গাড়ি চালানোর যত কেচ্ছা: কানাডা পর্ব–২

আমরা মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে গেলাম ওই বাসায়। জুয়েল ফোন দিল গাড়ির মালিককে। এর আগে আমাকে বলে দিল, দামাদামি বা গাড়ি পর্যবেক্ষণ সব সে করবে। আমার কাজ শুধু মনোযোগী ছাত্রের মতো সবকিছু অবলোকন করা, যাতে পরে নিজেই এসব করতে পারি। মাস্ক পরিহিত এক মধ্যবয়সী ভারতীয় যুবক বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের অভিবাদন জানিয়েই তার আনা স্যানিটাইজারে হাত স্যানিটাইজ করে নিতে বলল। সে দক্ষিণ ভারতের। বুঝলাম তার কথা বলার বাচনভঙ্গিতে, দক্ষিণ ভারতের অনেক সহপাঠীদের সঙ্গে ক্লাস করছি। অনেকের সঙ্গে সখ্যতাও আছে। তার নাম টিজু।

তখন অতিমারীতে ইতালিতে মড়ক লেগেছে। লাশের বহর নেওয়ার ছবি সকালে পেপারে দেখেছি। বেঘোরে মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।

গাড়ির কথায় ফেরত আসি—রূপালি রঙের হায়উন্ডাই এক্সেন্ট ২০১০ মডেল। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও সামনের দিকের বাম্পারের নিচের অংশটা কিছুটা ভাঙা। ওখানে টেপ লাগানো রয়েছে। জুয়েল গাড়ির হুড তুলে ভেতরে কলকবজা বেশ ভালোভাবে দেখতে লাগল। এরপর ওটা বন্ধ করে গাড়ির নিচে কিছু একটা দেখল। পুরোপুরি না দেখতে পাওয়ায় অনেকটা শুয়ে গিয়েও দেখে নিল। তখন বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস ৮ কি ৯ হবে!  ও এসবে ভ্রুক্ষেপহীন। জিজ্ঞাসা করাতে জানাল শীতের সময় এখানকার রাস্তায় বরফ গলানোর জন্য লবণ ছিটানো হয় আর এতে গাড়ির নিচের তলদেশ ক্ষয়ে যায়। সেটাকে একটা কোডিং করিয়ে নিতে হয়, যাতে ক্ষয়রোধ করা যায়।

বাকি গাড়ির ভেতরে ঢুকে আমরা বসে দেখলাম। এরপর জুয়েল চালিয়ে দেখল। আমরা তিনজনে সিডনির মেইন হাইওয়ে ধরে এগিয়ে চললাম অনেক দূরে। আমরা সিডনি রিভারের প্রধান সড়ক হয়ে ফেরত আসলাম গাড়ির মালিকের বাসায়। যাওয়ার পথে জুয়েল গাড়ির পার্টস, কত দিন চালিয়েছে, সবকিছু  মিলিয়ে কেমন সার্ভিস দেয়—খুঁটিনাটি জেনে নিল। টিজুও আরও বেশ কিছু তথ্য দিল। কেন বিক্রি করতে চাইছে, এটাও জানা দরকার। টিজুর বাসার সামনে আমরা যখন পৌঁছাই, তখন জুয়েল তার নতুন হোন্ডা সিভিক ব্র্যান্ডের গাড়িটার বেশ প্রশংসা করেছিল। মূলত ওটা কেনা হয়েছে বলেই এটা বিক্রি করছে সে। এখানকার সবাই এমনই করে, আলাদিনের ‘নতুন প্রদীপ নাও, পুরোনো প্রদীপ দাও’ লাইনের কথা মনে আছে? যখন দুষ্ট জাদুকর আলাদীনের অনুপস্থিতিতে তার প্রদীপ হাতিয়ে নিয়েছিল, তখন এ কথা বলেই কাজ সেরেছিল। এখানকার চলনও ‘নতুন গাড়ি নাও, পুরোনো গাড়ি দাও’ এমন হয়ে গেছে!

আমরা মিনিট বিশের মধ্যে টিজুর বাসায় ফিরে এলাম। এরপর শুরু হলো আসল কাজ—গাড়ি দামাদামি! সে ৩ হাজার ৫০০ থেকে কমিয়ে ৩ হাজার ৩০০ করল। জুয়েল আরও কমিয়ে তিন হাজার করতে বলল। সে বলল রাজি হলে এই মুহূর্তে ক্যাশ টাকা পরিশোধ করবে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে ও ৩ হাজার ৫০–এ রাজি হলো। আমরা জুয়েলের গাড়িতে এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য রওয়ানা হয়ে গ্লেস বে পৌঁছালাম। ওখানে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, কম দূরত্বের মধ্যে প্রায় সব কটি ব্যাংকের এটিএম বুথের সুবিধা রয়েছে।

আমরা দুটো ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে প্রয়োজনীয় টাকা তুলে নিলাম। একসঙ্গে এত ক্যাশ ডলার কখনো চোখেও দেখিনি! জোড় সংখ্যায় টাকার পরিমাণ থাকায় ওখানে মোট ৩ হাজার ৬০ ডলার ছিল। ফেরার সময় জুয়েলকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, যদি ও বাকি ১০ ডলার না দেয়। পুরোটাই রেখে দেয়? তখন জুয়েলের কথা শুনে বেশ অবাকই হয়েছিলাম। সটান জানিয়ে দিল, অমন করলে গাড়ি কেনা বাতিল! অন্য গাড়ি দেখব। টিজুর বাসায় পৌঁছে ওর হাতে ৩ হাজার ৪০ ডলার পুরোটাই ক্যাশ টাকা দিলাম। সে গুনে ১০ ডলার কম কেন জিজ্ঞাসা করলে জুয়েল বলল, এটিএমে শুধু জোড় সংখ্যার নোট আছে। তার কাছে ১০ ডলার থাকলে বদলে নেওয়া যায়। পরে সে আর কিছু বলল না। আমরা আগেই ধরে নিয়েছিলাম, তার কাছে থাকবে না। এখানকার সবাই কমবেশি কার্ড ব্যবহারের দরুন ক্যাশ টাকা রাখে না। জুয়েলের গাড়িতে আমরা আর হায়উন্ডাই গাড়িতে টিজু আর ওকে ফেরত নিতে তার হোন্ডা সিভিকে রওয়ানা হলো তার এক বন্ধু। তিন গাড়ির বহর চলল পিছু পিছু। আমরা বাসায় ফিরে এলাম। টিজু গাড়ি থেকে নেমে ওর গাড়ির নেমপ্লেটটা পেছন থেকে খুলে নিল। আমাদের বিদায় দিয়ে চলে যাওয়ার পর লক্ষ করলাম ও নেমপ্লেটের স্ক্রুসহ খুলে নিয়ে গেছে। মূলত নেমপ্লেটের সঙ্গে থাকা স্ক্রু আমার কেনা গাড়িতে ওর লাগিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। জুয়েল বলল, ‘এটা কোনো কথা?’

আমি গাড়িতে বসে স্টার্ট দেওয়া শিখে নিলাম। এরপর চালিয়েই নিয়ে গেলাম শাহরুখদের বাসার সামনে। আমাদের বাসা থেকে মিনিট দুয়েকের মতো। আমার গাড়ি দেখতে ছেলেপেলেরা সবাই এক জায়গায় জড়ো হলো। নানা রকম কথাবার্তা চলতে লাগল। কেউ বলল, ‘পার্টি দেন!’ কেউ বলল, ‘চলেন ভাই, ঘুরে আসি!’ তাদের বাসার ওপরের দিকের জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা রিফাত আমার গাড়ির কয়েকটা ছবি তুলল। তখন না বুঝলেও পরে দেখলাম ওর ক্যামেরার হাত বেশ পাকা। আপাতত সবাইকে ওই দিনের মতো সান্ত্বনা দিয়ে সরকারি নির্দেশের মতো ‘পরে বাস্তবায়নের আশ্বাস’ দিয়ে গাড়ি নিয়ে বাসার সামনে ফেরত এলাম।

এরপর লাইসেন্সের প্লেট নেওয়ার পালা। সেটা নিতে যেতে হবে অ্যাকসেস নোভা স্কসিয়াতে-সরকারি অফিস যেখান থেকে আইডি কার্ড, লাইসেন্সসহ যাবতীয় কাজ করতে হয়। ড্রাইভিংয়ের সব টেস্টের পরীক্ষাও এখানেই হয়। তখন অতিমারীর কারণে সবকিছু ফোনে করতে হয়েছিল। ওখানে পৌঁছে কল দিলাম। ক্রমশ...

আরও পড়ুন