গাড়ি চালনার যত কেচ্ছা : কানাডা পর্ব ৩

ছবি: লেখক

ফোন ধরলেন ওই প্রান্তের কোনো এক নারী কর্মকর্তা। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমি অ্যাকসেস নোভা স্কসিয়ার বাইরে আছি। ভেতরে কখন আসব। উনি জানালেন, এটা তো হ্যালিফ্যাক্স! আমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারেন? আমি জানতে চাইছিলাম, ভেতরে ঢুকতে হলে কী করণীয়? প্রথমবার এসেছি, তাই বুঝতে পারছি না। উনি বললেন, অপেক্ষায় থাকো। সময় হলেই তোমার কাছে কল আসবে। তখন চলে যেয়ো!

মিনিট দশের মধ্যে কল এল। আমার নাম ধরে বলে ভেতরে আসতে বলল। ভেতরে যাওয়ার আগে দেখলাম সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কয়েকজন লাইনে দাঁড়িয়ে, কিসের তা বুঝলাম না। কাউন্টারের টিকিট নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। ডাক এল, আমার লাইসেন্স কনফার্মেশনের কাগজটা জমা দিলাম। সেটা দেখে লাইসেন্স প্লেটের খরচটা জানিয়ে দিলেন কর্মকর্তা। পে করে প্লেট যখন হাতে নিচ্ছি, তখনকার অনুভূতি ঠিক বোঝানো যাবে না! কানাডার মাটিতে এসে গাড়ির মালিক হলাম...বিষয়টা নিজের কাছে বেশ জমিদারি জমিদারি ঠেকছিল! বাইরে এসে জুয়েলের গাড়িতে বসলাম। বসেই একটা ছবি তুলে নিলাম! সারা জীবনের মোক্ষম স্মৃতি! জুয়েল তো বেশ খুশি। ওর সঙ্গে ড্রাইভিং শেখা নিয়ে কথা হচ্ছিল। ও বলল, রাতের বেলা বেরিয়ে কোথাও ঘুরে আসবে।

আমি ওকে আবারও বলেছিলাম কি না জানি না, তবে এক রাতে দশটা নাগাদ দেখলাম দরজায় টোকা দিচ্ছে জুয়েল। পাশের ঘরেই থাকত ও। বলল, ‘চলেন দাদা, ড্রাইভ করে আসি!’

বেরিয়ে পড়লাম সবাই। এক গাড়িতে আমি আর জুয়েল আর অন্য গাড়িতে নূর, রাহুল, আকিব। ওরা পেছন থেকে আমাদের ফলো করবে। তখনো জানি না জুয়েল কোনো দিকে যাবে। গাড়ি এগিয়ে চলল। আমরা ধীরে ধীরে সিডনির রাস্তা পেরিয়ে গ্লেস বে হয়ে কোনো দিকে মোড় নিয়ে লুইসবার্গের পথে চললাম। এমন জায়গা বেছে নেওয়ার কারণ, এখানে অন্যান্য রাস্তার তুলনায় গাড়ির আনাগোনা কম আর এটা ওয়ান ওয়ে রোড। মূলত একদিক একটা সিঙ্গেল পথে গাড়ি যাবে, একইভাবে অন্যদিকে থেকে আসবে। ডবল হাইওয়ে রোডে গাড়ির আনাগোনা অনেক বেশি। বেশ কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর সুযোগ বুঝে একটা জায়গায় গাড়ি সাইড করে আমাকে ড্রাইভিং সিটে বসতে বলল।
শুরু হলো আমার গাড়ির পথচলা...

আরও পড়ুন

ইঞ্জিন স্টার্ট করে গিয়ার নিউট্রাল থেকে ড্রাইভে রেখে এক্সিলেটরে ডান পায়ে হালকা চাপ দিতেই গাড়ি সামনে চলা শুরু হলো। একটু এগিয়ে পেছনের কোনো গাড়ি আসছে নাকি, তাকিয়ে বাঁ ইন্ডিকেটর লাইটে সিগনাল দিয়ে রাস্তায় চললাম। চলতে লাগল হুন্দাই একসেন্ট। ধীরে ধীরে বাড়াতে লাগলাম স্পিড লিমিট। প্রথমে পঞ্চাশ, ক্রমে ষাট, সত্তর, আশি। যা-ই করছিলাম, পুরোটাই জুয়েলের পাশের সিট থেকে বলে দেওয়া। ও-ই মূলত জাহাজের ক্যাপ্টেন। নতুন নাবিক, এখনো ক্যাম্পাস ঠিকঠাক বোঝে না! ক্যাপ্টেনকে সার্বক্ষণিক তদারকির দায়িত্ব রাখতে হচ্ছে। রাতের আঁধারে বেশ কয়েকবার ভুলভাল ইন্ডিকেটর লাইট দিয়ে গাড়ি চালাতে লাগলাম। পেছনের গাড়ি থেকে নূর আর রাহুলের ফোন এল! ‘ড্রাইভারের কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?’ একবার তো কন্ট্রোলই ভুল করে ফেলেছিলাম। তখন অনেকক্ষণ ধরে আমি ঠিকঠাক চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎই পেছন থেকে একটা গাড়ি ওভারটেক করতে গেল, তখনই হয়ে গেল বিপত্তি। জুয়েল অবশ্য সামাল দিল। আর শিখিয়ে দিল, কোনো গাড়ি পেছন থেকে ওভারটেক করলে আপনি আপনার মতো চালিয়ে যাবেন। কখনো গতিপথ পরিবর্তন করতে যাবেন না। যে যেতে চায়, তাকে নির্দ্বিধায় যেতে দিন। ঠিকঠাক একটা জায়গায় যাওয়ার পর জুয়েল আগের মতো গাড়ির কন্ট্রোল নিজের দায়িত্বে নিয়ে সবাই বাসায় ফেরত এলাম। বেশ ভালোই একটা প্র্যাকটিস করেছিলাম।

এরপর আরেক দিন নূরকে নিয়ে চলল গাড়ি শেখা। তবে আমরা অত দূরে কোথাও যাইনি। বাসার পেছনেই ছিল পার্কিংয়ের জন্য বিশাল বড় একটা জায়গা। ওখানে বেশ বড় কয়েকটা সুপারশপ ও রেস্টুরেন্ট ছিল। তাই এ ব্যবস্থা। যদি কোনো কারণে ওখানে জায়গার সংকুলান না হয়, তাহলে এখানে এসে যাতে পার্কিং করা যায়। নূর পাশে বসে নিদর্শনা দিত লাগল। বাঁয়ে, ডানে, কখনো রিভার্সে, কখনো স্পিড বাড়াতে বলল, কখনো কমাতে। কোন জায়গায় গিয়ে মোড় নিতে হবে আর কোথায় ভুল হচ্ছে, সব বলে দিতে লাগল। বেশ কয়েকবার গাড়ি থামিয়ে নিজে দেখিয়েও দিল। আমার অনুশীলনে ও কতটা সন্তুষ্ট ছিল জানি না। বরাবরই চাপা স্বভাবের মানুষ সে। মোটামুটি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা ফেরত আসি।

ছবি: লেখক

তৃতীয়বারে আমাকে শেখানোর দায়িত্ব নেয় শাহরুখ। তবে ওর শেখানোটা বেশ কয়েকটা ধাপে এগিয়েছিল। প্রথম দিন আমরা অবশ্য রাস্তায় গিয়েছি। তবে এ ক্ষেত্রে ও যেটা করেছিল, মূলত সেটাই পরবর্তী সময়ে ড্রাইভিং করতে সবচেয়ে বেশি সাহস জুগিয়েছিল। ওকে ওর কাজের জায়গায় নামিয়ে দিতে বলল। বাসার কাছেই ছিল জায়গাটা। আমি ওকে নিয়ে পেছনে পার্কিংয়ে চলে গেলাম। ও যাওয়ার সময় শুধু বলে দিল, ‘আপনি রাস্তায় নামার সময় দুদিকে লক্ষ রেখে নামবেন, তাহলেই হলো!’ কিন্তু আমি এর আগে কখনো এভাবে গাড়ি নিয়ে মূল সড়কের একেবারে মাঝখানে দিয়ে যাইনি। এ প্রান্ত থেকে গাড়িটাকে ওপাশে নিয়ে সোজা যেতে হবে। কারণ রাস্তার দুদিকেই ট্রাফিক আছে। আমার গাড়ি যেদিকে বাসায় যাওয়ার পথ, ঠিক এর বিপরীতমুখী পথে। যখন এমন কোনো পরিস্থিতির অবতারণা হয়, যা আপনি আগে কখনো মুখোমুখি হননি, তখন নিজের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে দাঁতে দাঁত চেপে নেমে পড়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা থাকে না। আমিও তা–ই করলাম। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থেকে সুযোগ খুঁজছিলাম কখন রাস্তার অপর পাশে গাড়িটা নিয়ে যাব। তখন সকাল ১০টা বা সাড়ে ১০টা। কাজেই রাস্তায় বেশ ভালোই ট্রাফিক ছিল। দুদিক থেকেই গাড়ি চলছে। ভাগ্য ভালো যে ওই সময়ে আমার পেছন দিক থেকে কোনো গাড়ি আসেনি। তাড়াহুড়া করার প্রয়োজন পড়েনি। সুযোগ বুঝে গাড়ির এক্সেলেটরের প্যাডেলে চাপ দিয়ে এক টানে অন্য পাশে নিয়ে গিয়ে সোজা চলতে লাগলাম। এরপর কিছুটা গিয়েই ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়ালাম আর লাইট দেখে বাঁয়ে ইন্ডিকেটর দিয়ে আমার বাসার যাওয়ার পথে চলে গেলাম। শাহরুখ ওই দিন ওভাবে আচমকা আমাকে অথই সাগরে না ফেলে দিলে যে সাহস সঞ্চার করে বাসায় ফেরত এসেছিলাম, তা প্রশিক্ষণ দিয়ে কখনোই রপ্ত করা সম্ভব হতো না। এর জন্য ওর কাছে সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব। তবে এ ক্ষেত্রে সবার জন্যই কথাটা প্রযোজ্য, যারা আমাকে অনেক সময় দিয়েছে।

এরপর আরেক দিন বিকেলের দিকে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা সিডনির বাসা থেকে মিনিট বিশেকের পথ সিডনি রিভারের দিকে যাচ্ছি। ওখানকার ওয়ালমার্টে কাজ করত ও। আপাতত টুকটাক বাজার করার উদ্দেশ্যেই যাত্রা। নতুন গন্তব্য, নতুন রাস্তায় ড্রাইভিং করা। ওই দিন কয়েকটা কথা বলেছিল, যা সারা জীবনের জন্য মনে রাখার প্রয়োজন ছিল। জানাল, ‘ড্রাইভিংয়ের সময় মাথায় রাখবেন, আপনি রাস্তার ডান লেনে আছেন কি না?’ এখানকার গাড়িতে ড্রাইভিং সিট বাঁ পাশে থাকে। ঠিক আমাদের দেশের উল্টো।

মাল্টিটাস্কিংয়ের কথা মাথায় রাখতে হবে—একসঙ্গে অনেক কাজ করতে হয়—অবশ্য এ ব্যাপারে আমার বরাবরই চিন্তা! কারণ, একসঙ্গে এক্সিলারেটরে চাপ দিয়ে ব্রেকে পা নিয়ন্ত্রণে রেখে, গিয়ার, ইন্ডিকেটর লাইট ঠিক রেখে, তিনটা রেয়ার ভিউ উইন্ডোতে সর্বক্ষণ চোখ রেখে তবেই গাড়ি চালানো! এসবের মধ্যে শাহরুখ বলছিল, যদি কখনো ফোন আসে, সেটাও রিসিভ করার মতো সক্ষমতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে। কী জানি বাপু, আমার কাছে পুরো ব্যাপারই প্রথম থেকেই গন্ডগোলের ঠেকছিল। একসঙ্গে এত বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সবার জন্য কত সহজ! মানুষ তো এর সঙ্গেই আরও কত বিচিত্র কাজ করে থাকে।

আরও পড়ুন

আপনাদের নিশ্চয়ই বিখ্যাত অভিনেতা রোয়ান অ্যাটকিনসনের ‘মি. বিন’–এর ওই পর্বের কথা মনে আছে। ওর ডেন্টিস্টের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেরি হওয়ায় গাড়ির ভেতরেই জামাকাপড় পরা থেকে শুরু করে দাঁত ব্রাশ সবকিছু সেরে নিয়েছিল। হাসির হলেও পুরো দৃশ্যই কিন্তু রাস্তায় লোকভর্তি ট্র্যাফিকের মাঝে শুটিং করা হয়েছিল। খুব পাক্কা চালক না হলে এমন দৃশ্য ওভাবে শুট করা প্রায় অসম্ভব। আর এদিকে আমি? বাংলাদেশেও ড্রাইভিংয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে সেটা নিতান্তই বাপির পীড়াপীড়িতে বিআরটিসির ট্রেনিং সেন্টারে গিয়ে সপ্তাহ খানেকের জন্য। অভিজ্ঞতা মোটেও সুখের ছিল না। সে গল্প আরেক দিন করব।

পথে বেশ কয়েকটা জায়গায় সিগনালে ভুলভাল ড্রাইভিং করে বসলাম। পাশ থেকে শাহরুখ যতটা পারছে বলে যাচ্ছে।

ও বলতে লাগল, ‘আপনি নিজে সময় বের করে একা একা বেরিয়ে পড়ুন। না হলে ড্রাইভিং শিখতে আপনার আরও সময় লাগবে। সব সময় যতটা সম্ভব রাস্তার ডান পাশে আছেন কি না, লক্ষ রেখে চালিয়ে যাবেন। কখনো প্যানিক করবেন না। কোনো অবস্থাতেই না! আপনার ভুল হলে পেছনের গাড়ি আপনাকে হর্ন দেবে, মনে রাখবেন। তবে কানাডিয়ানদের কোনো ঠিক নেই। ওরা কিন্তু ড্রাংক হয়েও গাড়ি চালায়। কাজেই নিজের মাথা ঠিক রাখবেন। আশপাশে প্রচুর প্র্যাকটিস করতে হবে আপনাকে। রাতের বেলায় পার্কিং প্লেসে গিয়ে নিজের মতো যতক্ষণ মনে হবে চালাবেন। আস্তে আস্তে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভয়, জড়তা এসব কেটে যাবে।’

ওর কথাগুলো খুবই ভালো করে শুনলাম। ওদের বাসার সামনে ফিরে গাড়িটা পার্কিং করতে গিয়ে লক্ষ করলাম আমার রিভার্স ড্রাইভিংয়ে সমস্যা হচ্ছে। ওকে বললাম। ওর রুমে গিয়ে আমরা বসে আরও কিছুক্ষণ আলাপ করলাম। একটা গেম ডাউনলোড করে দিল। দেখলাম ওখানে প্যারালাল পার্কিংও শেখানো আছে। বলল, এটা খেলতে থাকুন আর মাথায় রাখবেন এখানে কীভাবে করছেন, এটাই গাড়িতে বাস্তবে বসে করবেন, ব্যস! কাজ হবে আশা করি।

ওর প্রতিটা কথাই বেশ প্র্যাকটিক্যাল সেন্স করে বলা। মোটামুটি অনুপ্রাণিত হয়েই বাসায় ফিরলাম। তবে ওই যে মাল্টিটাস্ককিংয়ের ভূত মাথা থেকে না নেমে বরং আরও জেঁকে বসল।

এরপর রাতের বেলায় পার্কিং প্লেসে গিয়ে প্র্যাকটিস করলেও বুঝতে পারছিলাম প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ছোটখাটো ভুল থেকে যাচ্ছে। আর রিভার্স পার্কিংও করতে পারছিলাম না; প্যারালাল পার্কিং তো অনেক পরের কথা। ভাবলাম, সুমনকে একবার বললে কেমন হয়! ক্রমশ...

**দূর পরবাসে ([email protected]) লেখা পাঠাতে পারবেন যে কেউ