বীথি: পর্ব ২৩
বীথি,
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি বাসা শান্ত। অন্যদিন বাবু নিজের ঘর থেকে দৌড়ে এসে হাত থেকে অফিসের ব্যাগ নেয়, পরের দিনের জিনিসপত্র গুছিয়ে দেয়। আজ দুবার ডাকার পরেও দেখি নীরব, বুঝলাম বাবু গভীর ঘুমে।
আজ সকালে কথা বলেছি নাইয়ার স্কুলে। ওর দুজন শিক্ষকের সঙ্গে। আগেই ঠিক করা ছিল প্রোগ্রাম। নাইয়া জানে না এ কথা। শিক্ষকদের বললাম, জানো আমি এমন একটা দেশ এবং কালচার থেকে এসেছি, যেখানে অনেক সময় মা–বাবার চেয়ে শিক্ষকেরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ছেলেমেয়েদের জীবনে। তোমরা কি আমাকে সংক্ষেপে জানাবে সামির (নাইয়ার স্কুলের নাম) স্কুলে কেমন করছে?
কী অবাক জানিস, দুজন শিক্ষকই জানালেন মতামত জানানোর মতো সময় এখন আসেনি। কিন্তু সামির খুব শান্ত ছেলে, চুপচাপ থাকে, যা বলা হয় তা করার চেষ্টা করে।
সারা দিন অফিসে দিন কেটে যায়। যখন বাড়ি ফিরি তখন অফিস থেকে বাড়ি অবধি ড্রাইভ করতে হয় পাক্কা এক থেকে দেড় ঘণ্টা, কখনো দুই ঘণ্টাও লাগে, যেমন আজকে করতে হয়েছে। এই লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ার সময় ভাবি নিজের শিকড়ের কথা, এই কি লুনা আমি? এই কি আমার হওয়ার কথা ছিল? আমাদের বাবার বাকি সব কলেজশিক্ষকদের মেয়েরা বড়জোর বাংলাদেশের কোনো জেলা শহরে, কোনো সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে মন লাগিয়ে সংসার করছে, আমার তো তাই করার কথা ছিল, করলেই–বা এমন কী ক্ষতি ছিল? না করলেই–বা কি এমন এসে যায়?
জীবনের কোনো কোনো পাকচক্রে পড়ে জীবনটা এখানে এসে দাঁড়াল, সে কথা ভেবে কোনো কূল পাই না বীথি। খুব সাধারণভাবে আমার বাবার যা হওয়ার কথা ছিল, সেটা আব্বু হননি। কী করে যেন বাবা পিএইচডি শেষ করে এসে আর সরকারি কলেজে কাজ করলেন না বা করা হলো না বলতে পারিস। বাবার থাকার কথা ছিল কোনো জেলা শহরের কলেজশিক্ষক হয়ে, সেই বাবা আমাদের চার বোনকে নিয়ে ঢাকা শহরে চলে এলেন। আমাদের সবার জীবনের চাকা ঘুরে গেল।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
এটা অনেকটা ঢাকা থেকে আমেরিকা/কানাডার মতো, ওয়ানওয়ে টিকিট।
বাবা সেই যে ঢাকা শহরে ঢুকলেন আর বের হলেন না। এসব নানান পথের কথা ভাবি বীথি। আমার এই জীবনটাই কি কম বিচিত্র বল তুই? চার বোনের ভেতরে দুই বোন নর্থ আমেরিকায় থাকে বলে আমিও একদিন মাইনাস ৩০–এর শীতে ডিসেম্বরের বরফে টরন্টো শহরে হাজির হলাম, সঙ্গে মাত্র সাড়ে তিন বছরের ছেলে নাইয়া।
এই আসার পরিকল্পনা করেছিলাম আরও চার বছর আগে থেকে। ছোট বোন আর বোন জামাই সমস্ত উত্তাপ–ভালোবাসা দিয়ে আমাকে ভালোবাসতে চেষ্টা করল, কিন্তু প্রথম দুই বছর যে পরিমাণ কষ্ট পেয়েছি, যেভাবে বারবার দেশে ফিরে যেতে চেয়েছি, না পেরে বাংলাদেশ থেকে আম্মাও একদিন বোনদের বলেছেন ফোনে— পাঠিয়ে দে লুনাকে দেশে, সবাইকে বিদেশে থাকতে হবে না, এত কান্নার দরকার নেই।
কই বীথি, আমি কি ফেরত গেছি? বাবা কি ফেরত গিয়েছিলেন ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে? অবাক লাগে ভাবলে জানিস।
মানুষ কি সেই জীব, যে পারে না এমন কোনো কাজ নেই? নিজের অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ ভাবতে বসলে কোনো কূলকিনারা পাই না। ভাবি এই কি আমি? এই পাহাড়সম পথ পেরিয়ে এসেছি সম্পূর্ণ একা, তাহলে চিন্তা করি কেন এত?
এই তো সেদিনের কথা, আমাদের ধানমন্ডির বাসার দিনগুলো, নাইয়া তখোনো বুকের দুধ খায়। চলে এলাম নিজের সংসার ছেড়ে, আর থাকব না, এত অত্যাচার কেন সইব? শুধুই মেয়ে হয়ে জন্মেছি তাই?
জানিস বীথি, চলে তো এলাম। বাবা–মায়ের বা বোনদের কোনো প্রশ্ন কিন্তু তিরের মতো ক্ষতবিক্ষত করেনি জীবনকে, কিন্তু সেই দুঃসময়ে আশপাশের মানুষেরা পাগল করে ফেলেছিল। ভাবটা এমন যেন পরের দিন আর সকাল হবে না, ছেলেও কোনো দিন বড় হবে না বা আমিও আর কোনো দিন সোজা হতে পারব না। কতটা সময় গেছে মাঝখানে—মাত্র ১৪ বছর।
একটা গোটা জীবনের জন্য কি খুব বেশি সময় এটা?
আজকে যখন সেই মানুষগুলোর কেউ কেউ বলে—তুমি ভীষণ সাহসী মেয়ে লুনা, আমি তখন তাকে সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দিই না, আমি বলি না—‘এই আপনি, এই আপনি একদিন আমাকে সব অন্যায় মেনে নেওয়ার জন্য বলেছিলেন।’
ইংরেজিতে একটা কথা আছে—‘ডোন্ট সেটেল ফর লেস।’
আমরা বাঙালি মেয়েরাই শুধু সুন্য-র//////////////////////// সঙ্গে সেটেল করা শিখেছি যুগ যুগ ধরে। আবার সব কথা এলোমেলো হয়ে গেল। আসলে বলতে চাচ্ছিলাম—আবার ও এই শনি/রোববারে কাজ আছে।
ছেলেটা একা থাকবে বাসায়। আমার দিনগুলো নিশ্চয়ই একদিন সহজ হবে, আমিও একদিন ছেলের জন্য সময় বের করতে পারব, সেই দিন অবশ্যই খুব দরে না।
আদর তোকে বীথি। চলবে...