বীথি: পর্ব ২১
বীথি,
পিংক কালারের ভেস্ট পরা মোট ১০ জনের একটা দল।
ভেস্ট মানে বুকের ওপর রান্নাঘরে পরার অ্যাপ্রোনের মতো একটা কভার, সেখানে সামনে লেখা ‘আই’, মানে ‘ইনফরমেশন’। পেছনে লেখা ‘আস্ক মি’, মানে ‘আমাকে জিজ্ঞেস করুন’।
টরন্টো ট্রেন ও সাবওয়ে টার্মিনালের ভেতরে কাজ করছে এই দল। শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় ছেলেকে ঘুমিয়ে রেখে যখন পথে বের হই, তখন মনে হয়েছিল জীবনযুদ্ধে বুঝি আমি একা। কিন্তু আমার বাসস্টপের পরেই মোট পাঁচটি স্টপ থেকে পরপর পাঁচজন মেয়ে বাসে উঠলেন এবং সবাই একই কাজ ধরবেন বলে বের হয়েছেন বাসা থেকে।
টিটিসিতে (টরন্টো ট্রানজিট কমিশন) শনিবারের শিফট শুরু হবে ভোর পাঁচটা থেকে, আমি আর শানু যখন কাজের জায়গায় পোঁছাই, তখন ভোর ৪টা ২৩ মিনিট। অবাক কাণ্ড, গিয়ে দেখি ফিলিপিনো মেয়ে ফাং পৌঁছেছেন ৪টা ৩ মিনিটে। বলেন, ‘আমি তো স্টুডেন্ট, কাজটা খুব জরুরি, সেমিস্টার ফি দিতে হবে, গত তিন বছর কোনো ছুটির দিন পাইনি।’
আমার দিকে আঙুল তুলে বলেন, ‘কী, অবাক হলে? তোমার তো ভালো জব আছে, তুমি তো মনে আনন্দ নিয়ে কাজ করবে, কিন্তু দেখো আমার পথ কত লম্বা?’
বীথি, তোকে লিখতে বসেছি গত ছয় দিনের নতুন জবের কথা বলতে। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করি? জীবনের গল্প বলা কি এতই সোজা?
১৪ বছর ধরে নাইয়াকে নিয়ে এই একলা চলার পথ বেছে নিয়েছি (যাঁরা স্বামী–স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন তাঁদের অনেকে হয়তো আমার চেয়েও একা, কিন্তু তাঁরা মুখে বা লিখে কথাটা স্বীকার করতে পারেন না)। যত দিন যাচ্ছে তত দেখছি বা বুঝতে পারছি, আমার সব ধারণা ভেঙে দিচ্ছে এই মানুষেরাই। যখনই ভাবি, কষ্ট, দুঃখ, সংগ্রাম, একাকিত্ব—এসব আমার একার, তখনই দেখতে পাই, আমার চলার পথে আমি একা নই, আরও অনেক অনেক সহযোদ্ধা। মঙ্গলবার থেকে আজ রোববার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মোট ৪৬ ঘণ্টা কাজ করেছি। আলাপ হয়েছে অনেকের সঙ্গেই। প্রতিদিন বাড়ি ফেরার পথেই ভেবেছি আজকেই লিখে ফেলব, নইলে মাথা থেকে সব চলে যাবে। কিন্তু বিশ্বাস করো, বাড়ি ফিরেই প্রথম দেখেছি ছেলে নাইয়াকে, সারা দিন যাকে একা ফেলে কাজে ছুটতে হয়েছে।
একমাত্র সন্তান, যার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিদিন নতুন করে বাঁচার শক্তি পাই, যার কথা ভেবে যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত থাকি। আমার সন্তান, যার জন্য আমি কোনো অন্যায়কে বহন করিনি কোনো দিন, যার সামনের দিনগুলো ভেবে কঠিন থেকে আরও কঠিন হওয়ার পথ নিতে পারি হাসিমুখে। তাই আর তোর কাছে চিঠি নিয়ে বসা হয়নি, বীথি।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo. com
আজ রোববার। আগামীকাল ভোরে ওঠার কোনো তাড়া নেই। আর মাত্র সাতটা দিন। এরপর আমার রেগুলার অফিস শুরু হবে, আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ব; তাই ভুলে যাওয়ার আগেই লিখে রাখতে চাই সময়গুলোকে।
মঙ্গল থেকে শুক্রবার পর্যন্ত কাজ করলাম ইউনিয়ন স্টেশনে, যেখানে প্রতি ঘণ্টায় ১০ হাজার মানুষ আসা–যাওয়া করছে।
কত রকমের মানুষ দেখতে চাস তুই? এ যেন এক বিশাল মঞ্চ, সাদা, কালো, নীল, লাল, বাদামি—সব রঙের মানুষ আছেন, বিচিত্র তাঁদের ভাষা আর বিচিত্র তাঁদের প্রশ্ন। সবাই ছুটছেন নিজেদের গন্তব্যের দিকে। আমাদের কাজ তাঁদের তথ্য বলে সাহায্য করা, তাঁরা যেন পথ হারিয়ে না ফেলেন। আমাদের কমান্ড করছেন টিম লিডের ওপরে টিটিসির স্টাফ। মাত্র ছয় দিন কাজ করে মনে হচ্ছে, এই শহরে আমার নবজন্ম হলো। মুহূর্তেই ভুলে গিয়েছি, এই সাবওয়েতে করেই গত ১০ বছর কাজে যাচ্ছি। অথচ আমি কিছুই জানি না, কিছুই চিনি না। কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হলো দীর্ঘ সময়। যেমন ডনমেরি, বয়স ৫৬ বছর, শক্ত–সামর্থ্য নারী। টিটিসিতে কাজ করছেন ২৬ বছর। মূল বাড়ি জ্যামাইকা, থাকেন ব্রাম্পটনে। আমাকে বলেন, ‘লুনা, নিজেকে ভালোবাসো, দেখবে সারা পৃথিবী তোমাকে ভালোবাসবে। জীবনে কিছু ভালো মানুষকে মিট করা ছাড়া জীবনের তেমন কোনো অর্থ নেই আমার কাছে। আমি নিশ্চয়ই আমার স্বামীকে নিয়ে তোমার বাসায় মাছ খেতে যাব।’ মেরিকে কাছ থেকে জেনে মনে হয়েছে, ভাবনা কী জীবনে? মেরি তো বেঁচে আছে আনন্দ নিয়ে এতটা সময়। ২৬ বছর কাজ করছেন নিষ্ঠার সঙ্গে, কেন আকুল হয়ে ভাবছি এই জীবন নিয়ে?
ত্রিনিদাদের মেয়ে মিমিজি বিয়ে করেছেন মাত্র দুই সপ্তাহ আগে। হাতের কড় গুনে হিসাব করে বলেন, ‘সামনে অক্টোবরে আমি ত্রিশে পা দেব। টিটিসিতে নতুন চাকরি, তাই বিয়েতে মাত্র দুই দিন ছুটি পেয়েছিলাম। প্রতিটি ছুটির দিনে কাজ করি। বিশ্বাস করি, কাজ করলেই মানুষ ভালো থাকবে।’ তোমার জন্য গুডলাক, লুনা।
মোট ৭০ সিটের বড় বাস চালান মিমিজি। গাড়ি চালানোর ১৬ বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি টিটিসিতে যোগ দিয়েছেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সেই মিমিজি প্রতি ঘণ্টায় ৩৫ ডলার আয় করেন।
ফ্লয়েড বলেন, ‘আমার সৎবাবা কাজ করেন টিটিসিতে, সেই সূত্রে আমিও কাজ পেয়েছি। এখন ভাবি, কেন খামোখা এত এত ডলার লোন নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছি?’ নিজের ওপর খুব জেদ হয়, জানো লুনা।
দাড়ি আছে ফ্লয়েডের গালে। যদিও বেশ ছাঁটা দাড়ি এবং গায়ের রং মিশমিশে কালো, তাই ওর সঙ্গে কথা হওয়ার আগে ভাবছিলাম, কোন দেশের মানুষ এই ছেলেটা। আলাপ হতে সময় লাগল না, মাত্র ২৯ বছর বয়সেই টিটিসিতে ঢুকেছেন।
ফ্লয়েড বলেন, ‘জানো, এই কাজ আমি খুব উপভোগ করি। কত কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, সময় সময় মনে হয় জীবনের সময় এত অল্প কেন?’ ফ্লয়েড মূলত খ্রিষ্টান; যদিও বাবা মুসলিম, কিন্তু মা খ্রিষ্টান। বুড়ো হলে নাকি ফ্লয়েড ফিরে যাবেন নিজের দেশ ডোমিনিকান রিপাবলিকে, সেখানে গিয়ে চাকরবাকর রেখে, পাঁচ–ছয়টা বিয়ে করে জীবন কাটাবেন। কেউ তাঁকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না। কানাডায় সবকিছু নিয়ে ভীষণ আইনি বাধা, এটা ভালো লাগে না ফ্লয়েডের।
বীথি, আর লিখতে পারছি না, শরীর টানছে। সেই ভোর আটটায় কাজ শুরু করেছিলাম, এখন রাত সাড়ে নয়টা। যা লিখতে চেয়েছিলাম, বলতে চেয়েছিলাম, কিছুই করা হলো না। কাল আবার একটা দোভাষীর অ্যাসাইনমেন্ট আছে, শুধু ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে না।
নাইয়া বলেছে, ‘আম্মু, ইউ নিড লং স্লিপ, আমাকে নিয়ে কিচ্ছু ওরি করবে না। আমি নিজেই সব করব।’
বলো বীথি, নাইয়া আমাকে সাহস না দিলে কোথায় শক্তি পেতাম এত? অনেক অনেক না–বলা কথা নিয়ে শেষ করছি, কিন্তু শুরু করতে চাই এখান থেকেই আবার। আপাতত বাই, আদর তোকে। চলবে...