), সুসু (দুধ), গিগি (দাঁত), মান্ডি (গোসল), মাকান (খাওয়া), মিনুম (পান করা) ইত্যাদি মালেয় শব্দ ধীরে ধীরে আমাদের মুখে বাংলার সঙ্গে মিশে যাওয়া শুরু করল।

সিঙ্গাপুরের অফিশিয়াল ভাষা হলো চারটি-ইংরেজি, ম্যান্ডারিন, মালয় এবং তামিল। মজার ব্যাপার হলো সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যার শতকরা ৭০ ভাগ হচ্ছে চায়নিজ, অথচ তাদের কারোরই ন্যাচরাল ল্যাঙ্গুয়েজ ম্যান্ডারিন নয়। কারণ, তাদের বেশির ভাগই দক্ষিণ চীন থেকে ভাগ্যান্বেষণে আসা চায়নিজদের বংশধর। মূলত তাদের ভাষা হক্কেইন, হাক্কা অথবা ক্যান্টনিজ, যা কি না ম্যান্ডারিন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আধুনিক সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠার পর এবং চীনের ‘ওপেন ডোর পলিসি’ গ্রহণের ফলে সিঙ্গাপুরের চায়নিজরা তাদের শিকড়ের সন্ধানে আগ্রহী হলো এবং সেটার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তারা তাদের কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ম্যান্ডারিন শিখতে এগিয়ে এল। ‘ম্যান্ডারিন ইন, ডায়ালগস আউট’ ছিল ১৯৮৩-তে সিঙ্গাপুর সরকারের নেওয়া ‘স্পিক ম্যান্ডারিন ক্যাম্পেইন’-এর স্লোগান। ২০০০ সালে সরকার চালু করে নোতুন স্লোগান-‘স্পিক ম্যান্ডারিন? নো প্রোব্লেম।’ স্কুলের কারিকুলামে ইংরেজির পাশাপাশি চালু হলো ‘মাদার টাংগ’ - চায়নিজদের জন্য ম্যান্ডারিন, মালয়দের জন্য মালয় এবং ইন্ডিয়ানদের জন্য তামিল অথবা মিনিস্ট্রি অব এডুকেশন কর্তৃক অনুমোদিত অন্য কোন ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ। মজার ব্যাপার হলো বাংলা সেই অনুমোদিত ল্যাঙ্গুয়েজ লিস্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল, ফলে আমার সন্তানের বাংলায় হাতেখড়ি হয়েছিল সিঙ্গাপুরের প্রাইমারি স্কুলে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
আরও পড়ুন

উত্তর চীনের ন্যাচরাল ল্যাঙ্গুয়েজ হচ্ছে ম্যান্ডারিন, যা কি না সব চীনের জন্য সরকারি ভাষা হিসেবে বিবেচিত। সিঙ্গাপুর সরকার বিশুদ্ধ ম্যান্ডারিন শেখানোর লক্ষে উত্তর চীন থেকে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষককে নিয়োগ দিলো বিভিন্ন প্রাইমারি স্কুলে এবং টিচার্স ট্রেনিং প্রোগ্রামগুলোতে। একই সময়ে সিঙ্গাপুরে চায়নিজ জনসংখ্যার আনুপাতিক হার যাতে কোনোক্রমেই শতকরা ৭০ ভাগের নিচে না নেমে যায়, সেই লক্ষে হাতে নেওয়া হলো ‘স্টাডি মা-মা’ নামের একটি বিশেষ প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে চীন থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি লেভেলের ছাত্রদের সিঙ্গাপুরের স্কুলগুলোতে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। ছাত্রদের সঙ্গে তাদের মাকেও কাজের অনুমতিসহ সিঙ্গাপুরে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হয়। সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হলো যে এই শিশু ও কিশোর ছাত্ররা একদিন বড় হয়ে সিঙ্গাপুরের মেইন স্ট্রিমের সঙ্গে মিশে যাবে। কিন্তু বাচ্চাদের সঙ্গে আসা মায়েদের শিক্ষাগত এবং ভাষাগত দুর্বলতার কারণে তাদের জন্য উপযুক্ত কাজের অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হতে লাগল। ফলে অনেকেই ম্যাসাজ পার্লারের মতো জায়গায় কাজ করা শুরু করল এবং নানাবিধ সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হতে লাগল। এই সময় ‘স্টাডি মা-মা’ প্রকল্পের অধীনে পড়তে আসা ‘হুয়াং না’ নামক আট বছরের একটি মেয়ের অন্তর্ধান এবং তিন সপ্তাহ পর তার লাশ উদ্ধারের ঘটনা তখন পুরো সিঙ্গাপুরজুড়ে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি করে। ‘হুয়াং না’-র হত্যাকারী মালয়েশিয়ান নাগরিক ‘টুক লেং হৌ’-কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে। যদিও সিঙ্গাপুরের ‘ক্রাইম রেইট’ উল্লেখ করার মতো কম, তারপরও সর্বত্র পুলিশ ফোর্সের সতর্কবাণী—‘লো ক্রাইম ডাজ নট মিন নো ক্রাইম’। ‘হুয়াং না’ হত্যাকাণ্ড ছিল তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

স্কুলের কারিকুলামে ইংরেজির পাশাপাশি চালু হলো ‘মাদার টাংগ’। চায়নিজদের জন্য ম্যান্ডারিন, মালয়দের জন্য মালয় এবং ভারতীয়দের জন্য তামিল অথবা মিনিস্ট্রি অব এডুকেশন কর্তৃক অনুমোদিত অন্য কোনো ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ। মজার ব্যাপার হলো বাংলা সেই অনুমোদিত ল্যাঙ্গুয়েজ লিস্টে ছিল, ফলে আমার সন্তানের বাংলায় হাতেখড়ি হয়েছিল সিঙ্গাপুরের স্কুলে।

ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুরে আমাদের বসবাসের বেশ কিছু বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। যে বিশেষ ব্যাপারটি আমাকে সব সময় উদ্দীপ্ত রেখেছে, সেটা হলো এখানকার সমাজ আমাদের তাদেরই একজন হিসেবে স্থান করে দিয়েছে। আমার মধ্যেও বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে বিশেষ করে ভাষাগত ব্যাপারে। বিশুদ্ধ ম্যান্ডারিন আমি এবং আমার স্ত্রী সেই বেইজিংয়ে পড়াকালীন সময় থেকে বলতে পারি, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষ করে কাঁচা বাজারে চায়নিজদের সঙ্গে আমরা ম্যান্ডারিনে কথা বলতাম। কাজ চালানোর মতোন মালয়ে আমাদের শেখা হয়ে গেছে তত দিনে। ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুরের ‘কলোকিয়াল’ ইংরেজিতে অভ্যস্থ হয়ে গেছি আমরা। ইংরেজির সঙ্গে মালেয় এবং ‘হক্কেইন’ শব্দজুড়ে দিয়ে সাবলীলভাবে ‘সিঙ্গলিশ’ ভাষায় আমার কথা বলা দেখে একবার এক বাংলাদেশি শ্রমিক ভাই আমাকে সিঙ্গাপুরিয়ান ভেবে বসেছিল। এদিকে দেখতে দেখতে আমাদের ‘পার্মানেন্ট রেসিডেন্সশিপ’-এর নবায়নের সময় চলে এল। সিঙ্গাপুর সরকার যদি ‘ডুয়েল সিটিজেনশিপ’-এর অনুমোদন দিত, তাহলে হয়তো এই সময়ে সিঙ্গাপুরের সিটিজেনশিপটা নিয়ে নিতাম। তার বদলে অনেকটা ‘দেখি কি হয়’ এই মনোভাব নিয়ে পরিচিত অনেক বাংলাদেশি পরিবারের দেখাদেখি আমরাও কানাডার ইমিগ্রেশন ভিসার আবেদনপত্র জমা দিলাম। সিঙ্গাপুর যদিও শক্ত একটি অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তারপরও দুটি বিশেষ কারণে কানাডা যাওয়ার চিন্তা আমার মাথায় ঢুকেছিল। এক, প্রো-চায়নিজ শিক্ষাব্যবস্থা; দুই, আমার চুক্তিভিত্তিক চাকরির নিয়োগ।

আরও পড়ুন

সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক শক্তির মূলে প্রধানত যে তিনটি সেক্টরের অবদান উল্লেখযোগ্য সেগুলো হলো সার্ভিস (বিমানবন্দর, সি-পোর্ট), ইলেকট্রনিকস (সেমিকন্ডাক্টর ফেব্রিকেশন ইন্ডাস্ট্রি) এবং কেমিক্যাল (অয়েল রিফাইনারি)। সিঙ্গাপুরের ‘চাংগি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট’ র‍্যাঙ্কিংয়ে পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিমানবন্দর। সেই সঙ্গে আধুনিক সব বিমান নিয়ে সজ্জিত সিঙ্গাপুর বিমানবন্দর বিশ্বের প্রথম সারির একটি এয়ারলাইনস। সিঙ্গাপুরে বিশ্বমানের সি-পোর্টের পাশাপাশি রয়েছে বেশ কয়েকটি শিপইয়ার্ড, যার মধ্যে ‘জুরং’ এবং ‘সেমবাওয়াং’ শিপইয়ার্ডের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানির জাহাজ এসে ভিড় করে এই দুই শিপইয়ার্ডে সার্ভিসিংয়ের উদ্দেশ্যে। ১২০ বছর আগে সিঙ্গাপুরের ‘পুলাউ বুকম’ দ্বীপে বিখ্যাত ‘শেল’ কোম্পানির প্রতিষ্ঠিত ‘কেরোসিন ডিপো’ আজ পরিণত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ‘অয়েল রিফাইনারি’-তে। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ক্রিয়েটিভ’ নামক সামান্য এক কম্পিউটার রিপেয়ারিং শপ ‘সাউন্ড কার্ড’ তৈরি করে পরিণত হয় বিশাল এক গ্লোবাল কোম্পানিতে। ‘ক্রিয়েটিভ’-এর এই অভাবনীয় সাফল্যে সিঙ্গাপুর সরকার সচেষ্ট হয় ইলেকট্রনিকস ইন্ডাস্ট্রির সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে। ফলে গড়ে উঠে সেমিকন্ডাক্টর ফেব্রিকেশনের বিশাল বিশাল প্ল্যান্ট যা সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিতে রাখে বিশেষ অবদান। অর্থনীতিকে আরও মজবুত করার লক্ষ্যে এই তিনটি সেক্টরের বাইরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠে ‘তেমাসেক হোল্ডিংস’ নামক একটি ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি। সিঙ্গাপুরকে বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রদের কাতারে নিয়ে আসতে ‘তেমাসেক হোল্ডিংস’-এর অবদান অপরিসীম। চলবে...

* কানাডা আগমনের নেপথ্যকথা: পর্ব-৫

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]