গাড়ি চালনার যত কেচ্ছা: কানাডা পর্ব ৫

বরফে ঢাকা শীতের একদিন
ছবি: লেখক

আপাতত উপায়ান্তর না দেখে সোজা রাস্তা ধরে যাচ্ছি। এ নির্জন জায়গায় একটু নিশ্চিন্তে গাড়ি চালাব, সেটারও জোগাড় নেই। পেছন পেছন একটা গাড়ি বেশ কিছুক্ষণ হলো ফলো করে চলেছে। কোথাও থামিয়ে যে আশপাশের জায়গাগুলো একটু ম্যাপে দেখব, সেটাও সম্ভব নয়। পরে ভেবে নিলাম কোনো জায়গায় মোড় পেলে ওদিকেই গাড়ি সাইড করে নিতে হবে। এভাবে বেশ কয়েকটা মোড় এলেও আমি ইন্ডিকেটর লাইট দিতে ভুলে যাচ্ছিলাম বারবার। আর পেছনের গাড়িটা সেই কখন থেকে পুলিশের গাড়ির মতো অনুসরণ করে চলার জন্য সামনে তাকিয়ে চালানো ছাড়া আর অন্য কোনো পথ ছিল না।

এভাবে ১৫ মিনিট চলার পর পেছনের গাড়ি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল আর আমি কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকটা গাড়িকে রেয়ার ভিউ উইন্ডোতে দেখতে পেলাম। ক্রমাগত ২০ মিনিটের পথ এগিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ রাস্তার বাঁ দিকের এক জায়গায় একটা কনভেনশন সেন্টার দেখতে পেলাম, যেটা আমার চেনা। বাসে নর্থ সিডনি যাওয়ার পথে এটা চোখে পড়েছে। এতক্ষণ পর সুবিশাল সমুদ্রে ডুবন্ত নাবিকের ভেলা পাওয়ার মতো নিজের বাড়ি যাওয়ার মূল পথ খুঁজে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিলাম! এটা সিডনি রিভার ওয়ালমার্টের একদম কাছাকাছি। কয়েক সপ্তাহ আগেই আমি, শাহরুখ এখানে এসেছিলাম। গত পর্বের আগের পর্বে লিখেছি।

ওখানে পৌঁছানোর পর বাকি রাস্তা বেশ সহজে পাড়ি দেব মনে করলেও বিপত্তি বাধল নর্থ সিডনির রাস্তা থেকে সিডনি রিভারের রাস্তায় আসার সময় মোড় নিতে গিয়ে। খুব সম্ভবত আমার গাড়ি পথ বদলে এক দিকের রাস্তা থেকে অন্য দিকের পথে মোড় নিয়েছে। এবারও পেছনের গাড়ির বেশ সজোরে হর্ন হাঁকানোর শব্দে টনক নড়ল! ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমি চলে গিয়েছি নিজ পথে আর ওই গাড়ি ও খুব সম্ভবত আমার পেছন পেছন আসছিল। ড্রাইভিংয়ের মূল সমস্যাটা এখানেই—কোথায় ভুল হলো, কেন হলো কিছুই বুঝতে পারিনি। যতটা পারলাম পুরোটাই আন্দাজের ওপর। মুহূর্তের মধ্যেই সব ঘটে গেল, এর আগে নর্থ সিডনি যাওয়ার সময়ও একই ঘটনা ঘটেছিল। নিশ্চয়ই মনে আছে সবার। পেছনের গাড়িটা একইভাবে হর্ন দিয়ে সতর্ক করেছিল। যা-ই হোক এভাবেই এক রাতে সহজ গন্তব্যে বাসায় ফেরার পরিবর্তে কোনো এক অজানা পথে হারিয়ে গিয়েছিলাম।

আরও পড়ুন

এরপরের ঘটনা আরও রোমাঞ্চকর। আরেক রাতে আমার গাড়িতে সিডনির বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়েকে লিফট দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। ওই রাতে গাড়িসংকট। আমার পাশের সিটে আকিব আর পেছনের সিটে জেরিন, আসলিন, নন্দানা আর সিবু। এর মধ্যে জেরিন, আসলিন এক জায়গায় থাকে। নন্দানার জন্য একটু ঘুরে যেতে হবে আর পথেই বাকিদের জায়গা করে নামিয়ে দিতে পারব। আমি রাস্তা মনে মনে আগেই ঠিক করে নিয়েছি। যে রাস্তায় এর আগে পথ হারানোর গল্প শোনালাম একই পথ ধরে যেতে হবে আমাদের। জেরিন আর আকিব পূর্ব অভিজ্ঞতার সূত্রে আমার ড্রাইভিংয়ের হযবরল-এর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল, বাকিরা অতটা না। আমি আগেই সবাইকে নিজের অনভিজ্ঞতার কথা জানালাম। যাতে নিজে মানসিকভাবে স্বস্তিতে থাকি। তবে অন্যরা এটা শোনার পর কতটা স্বস্তিতে ছিল তা বলা মুশকিল।

আরও পড়ুন
তুষারঝড় - মহাদুর্যোগ

এক্সিট ফাইভে এর আগে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাই নিজের পাশাপাশি যেন সতর্ক থাকে ওরাও। প্রতিদিন একই রাস্তায় এলেও ওই রাতে এত যাত্রী নিয়ে ড্রাইভিংয়ে প্রথমবার। বারবার কেন যেন অজানা শঙ্কা মনের কোণে উঁকি দেয়। ভাবছিলাম গতকালও তো এলাম, আজ আর বিশেষ কী? ওরা টুকটাক কথা বলছিল। কাছাকাছি আসার পর আমি সজাগ থাকা সত্ত্বেও জেরিনকে আগেই বলেছিলাম আরেকটু  সতর্ক করে দিতে। জানি না ও কী ভাবছিল। আমরা সবাই মোটামুটি অ্যালার্ট ছিলাম। সামনের দিকে মূলত একটা পর্যায়ে এসে ডান দিকের রাস্তা থেকে কিছুটা সরে এসে সোজা চালাতে হবে গাড়িটা।  কিন্তু তখন এগোতে এগোতে হঠাৎই সামনে হলুদ রঙের বিভাজক দেখতে পেয়ে আচমকা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ডানে রাস্তায় নিয়ে পরিস্থিতির সামাল দিই! পাশের সিটে বসা আকিব বলে উঠল, ‘আরেকটু হলে আপনার গাড়ি উল্টে যেত!’ পেছন থেকে জেরিন বেশ ভালোভাবেই টের পেল ভুলটা মূলত ওর কারণেই হয়েছে। ও বারবার বলে যাচ্ছিল কোনো সমস্যা নেই। এখান থেকে  রাস্তা ওর জানা আছে। রাস্তার দিক পাল্টে গেলেও কেন অসুবিধা হবে না। হলোও সেটা। ওর দেওয়া ডিরেকশন ফলো করে এগিয়ে গেলাম সবাইকে নিয়ে। এরপর সিডনির এক্সিট ফাইভ খুঁজে পেলাম। মোটামুটি একটা উল্টে যাওয়া গাড়িকে ওই দিন কীভাবে রাস্তায় রেখেছিলাম, সেটা আজও আমার কাছে আশ্চর্যজনক! সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটে যাওয়া ওই ঘটনা মনে হয় না গাড়িতে যারা ছিল কেউ কখনো ভুলতে পারবে।

আরও পড়ুন

কখনো আমরা কোনো বিষয়ে অন্য কারও ওপরে নির্ভর করে বসলে বিপদে পড়তে পারি। ওই রাতের ঘটনায় সেটা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ দিয়েছিল। একটা পর্যায়ে বুঝতে পারছিলাম কাছাকাছি চলে এসেছি তখন নিজে থেকেই আরেকটু সজাগ হলেই হয়তো কিছুই হতো না। কিন্তু ওই যে নির্ভরশীলতা আর তা যদি হয় বিশ্বস্ত তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই!

এর মধ্যে বেশ কয়েকবার অসম্ভব বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও ড্রাইভিং করেছি। যখন সামনে রাস্তা দেখা যায় না, তারপরও ড্রাইভিং করেছি। (ক্রমশ)

আরও পড়ুন