বেইজিংয়ের সেই দিনগুলো: পর্ব-১

চীন সরকারের বৃত্তিতে বেইজিং সফর। ভাষা শেখার পরে বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্টস অ্যান্ড টেলিকম্যুনিকেশনস থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন লেখক। সাত পর্বের প্রথম পর্ব আজ

‘রেড চায়না ব্লুজ’ বইয়ের প্রচ্ছদ
ছবি: লেখকের পাঠানো

২০২৪ সালের প্রথমার্ধে ফেসবুকে ‘ধূসর মস্কো’ বইটির সন্ধান দেন কোনো এক সুহৃদ। কলকাতার ‘একুশ শতক’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই বই তখন আউট অব প্রিন্ট। সেই সুহৃদের কল্যাণে বইটির একটি পিডিএফ কপিও পেয়ে যাই একসময়। বইটির লেখিকা কলকাতার মেয়ে সেরিনা জাহান ১৯৮৭ সালে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে মস্কোর বিখ্যাত প্যাট্রিস লুমুম্বা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতা বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে যান। লেখাপড়া শেষে দীর্ঘ ছয় বছর পর তিনি যখন দেশে ফিরে আসেন তখন পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে। খবরের কাগজের পাতা খুললেই তখন দেখা যেত বিশ্বজুড়ে তাদের ব্যর্থতার খবর। একদিন একটি বিশেষ খবর সেরিনাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। দিল্লিতে পুলিশি অভিযানে এক দল বিদেশি দেহপসারিণী আটকের খবর ছিল সেটি। তাঁরা সবাই ছিলেন আজারবাইজানের বাসিন্দা; যাঁদের জন্ম সোভিয়েত জমানায়। ফলে তাঁরা সবাই স্কুলে পড়ার সময় ‘কমসামোল’ বা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। এককালের সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এই নারীদের ওই দুর্দশার খবরে সেরিনা ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েন। লেনিনের নেতৃত্বে আধুনিক সমাজতন্ত্রের জনক কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের আদর্শে গড়ে ওঠা সোভিয়েত ইউনিয়নের এই পরাজয়কে তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। তারই ফলে তিনি তাঁর মস্কো জীবনের স্মৃতিকথা নিয়ে ‘ধূসর মস্কো’ বইটি লেখেন। বইটির উৎসর্গপত্রে তিনি লেখেন, ‘মস্কোর ছয় বছর। দিনগুলো—গ্রীষ্মের নীল আকাশ, বার্চগাছগুলো আর মহামতি লেনিনকে।’

লেনিনকে সেরিনা মহামতি বলে সম্মানিত করেছেন বোধ হয় এ কারণে যে লেনিন–মার্ক্সের মৃত্যুর ৩৪ বছর এবং এঙ্গেলসের মৃত্যুর সাত বছর পর তাঁদের রচিত তাত্ত্বিক সমাজতন্ত্রের আদর্শকে বাস্তবে রূপদান করেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ফলে সমাজতন্ত্র আর মানবকল্যাণকামীদের স্বপ্নবিলাস রইল না, বাস্তব সমাজজীবনে পরিণত হয়। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ভাষী ১৫টি অঙ্গরাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীতে একটি সুপারপাওয়ার বা পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। যার স্বীকৃতি মিলেছিল ১৯৫৯ সালে যখন তখনকার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবিষয়ক এক আলোচনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রিমিয়ার নিকিতা ক্রুশ্চেভকে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু সেই স্বীকৃতির অবসান ঘটে ১৯৯১ সালে, যখন মিখাইল গর্বাচেভের অনুরোধ উপেক্ষা করে তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ ইরাকে আক্রমণ চালান। সেরিনা তখন প্যাট্রিস লুমুম্বা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতা বিভাগের পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী। ইরাক যুদ্ধের প্রসঙ্গে ক্লাসে সেদিন তাঁদের শিক্ষিকা আনা ইভগেনিয়েভনা বলেছিলেন যে ‘এই যুদ্ধে কার কী ক্ষতি হলো জানি না; কিন্তু সারা পৃথিবীর সামনে একটি সত্য পরিস্কার হয়ে গেল যে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আর সুপারপাওয়ার হিসেবে গণ্য করে না আমেরিকা।’ এরপর আরও দুই বছর মস্কোয় ছিলেন সেরিনা। দেখেছেন কীভাবে ধীরে ধীরে তাঁর স্বপ্নের সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেল। তাই তো তিনি বইটির ভূমিকায় আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘সৃষ্টিমুহূর্তে আমি ছিলাম না। ধ্বংসমুহূর্তে সাক্ষী রইলাম। ... ছয় বছর ধরে একটু একটু করে দেখলাম।’

প্রথম দিকে আমি চীনের নিজস্ব রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন ছিলাম; কিন্তু সেই উদাসীনতায় ছেদ পড়ে যখন ১৯৮৯ সালে চোখের সামনে ধীরে ধীরে মঞ্চস্থ হওয়া শুরু করে তিয়েনআনমেনের ছাত্র আন্দোলন।

আমি একনিশ্বাসে পড়ে শেষ করেছি ‘ধূসর মস্কো’ বইখানি। কারণ, আমি অনেক ক্ষেত্রেই নিজের সঙ্গে লেখিকার মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম। লেখিকা যে বছর সোভিয়েত ইউনিয়নে যান, আমিও সেই বছর অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আন্ডারগ্র্যাড করার জন্য বেইজিংয়ে যাই। তবে অমিলটুকু হচ্ছে, লেখিকা সেরিনা জাহান সমাজতন্ত্রের প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং অপরিসীম ভালোবাসা নিয়ে মস্কোয় গিয়েছিলেন আর বেইজিং যাওয়ার সময় আমার ছিল না সে রকম কোন আত্মিক দায়বদ্ধতা। ফলে আমি সম্পূর্ণ খোলা মন নিয়ে শুধু উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যেই চীনে যাই। এ কারণে পক্ষপাতিত্বহীনভাবে চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটকে বিশ্লেষণ করার সুযোগ পেয়েছি। প্রথম দিকে আমি চীনের নিজস্ব রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন ছিলাম; কিন্তু সেই উদাসীনতায় ছেদ পড়ে যখন ১৯৮৯ সালে চোখের সামনে ধীরে ধীরে মঞ্চস্থ হওয়া শুরু করে তিয়েনআনমেনের ছাত্র আন্দোলন। আমি তখন এক বছরের চীনা ভাষাশিক্ষার ডিপ্লোমা শেষ করে আমার মূল কোর্স কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফার্স্ট ইয়ারের সেকেন্ড সেমিস্টারের ছাত্র। আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন চীনের বর্ষীয়ান নেতা দেং শিয়াওপিং কঠোর হাতে মিলিটারি দিয়ে এক রাতের মধ্যেই ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে ময়দান ফাঁকা করে দেন। এই তিয়ানআনমেন স্কয়ার ম্যাসাকারের ঘটনা, তখন সারা দুনিয়ায় বেশ তোলপাড়ের সৃষ্টি করে। এর কিছুদিন পর বার্লিন প্রাচীর ভাঙার মাধ্যমে দুনিয়ায় কমিউনিজমের পতন শুরু হয় এবং একসময় ঠান্ডা যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ারের পরিসমাপ্তি ঘটে। দুনিয়া থেকে যখন এক এক করে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পতন হচ্ছিল, তখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা প্রখর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে চীনে কমিউনিজমকে শুধু টিকিয়েই রাখেননি, চীনকে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী একটি দেশে পরিণত করেছিলেন। তিয়েনআনমেন ঘটনার পর চীন কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করল। সেই বদলটা ছিল খুব সূক্ষ্ম ও ধীর; তবে বিরামহীন। সেই ধারাবাহিকতায় চীন আজকের বিশ্বমঞ্চে নতুন এক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। লেখিকা সেরিনা জাহানের সঙ্গে আমার মিল হচ্ছে, তিনি একটি পরাশক্তির পতন খুব কাছ থেকে দেখেছেন, আর আমি নতুন এক পরাশক্তির উত্থান দেখেছি খুব কাছ থেকে।

আরও পড়ুন

১৯৮৫ সালে সেরিনা যখন লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, তখন তাঁর পরিচয় ঘটে মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্র এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে। সেই থেকে তিনি সমাজতন্ত্রের প্রেমে পড়ে যান। ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’, ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’, ‘পরিবার, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিগত মালিকানা’ ইত্যাদি লাল মলাটের মার্ক্সীয় সাহিত্যের সঙ্গে যতই তাঁর ঘনিষ্ঠতা হতে থাকে, ততই তাঁর মনে সমাজতন্ত্র পৃথিবীর মজলুম মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ—এই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে। লেডি ব্র্যাবোর্নের লাইব্রেরিতে বই ঘাঁটাঘাঁটি করার ফাঁকে তিনি চোখ বুলাতেন রাশিয়া থেকে আসা ‘সোভিয়েত নারী’সহ তেল চকচকে অন্যান্য পত্রিকার পাতায়। সেসব ম্যাগাজিনের পাতাজুড়ে ছিল সুখ–সমৃদ্ধিতে ভরপুর মানুষের নিশ্চিন্ত জীবনের ছবি। আরও ছিল শুভ্র বরফে ঢাকা মস্কো, সাইবেরিয়া কিংবা লেনিনগ্রাদ শহরের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। সেসব ছবি দেখে যে কারোই মনে হবে, এ যেন এক স্বর্গপুরী। সেই সময় থেকেই তিনি একই সঙ্গে সমাজতন্ত্র ও রাশিয়ার প্রেমে পড়ে যান। মস্কো তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সেরিনা জাহান যেমন সোভিয়েত নারী কিংবা অন্য সব সোভিয়েত পত্রিকা হাতে পেয়েছিলেন, তেমনি আমিও সেসব সোভিয়েত পত্রিকার পাশাপাশি চায়না পিকটোরিয়ালের দেখা পেয়েছিলাম। তবে তাঁর মতো কলকাতার লাইব্রেরিতে বই ঘাঁটাঘাঁটি করার সময় নয়, ঢাকার বইয়ের দোকানে। তখন সেসব দোকানে বইয়ের পাশাপাশি এ ধরনের ম্যাগাজিন পাওয়া যেত। এই ম্যাগাজিনগুলোর চকচকে পাতা আমরা আমাদের পাঠ্যপুস্তকের মলাট লাগানোর কাজে ব্যবহার করতাম। উন্নতমানের কাগজে ছাপা চায়না পিকটোরিয়াল ছিল এই ম্যাগাজিনগুলোর মধ্যে অন্যতম। কমিউনিস্ট চীনের প্রোপাগান্ডামূলক এই ম্যাগাজিনে থাকত, সেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ওপর বিভিন্ন সচিত্র প্রতিবেদন। মলাট লাগানোর জন্য কেনা চায়না পিকটোরিয়ালের মাধ্যমে চীন নামক দেশের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তখনো মৈত্রীয় দেবীর ‘অচেনা চীন’, শেখ মুজিবুর রহমানের ‘আমার দেখা নয়াচীন’, মনোজ বসুর ‘চীন দেখে এলাম’ কিংবা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ‘মাও সে-তুংয়ের দেশে’ বইগুলো আমার পড়া হয়নি। তাই লৌহযবনিকার আড়ালে থাকা দেশটির প্রকৃত স্বরূপ তখনো জানা হয়ে ওঠেনি। তবে সেই ম্যাগাজিনগুলোর ঝকঝকে ছবিগুলো আমার মনে চীন সম্পর্কে গভীর আগ্রহের সৃষ্টি করে। এই আগ্রহের কারণেই হয়তো আমি উচ্চমাধ্যমিকের পর চীন সরকারের শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পাড়ি জমাই বেইজিংয়ের উদ্দেশে।

ম্যাগাজিনগুলোর চকচকে পাতা আমরা আমাদের পাঠ্যপুস্তকের মলাট লাগানোর কাজে ব্যবহার করতাম। উন্নতমানের কাগজে ছাপা ‘চায়না পিকটোরিয়াল’ ছিল এই ম্যাগাজিনগুলোর মধ্যে অন্যতম। কমিউনিস্ট চীনের প্রোপাগান্ডামূলক এই ম্যাগাজিনে থাকত সেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ওপর বিভিন্ন সচিত্র প্রতিবেদন।

তবে আমার বেইজিংয়ে যাওয়াটা ছিল নিতান্তই কাকতালীয়। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার তখনো অনেক দিন বাকি। রেজাল্টের পরেই কেবল বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে। হাতে অখণ্ড অবসর। তবে এই অবসরেই নিজেকে তৈরি করতে হবে সেই সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতে সফল হওয়ার জন্য। ঠিক করলাম ছাত্র পড়াব, এতে শুধু রোজগারই হবে না, আমার ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিও হবে। যাকে বলে এক ঢিলে দুই পাখি। প্রথমে আমাদের পাড়ার মধ্যেই বন্ধুর ছোট ভাই বা বোনকে দিয়ে শুরু, তারপর দেখি দূরদূরান্ত থেকেও ছাত্র আসা শুরু হলো। আমাকেও কেমন যেন নেশায় পেয়ে বসল—ইন্টারমিডিয়েট ছাত্রদের ব্যাচ–পদ্ধতিতে; আর নিচু ক্লাসের ছাত্রদের এককভাবে টিউশনি পড়াতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার হাতে অবসর বলতে আর কোনো সময় নেই। এরই মধে৵ একদিন পরীক্ষার রেজাল্ট দিল। ঢাকায় বসে রাজশাহী বোর্ডের রেজাল্ট সংগ্রহ করাটা বেশ দুরূহ ছিল তখন। আমাদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় লিটু মামা রেজাল্ট নিয়ে এলেন—সম্মিলিত মেধা তালিকায় সপ্তম। আমার জীবনে এ রকম আনন্দ আমি খুব কমই পেয়েছি।

একসময় শুরু হলো সেই কাঙ্ক্ষিত ভর্তি পরীক্ষা। আমি বুয়েট ছাড়া অন্য কোনো পরীক্ষার ব্যাপারে তেমন সিরিয়াস ছিলাম না, তার পরেও মেডিকেল, ডেন্টাল কলেজ, ঢাকা ও জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটি—সবগুলোতেই পরীক্ষা দিয়ে চান্সও পাই। তবে ভর্তি হলাম শুধু বুয়েটে। বুয়েটে তখন সেশনজটের সমস্যা প্রকট। কবে ক্লাস শুরু হবে, সেটি অনিশ্চিত। বুয়েটে ভর্তি হওয়ার সুবাদে আরও কিছু ছেলের সঙ্গে পরিচয় হলো, যারা আমার সঙ্গেই ভর্তি হয়েছে। তাদের সঙ্গেও মাঝেমধে৵ দেখা হয়, আড্ডা হয়। আমাদের আড্ডায় তখন প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল, কবে ক্লাস শুরু হবে। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে যে আমাদের ব্যাচ আর আমাদের পরবর্তী ব্যাচের অর্থাৎ ’৮৬ এবং ’৮৭-এর ইন্টারমিডিয়েট ব্যাচের ক্লাস শুরু হবে একসঙ্গে ১৯৮৮ সালে। পরে অবশ্য এই গুজবই সত্য হয়েছিল। বুয়েটে যাঁরা চান্স পেয়েছে, তাদের অনেকেই বসে না থেকে বিএসসি পাস কোর্সে ভর্তি হচ্ছে শুনতে পেলাম। কী করব এই সেশনজটের সময়টায়, তা নিয়ে ছিল এক বিরাট অনিশ্চয়তা। অনিশ্চয়তার এ সময়ে আমার একদিন চোখে পড়ল খবরের কাগজে প্রকাশিত গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকারের শিক্ষাবৃত্তির বিজ্ঞাপন।

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আরও পড়ুন

চীন সরকারের বৃত্তির জন্য আবেদনপত্র জমা দেওয়ার কিছুদিন পরেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে হলুদ রঙের খামে ‘সরকারি কাজে ব্যবহৃত’ ছাপযুক্ত একটি চিঠি এসে হাজির বাসায়। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ‘সাংস্কৃতিক বিনিময়’ নামক দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় চীন সরকার এই শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে থাকে। এই বৃত্তির অধীন বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের জন্য চীনের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভিন্ন শাখাসহ, মেডিকেল, ডেন্টিস্ট্রি এবং ফাইন আর্টস বিভাগে স্নাতক পর্যায়ের পড়ার সুযোগ থাকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেই চিঠিতে আমাকে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরীক্ষার স্থান ‘ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ’। ঢাকা কলেজ লাগোয়া এই কলেজ। চিঠিতে উল্লেখ ছিল যে ফিজিকস, কেমিস্ট্রি ও ম্যাথ—এই তিন সাবজেক্টের ওপর পরীক্ষা হবে। একটানা টিউশনি করার কারণে আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট লেভেলের বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে বিশেষ পারদর্শী। তাই আলাদা কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই নির্দিষ্ট দিনক্ষণে পরীক্ষার হলে গিয়ে উপস্থিত হলাম। হলে গিয়ে দেখি, আমার ক্যাডেট কলেজের চার সহপাঠীও সেখানে উপস্থিত। ফ্রি-সিটিং ব্যবস্থার কারণে যখন নিজের জন্য একটা সিট খুঁজছিলাম, তখন আমার দুই সহপাঠী ডেকে নিয়ে তাদের পাশে বসাল। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে বুঝতে পারলাম যে আমাদের সিলেবাসের পড়ার সঙ্গে তেমন কোনো মিল নেই প্রশ্নগুলের। নিজের জ্ঞানের সঙ্গে যোগ করতে হবে তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণক্ষমতা। পরে জানতে পারি যে চীনে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেই আমাদের চীন দূতাবাস এই পরীক্ষা নিচ্ছে। কঠিন সেই প্রশ্নপত্রের উত্তর করতে গিয়ে আমার ঘাম ছুটে গিয়েছিল সেদিন। দুই দিন পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গেটের দেয়ালে পরীক্ষার ফল সেঁটে দেওয়া হয়। দুরু দুরু বুকে সেখানে উপস্থিত হয়ে মেধাতালিকার তিন নম্বরে নিজের নাম দেখে একটি গভীর তৃপ্তি লাভ করি। এই ফলাফল আমার কাছে ছিল পরীক্ষায় আমার নিজের বিশ্লেষণী ক্ষমতার স্বীকৃতি। সেটিই ছিল আমার এই তৃপ্তির কারণ। তালিকায় প্রথম স্থান দখল করে যে ছেলেটি, তার নাম শেখ শমশের আলী, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ। পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে আমি চারটি বছর কাটাই একই রুমে ‘বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন’-এ। আমরা দুজনই কম্পিউটার প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করি সেখান থেকে।

‘ধূসর মস্কো’ বইয়ের প্রচ্ছদ
ছবি: লেখকের পাঠানো

চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত ১০ ছাত্র-ছাত্রীকে মগবাজারে চীনা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার জন্য লোক দ্বারা আমন্ত্রণপত্র পাঠায় চীন দূতাবাস। যথাসময়ে সেখানে উপস্থিত হলে আমাদের অভ্যর্থনা জানান দূতাবাসের প্রথম সচিব ‘ইয়াও পাও লাই’। সেখানে তিনি আমাদের জন্য একটি ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের আয়োজন করেন। আমাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নেওয়ার জন্য তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত বেশ কিছু চীনা ছাত্রছাত্রীকেও এই ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেসব ছাত্রছাত্রীর মুখে বাংলা কথা শুনে আমরা বেশ আশ্চর্য বোধ করি। তারা আমাদের ভরসা দেয় যে আমরাও চীনা ভাষা বেশ সহজেই শিখে ফেলতে পারব। আমাদের চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের ওপর একটা নাতিদীর্ঘ ডকুমেন্টারি দেখানো হয়। সেখানকার উল্লেখযোগ্য স্থান; যেমন গণচীনের প্রশাসনকেন্দ্র তিয়েনআনমেন স্কয়ার, চীনের শেষ সম্রাটের আবাসস্থল ফরবিডেন সিটি, তার গ্রীষ্মকালীন অবকাশযাপন কেন্দ্র সামার প্যালেসসহ বিভিন্ন পার্কের নয়নাভিরাম দৃশ্য আমাদের মোহিত করে তোলে। তা ছাড়া আধুনিক চীনের জনসাধারণের জীবনযাত্রাকেও দেখানো হয় সেই ডকুমেন্টারিতে। এই ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম আমাকে চীন সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। আমি চীনে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। যদিও সেই সময়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশে চীনের তেমন কদর ছিল না। কমিউনিস্ট দেশের ডিগ্রি আমাদের দেশে কতখানি গ্রহণযোগ্য হবে, সেই বিষয়ে আমার পরিচিত অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। তার পরও আমি মনে মনে প্রস্তুত হলাম চীনে যাওয়ার জন্য।

আরও পড়ুন

সেরিনা জাহানের ‘ধূসর মস্কো’ যেমন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, আমার বেইজিংয়ের স্মৃতিকথা লিখতে, তেমনি ‘জেন ওং’-এর ‘রেড চায়না ব্লুজ’ বইটিও আমাকে সমানভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। টরন্টো ডাউনটাউনের একটি পুরোনো বইয়ের দোকানে আমি নিয়মিত ঢুঁ মারি সস্তায় ভালো বই কেনার জন্য। সেখানেই একদিন (২০২২ সালের মাঝামাঝি) ‘রেড চায়না ব্লুজ’ বইটির সন্ধান পাই। মাত্র ১৯ বছর বয়সে মাও সে–তুংয়ের হাতে গড়া ‘রেড চায়না’র প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ১৯৭২ সালে এক সংক্ষিপ্ত সফরে বেইজিং যান কানাডার মন্ট্রিয়ালে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা তৃতীয় প্রজন্মের চায়নিজ-কানাডিয়ান জেং ওং। সেই সফরে থাকাকালে তিনি বেইজিং ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য আবেদন করেন। তবে তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে তার আবেদন নাকচ হয়ে যাবে; কিন্তু তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তার আবেদন মঞ্জুর করে। পরে তিনি অবশ্য জানতে পারেন যে তার অ্যাপ্লিকেশনটি চীনের প্রিমিয়ার চৌ এনলাই পর্যন্ত পৌঁছায় এবং তিনি তা অ্যাকসেপ্ট করেন। জেন ওং কমিউনিস্ট চায়নার প্রথম ব্যাচের দ্বিতীয় ফরেন স্টুডেন্ট হওয়ার বিরল সুযোগ লাভ করেন। প্রথম স্টুডেন্টটি ছিল চায়নিজ বংশোদ্ভূত একজন আমেরিকান।

চীন অবশ্য এই ফরেন স্টুডেন্টশিপ চালু করেছিল অনেকটা পরীক্ষামূলকভাবে। চীন সরকারের সেই পরীক্ষা নিশ্চয়ই সফল হয়েছিল। কারণ, তারই ধারাবাহিকতায় ঠিক ১৫ বছর পর আমি ১৯৮৭ সালে কমিউনিস্ট চায়নার ফরেন স্টুডেন্টশিপের সুযোগ লাভ করি। সেরিনা জাহানের মতন জেন ওং-এরও স্বপ্ন কিন্তু পূরণ হয়নি। যে শোষণহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখে তিনি চীনে এসেছিলেন, সেই সমাজকে চীনের কোথাও তিনি খুঁজে পাননি। যে মহান মাও সে–তুংয়ের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে তিনি চীনে এসেছিলেন, সেই মাও সে–তুংয়ের দেখা তিনি কোথাও পাননি। একসময় তার মোহমুক্তি ঘটে। পিকিং ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েট সার্টিফিকেটের বদলে তিনি যে সেখানকার সব কোর্স শেষ করেছেন, সেই সার্টিফিকেটটি নিয়ে তিনি চীন ত্যাগ করেন ১৯৮০ সালে। অবশ্য তিনি পরে সাংবাদিক হয়ে আবার বেইজিংয়ে আসেন ১৯৮৮ সালে। দেং শিয়াও পিংয়ের চীন তখন বদলে গেছে অনেকখানি। ১৯৮৯ সালে ছাত্ররা অধিকতর গণতন্ত্রের দাবিতে তিয়েনআনমেন চত্বরে এসে হাজির হয়। আমিও সেই উত্তাল সময়ে চীনা ছাত্রদের পাশাপাশি হাজির হতাম তিয়েনআনমেন স্কয়ারে। জেন ওং তখন কানাডার সংবাদ সংস্থা সিবিসির সাংবাদিক হিসেবে সেই সব খবর কাভার করতেন। সেই সব অভিজ্ঞতা নিয়েই লিখেছেন ‘রেড চায়না ব্লুজ—মাই লং মার্চ ফ্রম মাও টু নাও’। জেন ওংয়ের সঙ্গে আমার মিল এখানেই যে আমরা দুজনই একই সময়ে বেইজিংয়ে ছিলাম এবং তিয়েনআনমেনের ছাত্র আন্দোলনকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি। চলবে...

*আগামীকাল প্রকাশ করা হবে: বেইজিংয়ের সেই দিনগুলো: পর্ব-২

*বি. দ্র.: ‘ধূসর মস্কো’ এবং ‘রেড চায়না ব্লুজ’ বই দুটি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে ‘বেইজিং-এর স্মৃতিকথা’ লিখতে।

আরও পড়ুন