বীথি: পর্ব ২৫
বীথি,
এই লেখা তাঁরা পড়বেন, যাঁরা পাকাপাকিভাবে বিদেশে থাকেন, কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে নিয়মিত মা/ বাবা/ভাইবোনকে পাঠান, দেশের পত্রিকা না পড়লে যাঁরা বিছানায় যেতে পারেন না, দেশ থেকে শত অপমান শত উপেক্ষা পাওয়ার পরও বেহায়া, নির্লজ্জের মতো দেশে ফোন করেন, জিনিস পাঠান, আবার ১৫–২০ বছরের প্রবাসজীবনের পরও সেই দেশের মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তীর্থের কাকের মতো হাঁ করে বসে থাকেন।
অন্য একটা কথা, বীথি; তোকে এই লেখা লিখতে বসার আগে তিন ঘণ্টা ধরে ঘরের কাজ সারলাম। কাল টিটিসির শিফট শুরু হবে রাত সাড়ে তিনটায়। নামাজ সারলাম। অনেক ভেবে ঠিক করলাম, আমিও একদিন দেশে ছিলাম, তখন আপন বড় বোন আমেরিকায় ছিল। আমি কি আমার বোনের কষ্ট বুঝতাম? স্পষ্ট জবাব, না। বরং আজ যাঁদের কথা লিখছি, আজ যাঁরা আমাকে বা আমাদের বুঝতে পারছেন না বলে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছি, আমি নিজেই একদিন সেই দলের মানুষ ছিলাম এবং আমি তখন এক সন্তানের মা, আমি পরিপূর্ণ বুঝমান মানুষ তখন। বীথি, মাত্র তিনটা ঘটনা বলি। এই লেখা তাঁদের জন্য নয়, যাঁরা কানাডা/আমেরিকায় বাংলাদেশ থেকে কাড়ি কাড়ি ডলার আনেন, যাঁদের বাড়ির ডাউন পেমেন্ট দেশ থেকে আসে, যাঁরা কথায় কথায় বলেন, ডলার কোনো ব্যাপার নয়, তাঁরা এই লেখা না পড়লেও চলবে।
ঘটনা ১:
আমি তখন মায়ের বাসায় যাওয়া–আসা করি প্রতিদিন। নিজের সংসার আছে, তবু বাচ্চাকে রাখতে আসি মায়ের বাসায়। বড়পা আমেরিকা থেকে ফোন করত যখন, তখন ঢাকায় সকাল সোয়া সাতটা বা পৌনে আটটা। আমি আব্বার অফিসে যাব, আমার ছেলেকে আম্মা দেখলে আমি একটু স্বস্তি করে যেতে পারি, বড়পা ঠিক সেই মুহূর্তে ফোন করত, প্রায় প্রতিদিন। আমি ভাবতাম, বড়পার কি কোনো কাজ নেই? ফোন করতে ডলার লাগে না? ওর যদি এত ডলার, তাহলে আমাকে পাঠায় না কেন? বা আরও কাজ করে ডলার আয় করে আমাদের পাঠালেই তো পারে, ফোন করার দরকার কী? আজ এক যুগ কানাডায় থাকার পর বুঝতে পারি, আহা রে আমার বড় বোন, আমাদের কী ভীষণ ভালোবাসে, সারা দিন পশুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করে শুধু আমাদের গলা শোনার জন্য। বড়পা ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ফোন করত; একটু আশা করত হয়তো, আমরা বড়পাকে জিজ্ঞেস করব, কেমন আছ বড়পা তুমি? তোমার শরীর ভালো? নিজের যত্ন নিয়ো, বড়পা। শুধু এই রকম কয়েকটা কথা শোনার জন্য সারা দিন পর বড়পা ওই সময়টুকুই বের করতে পারত আর আমরা বাংলাদেশে বসে অমানুষের মতো কবে কী পাঠাবে সেই ফর্দ দিতাম। কবে কার হাতে কোন জিনিস দিতে পারবে বারবার সেই আলোচনায় চলে যেতাম। বিশেষ করে আমি যে করতাম, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ঘটনা ২:
আগামীকাল আমার টিটিসির যে শিফট আছে, তাতে ৮ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কাজ করার পর আমি পাব মাত্র ১২০ ডলার। আমি তোকে আগে বলেছি, এটা আমার পার্ট টাইম জব, আমি এখানে নামমাত্র বেতন পাই। এখন বল তো, বিদেশে এই ১২০ ডলার দিয়ে কী কী হয়? সোজা কথা, একটা পরিবারকে আমি ভালো করে একবেলা বাইরে আপ্যায়ন করতে পারব না। তুই হয়তো জানিস না, এ রকম একটা চাকরির কী ভীষণ সংকট এ শহরে। আমি একটা ভালো পেশাদার চাকরি করি বলেই কথাটা উঁচুগলায় বলতে পারতাম, শুধু এই চাকরি করে বাঁচতে হলে আমি কোনো দিন স্বীকারোক্তি দিতাম না হয়তো। এ বিষয়ে লেখার আগে আমি এযাবৎ যত প্রবাসীর সঙ্গে কথা বলেছি, যত মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে, সবাই একই মতামত দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, দেশে কাউকে কোনো জিনিস দিয়ে খুশি করা যাবে না, এটা কোনো দিন সম্ভব নয়। দেশে আপনার নবম শ্রেণিতে পড়া আত্মীয়কে যদি কিছু দিতে চান, তাহলে সে যা চাইবে, সেটা আপনি নিজেই এই দেশে ব্যবহার করেন না। কারণ, তার সামর্থ্য আপনার নিজেরই নেই, কাজেই আপনি কিনবেন কী করে? আর যদি আপনি সেটা কিনে নিয়ে যেতে না পারেন বা পাঠাতে না পারেন, তাহলে সবচেয়ে সহজ যা শুনতে হবে সেটা হলো, এই সামান্য আইফোন, ল্যাপটপ, মিনি আইপ্যাড, ক্যামেরা কিনতে পারো না, তাহলে বিদেশে থাকো কেন? পুতুল আপা বিদেশে ছিল ২০ বছর, কাগজ ছিল না, দেশে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না। ২০ বছর পরে দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করে পুতুল ২৫ হাজার ডলার লাইন অফ ক্রেডিট থেকে টাকা তুলে বাজার করেছে, বুকে পাথর বেঁধে আত্মীয়, পরিবার, শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ির জন্য ১০ সেট সাধারণ কানের/গলার গয়না কিনেছে। সবার হাতে সব তুলে দিতে গিয়ে হয়তো নিজের অজান্তে কেঁদেছে যে আমেরিকায় ফিরে এসে কত দিনে এই ঋণ শোধ করবে! পুতুল দেশে যাওয়ার পরদিন হুট করে পাশের ঘর থেকে শুনতে পায়, আপন একজন বলছেন, ‘হুঁউউ...নিজে পরে মোটা গলার চেইন আর আমাদের দেয় পাতলা চেইন, ফালতু সব গিফট।’ পুতুল দেশে আর যে কটা দিন ছিল, শুধুই পণ করেছে, আর নয়, আর কোনো দিন নয়।
ঘটনা ৩:
আমি তখন কানাডায় এসেছি, মাত্র এক মাসের মতো হবে; ছোট বোন কণার বাসায় থাকি, খাওয়া–পরা, থাকা কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে হয় না, বরং তিন দিনের মাথায় কণাকে বললাম, তুই এত ছোট বাসায় থাকিস, এত কষ্ট করিস, তাহলে আমাকে আসতে বললি কেন? আমার ভাবটা এমন যে বিদেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার পায়ের কাছে ডলার গড়িয়ে পড়বে। যাক, কণা–মঞ্জুর তখন সবে পড়াশোনা করছে, নিজেরা কষ্ট করে চলে, তার ভেতর আমি এসে পড়লাম। আমার জায়গায় যদি কণা আমার বাসায় এভাবে শূন্য হাতে বাচ্চা নিয়ে উঠত, আমি কণার সঙ্গে কী করতাম, সত্যি জানি না। আমার বাকি তিন বোন আমার চেয়ে মানুষ হিসেবে কয়েক লাখ গুণ মানবিক ও সৎ। কণার বাসায় সে সময় আমি কয়েক দিন টিস্যু পেপার দিয়ে ঘর মুছতাম। ভাবতাম, কণা এত রোল রোল কিনে আনে, ক্ষতি কী ব্যবহার করলে? (হায় রে, আমি যদি জানতাম, একদিন এই উপলব্ধি আমার হবে, সেদিনের কথা ভেবে শুধুই অসহায় লাগে আর বোনের প্রতি ভালোবাসা বাড়তে থাকে) একদিন কণা অফিস থেকে ফিরে বলল, ‘মেজপা, এত বড় বড় কিচেন টিস্যুর রোল মাত্র দুদিনেই শেষ হয় কী করে?’ বললাম, ঘর মুছি তো। কণা বলে, ‘তুই জানিস, এটার দাম কত?’ আমি সেদিনও বুঝতে পারিনি। কারণ, আমাকে একটা–একটা করে ডলার উপার্জন করতে হয়নি, জানব কী করে? বাচ্চা না হলে কি কোনো দিন প্রসববেদনা জানা যায়? আমি আজন্ম আমার বোনেদের জন্য এই জীবনে পিঠ বাঁচিয়ে চলতে পেরেছি। সেদিনও কণা যদি আমাকে ছেড়ে ডালাসে না যেত, আমি জানতাম না, আমার বোন–বোনজামাই আমার জন্য কতটা করেছে। বিদেশে না এলে কি জানতাম, শুধু একটু ভালোবাসা, আদর আর যত্ন পাওয়ার জন্য আমরা প্রবাসীরা কতদূর যেতে পারি?
বিদেশে না এলে কি জানতাম, একদিন যে দেশ ছাড়ব বলে মরিয়া হয়েছি, একদিন যে দেশের মানুষের সঙ্গ বিষের মতো লেগেছে, আজ সেখানে যেতে পারছি না বলে শুধুই কেঁদে কেঁদে ফিরি? আমি জানতাম কোনো দিন ডলার দিয়ে, বিদেশি জিনিস দিয়ে আর যা–ই পাওয়া যাক, ভালোবাসা কোনো দিন কখনো পাব না। বিলিয়ন ডলারের অনুভূতি আর চোখের পানি দিয়ে কেনা এই উপলব্ধি আজ আমার মতো সব প্রবাসীকে জীবনের কাছে এক বোবা মানুষে পরিণত করেছে। আমরা দিন শেষে বিল পে করি, আর দেশের পত্রিকা পড়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে ফিরি। তবু ভালোবাসা পাব, এমন ভাবনা আর আমাকে নাড়া না দিক, সেই প্রতিজ্ঞা করি সকাল–সন্ধ্যা।
চলবে...