গাড়ি চালনার যত কিচ্ছা: কানাডা পর্ব ৪

লেখকের নিজের গাড়ি
ছবি: লেখক

সুমনকে বলাতে ও সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেল। বরাবরই যখনই বিপদে ওকে জানিয়েছি, ও কখনো না করেনি পারতপক্ষে। ঠিক হলো, পার্কিংয়ের জায়গায়ই ট্রেনিং সেশন চলবে। আপাতত রাত ১০টার দিকে। অন্য সময় পরে ঠিক করে নেওয়া যাবে। কবে নাগাদ শুরু করলাম, সেটা মনে নেই। তবে আমার চেয়েও বেশি টেনশনে ছিল সুমন নিজেই। গাড়ি চালানোর সময় কী কারণে ঠিক জানা নেই, তবে আমি বেশ কয়েকটা ভুল করে বসলাম। সোজা চালিয়ে যাচ্ছিলাম গাড়ি, একটা জায়গায় লেন চেঞ্জ করে বাঁ পাশ থেকে ডানে আসার সময় রেয়ার উইন্ডোতে দেখলেও পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা যাকে  বলে ‘চেক দ্য ব্লাইন্ড স্পট’ করতে ভুলে যাওয়ায় পাশের গাড়িটা দেখতে পাইনি। ওই গাড়ির চালকের আচমকা আমার এমন অবস্থা দেখে বেশ সজোরে হর্ন বাজাল! কানের পাশ ঘেঁষে তির চলে গেল। একবার ওই গাড়ির সঙ্গে লেগে গেলে কত যে ঝক্কি–ঝামেলা হতো, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ইনস্যুরেন্স, পুলিশ, এরপর গ্যারেজে ঠিক করতে দাও, অপেক্ষায় থাকো কবে ফেরত পাবে, এরপর অনেক ক্ষেত্রে ও রকম দাগ পড়ে গেলে ওই গাড়ি আবার বিক্রি করাও কঠিন হয়ে যায়। মোটা দাগে অনেক লম্বা লিস্ট।

সুমনের হতাশামিশ্রিত ভিতু চেহারা দেখার মতো অবস্থায় ছিলাম না! তবে ও পাশ থেকে অনেক রকম শব্দ, ‘হায় খোদা, কী যে হবে?’ এসব শুনতে পাচ্ছি। ড্রাইভিংয়ের শুরু থেকেই একটা বিষয় সব সময় সমস্যা হয়েছিল—আমাকে ভীষণ রকম মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাতে হতো। কোনো দিকেই তাকানোর জো ছিল না। একদৃষ্টে রোবটের মতো সোজা হয়ে বসে একটা দম বন্ধ হয়ে আসা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ড্রাইভিং করতাম! অথচ আমাদের অন্য ছেলেরা কত অনায়াসেই এই চতুর্চক্র যানটিকে টেনে নিয়ে যেত, যেখানে যখন মন চাইত সেখানে।

ওয়ালমার্টের বিশাল পার্কিং
ছবি: লেখক

আমার ভুলের পরিপ্রেক্ষিতে সুমনের আরও সতর্ক অবস্থান, ও হ্যান্ড ব্রেকে হাত দিয়ে বসে রইল। যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে হ্যান্ড ব্রেকের প্রয়োজন আছে। এতে হাত রেখে ওপরে হেঁচকা টান দিলেই খেল খতম—গাড়ি আর কোনো অবস্থাতেই সামনে এগোবে না! তবে যদি হ্যান্ড ব্রেক পুরোনো হয় তাহলে হয়তো না দাঁড়ালেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমরা বাসা থেকে একসেস নোভা স্কসিয়ার পথে যাচ্ছিলাম। এসব টুকটাক বেগতিক কাণ্ড ঘটে যাওয়ার পরে ওখানে গিয়ে পৌঁছালাম। গাড়ি পার্কিংয়ে দাঁড় করিয়ে নিতে বলল ও। মূল ভবনের পেছনে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়িটা নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে সামনের ওই জায়গায় পার্কিং করল যেমনটা মূল ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষায় করতে হবে। রিভার্স পার্কিংও দেখিয়ে দিল। এবার আমার পালা। ওই চত্বরে দুই ধরনের গতিসীমায় গাড়ি চালাতে হয়। সামনে-পেছনে ১৫-২০ কিলোমিটারের বেশি না। যদি মূল পরীক্ষায় এর বেশি হয়ে যায়, তো পয়েন্ট কর্তন শুরু। প্রতি ভুলের মাশুলে আপনার পাঁচ নম্বর করে কাটা পড়বে আর আপনি পাঁচবারের বেশি ভুল করলে আবার কেঁচে গণ্ডূষ! সুমন বলে যাচ্ছে এসব তথ্য। ওর কথায় মনোযোগী হওয়ায় গাড়ির গতি গেল কমে। তাতেও ফেল করিয়ে দেবে পরিদর্শক। গতি নির্দেশক চিহ্নে উল্লেখিত সীমা হুবহু না হলে পয়েন্ট কর্তন বা ফেল! কাজেই বিষয়গুলো খুব সোজাসাপ্টা। জলের মতো পরিষ্কার! সেটা পাস হোক বা ফেল।
তখন মনে হচ্ছিল আমি সত্যি সত্যিই পরীক্ষা দিচ্ছি। তবে ওই সময় গাড়ি চালানো ঠিক ছিল। প্রথমে ভুলভালের কারণে হয়তো। আমরা আধা ঘণ্টার মতো ওখানে গাড়ি চালিয়ে বাসার পথে রওনা দিলাম। ঘড়িতে প্রায় রাত ১২টা বাজে।

পথে তেমন একটা গাড়ি না থাকায় আর কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি।
সপ্তাহখানেক চাকরি চালিয়ে যাওয়ার পর ভেবে দেখলাম, এভাবে অনুশীলন চললেও যে মূল উদ্দেশ্যে গাড়ি কিনেছি, সেটা থেকে অনেক দূরে আছি। লক্ষ্য অবশ্যই ছিল গাড়ি চালিয়ে বাসা থেকে ওয়ালমার্টের ২৫ কিলোমিটার দূরের পথ ডিঙানো। প্রথম দিকে সুমন বা জুয়েল আমাকে ড্রাইভ করে দিয়ে এসেছিল কয়েক দিন। এরপর যথারীতি কারও দৈনন্দিন রুটিন কারও সঙ্গে মিলবে না। একদিন রোববারের দুপুরে দেখলাম আমাকে দিয়ে আসার মতো থাকলেও যে যার কাজে ব্যস্ত। সাতপাঁচ না ভেবে নেমে পড়লাম গাড়ি নিয়ে একদম সিডনি থেকে নর্থ সিডনির মেইন হাইওয়েতে! অনেকটা দুঃসাহসী অভিযানের মতো। পুরোপুরি প্রস্তুত হওয়া থেকে আমি তখনো অনেক ক্রোশ দূরে। কিন্তু এত দিনের যাতায়াতের কারণে রাস্তা চেনা লাগবে জানতাম। আগে মাথায় ভেবে নিলাম কোথায় শুরু করে কত দূর গিয়ে কোনো জায়গায় মোড় নিতে হবে বা কোথায় অন্য রাস্তার এক্সিট পয়েন্ট আসবে। পুরো ম্যাপ চোখের সামনে না এলেও ধারণা নিয়েই স্টার্ট দিলাম গাড়িতে। আমাদের বাসার সামনের জায়গায় আগে দুটো গাড়ি পার্ক করা থাকতো। এখন আমারটাসহ তিনটে করতে হয়। কাজেই ওখান থেকে গাড়ি বের করে রাস্তায় নিয়ে যাওয়াটাও একটা পরীক্ষা রীতিমতো। জায়গার সংকুলান হয় না। এখানকার অধিকাংশ  ভাড়া বাড়ির সামনে দুটি গাড়ি পার্ক করার জায়গা থাকে। বেশ সাবধানে গাড়িটাকে রিভার্স গিয়ারে রেখে বের করে নিয়ে ড্রাইভ শুরু করলাম ২৩ কিলোমিটার দূরের নর্থ সিডনির পথে।

কেমন একটা অজানা রোমাঞ্চ কাজ করছিল! সত্যিই পারব তো? বাসা থেকে মূল সড়কে বের হয়ে প্রথমে ডানে মোড় নিয়ে সোজা কিছু দূর গিয়ে সিডনির মেইন রোডে একটা ইন্টারসেকশন আসে যেটা থেকে সিডনি ওয়ালমার্ট দেখা যায়। আবার ডানে মোড় নিতে হবে। আগে ভালোভাবে নিশ্চিত হতে হবে অপর পাশ থেকে অন্য কোনো গাড়ি আসছে কি না; কারণ যেখানটায় আমার গাড়ি মোড় নেবে, ওটা আসলে অপর পাশের সোজা রাস্তার বর্ধমান পথ, যা বিস্তৃত পেয়েছে সোজা হয়ে। এ ক্ষেত্রে যিনি গাড়ির মোড় নিচ্ছেন, তাঁকে নিশ্চিত হতে হবে তিনি অন্য গাড়িকে সোজা পথে যাওয়ার অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। সেটাই ড্রাইভিং আইন। কিছুক্ষণ দেখে নিশ্চিত হয়ে সোজা রাস্তায় নেমে গেল হায়উন্ডাই এক্সেন্ট ২০১০। এরপর আর কোন জায়গায় মোড় নিতে হয় না একটা জায়গা বাদে, নর্থ সিডনির মূল প্রবেশপথে—এক্সিট চার। ব্যাপারটা আমাকে অনেক বাড়তি সুবিধা জোগাত। তবে মাঝখানের একটা জায়গায় বাধ্যতামূলক লেন পরিবর্তন করতে হতো। কারণ, ওই পথ পরে অন্য পথের সঙ্গে মিশেছে। এটা আমি জানতাম না। জায়গাটা সিডনির রিজিওনাল হাসপাতালের ডাক্তারদের আবাসিক এলাকার ঠিক বাইরের দিকটায়। প্রথম দিন কোনো বিপত্তি ঘটেনি। পরের দিনই সেটা বুঝতে পারি, যখন পেছনের গাড়ি বেশ বড়সড় হর্ন বাজিয়ে দিল! অধিকাংশ সময় আপনার পেছনের গাড়ি তখনই ভেঁপু বাজাবে যখন কোনো ভুল হয়েছে। বিষয়টা এখানে বেশ অপমানের চোখে দেখা হয়। রাস্তায় এত শত শত যানবাহন চলছে, কিন্তু কোনো গাড়ি টুঁ শব্দটিও করছে না। আমাদের দেশের ট্রাফিকের কথা ভাবলে দৃশ্যটা একদম বিপরীতমুখী। যেখানে আমরা একনাগাড়ে বিরতিহীনভাবে হর্ন বাজিয়ে একে অপরের কান ঝালাপালা করে দিতে কোনো দ্বিধা বোধ করি না!

রওনা হলাম নিজে নিজেই
ছবি: লেখক

পৌঁছানো পর্যন্ত আর কোনো সমস্যার মুখোমুখি হইনি। কিন্তু সেই রোবট হয়ে বসে চালানোর যে সমস্যা, যার কোনো স্বতঃস্ফূর্ততা  কাজ করছে না, সেই বৃত্ত থেকে বেরোতে পারলাম না! তখন বলতে গেলে আমাকে প্রায় প্রতিদিনই ড্রাইভ করতে হতো। শনি ও রোববার নর্থ সিডনির ২৫ কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিতাম। আর সোম থেকে শুক্রবার চলে যেতাম গ্লেস বে-র অফিসে ১৮ কিলোমিটারের রাস্তা পেরিয়ে। এত ড্রাইভিং করার পরেও কেন আমার জড়তা কাটেনি, সেটা অবশ্য রহস্যজনক! প্রথমে যখন শুরু করেছিলাম, তখন যেমন জবুথবু হয়ে বসে চালাতাম, এরপরে প্রায় মাস চারেক কেটে গেলেও ড্রাইভিংয়ের ধাঁচে কোনো পরিবর্তন এল না! এটার উপলব্ধি তখন পর্যন্ত আমার হয়নি। তবে কিছু কিছু অকস্মাৎ ঘটনা সব সময় আপনার মনে একটা স্থায়ী দাগ রেখে যায়। এক রাতে কাজ সেরে ফেরার পথে গাড়িতে গান শুনে ড্রাইভ করছি। এভাবে প্রায়ই তখন আমি গ্লেস বে যাই! বেশ ভালোই লাগছিল। সিডনির কাছাকাছি একটা জায়গায় এসে রাতের অন্ধকার বা কিছুটা হয়তো নিজের বেখেয়ালিপনা থেকেই ভুল এক্সিটে ঢুকে পড়ি। এরপর গাড়ি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা জায়গায় গিয়ে হাজির হয়। কোথায় আছি বুঝতে পারছি না। আশপাশে তাকিয়েও কিছু বুঝতে পারছি না। হাত ক্রমশ ঘামছে। কপালে চিন্তার ভাঁজ! ফোনে গুগল ম্যাপে শুনে দক্ষিণ–পশ্চিম দিকের কোন রাস্তায় মোড় নেওয়ার কথা বলছে, যা আমি বুঝতে পারছি না। পুরোপুরি আক্কেলগুড়ুম হলো। ইমার্জেন্সি লাইট জ্বালিয়ে রাস্তার এক পাশে গাড়ি সাইড করিয়ে বসে আছি। আর ম্যাপ বোঝার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তখন ঘড়িতে সময় প্রায় রাত সাড়ে ১১টার বেশি। আরও একটা ব্যাপারে আমার আগ্রহ ছিল না মোটেও, সেটা হচ্ছে ম্যাপ দেখে গাড়ি চালানো। ড্রাইভ করব কীভাবে? ম্যাপ দেখে চালানোর সময় ডান দিকের রাস্তা আর বাঁ দিকের পথ প্রায়ই সময় গুলিয়ে ফেলতাম বা নির্দেশনা ধরতেই নাকানিচুবানি অবস্থা হতো আমার। এটা নিজে প্র্যাকটিস করার সময় থেকেই হয়ে আসছিল। পরে সিদ্ধান্ত নিই, কোনো জায়গায় যাওয়ার আগে সে জায়গাটার ম্যাপ পুরো দেখে মোটামুটি রাস্তার একটা ভালো ধারণা নেওয়া যায়। তবে সেই দুর্বল দিকটাই এখন বুমেরাং হয়ে এল নিজের দিকেই! ম্যাপ ফলো করতে না পারলে এ নির্জন জায়গা থেকে উদ্ধার হওয়ার অন্য কোনো পথও দেখছি না আপাতত! তখন নিজের সাধ্যমতো চেষ্টার পর এক শুভাকাঙ্ক্ষী ভাইয়ার কথা মাথায় এল। উনি বলেছিলেন, কখনো পথ হারিয়ে ফেললে সোজা রাস্তায় চলবেন। কোথাও মোড় নেওয়ার প্রয়োজন নেই। এক জায়গায় গিয়ে কোনো না কোনো পরিচিত নির্দেশনা পেয়ে যাবেন! ঠিক করলাম সোজা চালিয়ে নিয়ে যাই, দেখি কোথায় যাওয়া যায়। নিজের ওপর ভরসা রেখে গাড়িকে বাঁয়ে ঘুরিয়ে রাস্তায় নেমে সোজা চলতে লাগলাম। আমার গাড়ির পেছন দিকে অন্য গাড়িও অনুসরণ করে চলছে। তখন গাড়ির গতি কম ছিল। কারণ, আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কোথায় চলেছি জানি না। কাল সকালে আবার কাজও আছে। ক্রমশ...