বীথি: পর্ব ২৪

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তুখোড় মার্ক্সবাদী ছেলেকে দেখেছি মাথা নুইয়ে জীবনের কাছে পরাজিত হতে, বলতে শুনেছি, ‘আরে রাখেন তো, ওসব কথা, থিওরি দিয়ে কি জীবন চলে নাকি।’ আবার চাঁদ–তারা–সূর্যকে সাক্ষী রেখে যে মেয়ে বলেছে, ‘আমার জীবনের ভার আমার কাছে, আমি কেন অন্যর ওপরে নির্ভরশীল হব?’ এমন মেয়েকেও দেখেছি, বেঁচে থাকার জন্য আপোষ করতে করতে শূন্যর সঙ্গে দিন যাপন করতে; আবার এমন মানুষও দেখেছি, একদিন যার পিছু পিছু মানুষের মিছিল থাকত, সেই মানুষ জীবজন্তু নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, আজ তাঁর সঙ্গে কথা বলার একজন মানুষও নেই। এর নামই হয়তো জীবন।

খুব স্পষ্ট করে জানি না বীথি, আমার জীবনের আজকের যে পরিক্রমা, একদিন আমি নিজেই তা জানতাম কি না। গতকাল হুট করে একজন বাংলাদেশ থেকে ফোন করেছিলেন, আমার পরিচিত মানুষ। আমি যখন ব্র্যাকে কাজ করতেম, তখন ফিল্ডে পরিচয় হয়েছিল। ভদ্রলোক বলছিলেন অনর্গল, ‘আপা, আপনি বড় টিপ দিয়ে শাড়ি পরে যখন গ্রামের ভেতরে হাঁটতেন, তখন মনে হতো, আপনি এই গ্রামেরই মেয়ে, এখানেই আপনার বেড়ে ওঠা। আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, গ্রামের মানুষেরা অনেক অনেক দিন পরও আপনার কথা জানতে চাইত, বলত সেই আপাটা কই? ওই যে জড়ায়ে ধরত, আদর করে কথা বলত?

বাইরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুধু একটাই ইচ্ছা তীব্রতর হতে থাকে, কখন বাড়ি ফিরব? ওই যে তোকে লেখার শুরুতে বলছিলাম, জীবনের উল্টো পথে হাঁটার কথাগুলো। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষে পড়ি, কয়েকটা জুনিয়র মেয়ে আমাকে হলে দেখতে এসছিল, বিছানার চাদর বিছাতে পারি কি না?

ভদ্রলোক জানেন না, ১৭ হাজার মাইল দূরে বসে আমার অফিসে আমি কাদছি। আমার চোখের পানি দেখে আমার সহকর্মী কুলসন বলে, আর ইউ ওকে মামুদা? বীথি, বাংলাদেশে গ্রামে গ্রামে কাজের হাতেখড়ি আমার খুশি (খুশি কবির, নারীনেত্রী) আপার কাছে থেকে। আপা এই একটা জায়গায় ভীষণ সফল। গ্রামের সাধারণ গরিব মানুষ আপাকে কী ভীষণ আপন ভাবত। তখন সদ্য চাকরিজীবনে প্রবেশ করেছি, সেই ১৯৯৪ সাল, তখনো মাস্টার্সের সার্টিফিকেট হাতে আসেনি। আরও একজন তুখোড় মহিলা শামীম আখতার (ফিল্মমেকার ও সংবাদকর্মী) এর রেফারেন্স-এ খুশি আপার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলাম। খুশি আপার সেই সরল আচরণ বুঝি আমার ভেতরে গভীর রেখাপাত করেছিল। আমি নিজেরা করি সংস্থার ভেতরে একদম গভীরে গিয়ে দেশের সত্যিকার চিত্র দেখার সুযোগ পেলাম। আজ কত বছর হবে বল? ৩৩ বছর তো বটেই। জীবনের সেই ফেলে আসা সময় এই জীবনকে যে কতটা এগিয়ে দিয়েছে, কী করে সে কথা লিখি? শামীম আপা, খুশি আপা, শাহিন আপা, হামিদা আপা, সালমা আপা, শীপা আপা, এমন সব অগুণিত মানুষের কাছে জীবনের প্রথম কয়েক বছরের প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছিলাম।

কত পথ, কত মত! সরদার স্যার বলতেন, জীবনের সবটাই হচ্ছে বিশাল পাওয়া লুনা, কোনটাই ফেলে দেওয়ার নয়, তুমি সবই তোমার ঝোলার ভেতরে রাইখা দিবা। মনে রাখবা, সব অভিজ্ঞতাই তোমার অর্জন।

আরও পড়ুন

আজকে শুক্রবার বীথি, সকাল সোয়া আটটা, ঘুম ভেঙেছে ভোর সাড়ে ৪টায়, নিয়মমাফিক। অন্যদিন এ সময় আমি আমার প্রিয় অফিসে পৌঁছে যাই। দিন শুরু হয়ে যায় এক কাপ চা দিয়ে। অফিসে একে একে সবাই আসতে শুরু করে। আমি বলি নিজেকে, এই যে এখনো কাজ করছি, ঘুম থেকে উঠেই আমার নিজের কাজে আসতে পারছি, এই সৌভাগ্যকে কী দিয়ে মাপ দেব? আজ অফিস একটু দেরিতে শুরু। ইচ্ছা করেই শুয়ে ছিলাম নরম লেপের ওমে। বাথরুমের ঝরনার শব্দে বুঝলাম, ছেলে ঘুম থেকে উঠেছে। গোসল করল ২০ মিনিট ধরে, নিজের স্কুলের লাঞ্চ বানাল। আমার ঘরের দরজা বন্ধ দেখে আমাকে ডাকেনি, কিন্তু আমি সবই টের পাচ্ছি। মনে মনে ভাবি, প্রতিদিন তো ও একাই সব করে, আজকে কেন আমি যাব? তবুও মন মানে না। রান্নাঘরে গিয়ে দাড়াতেই বাবু বলে, মা ডিম ভেজে দেবে প্লিজ। বীথি, এই যে এত এত সময় বাইরে থাকি, কিন্তু মন পড়ে থাকে একান্ত ঘরের কোণে। বাইরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুধু একটাই ইচ্ছা তীব্রতর হতে থাকে, কখন বাড়ি ফিরব? ওই যে তোকে লেখার শুরুতে বলছিলাম, জীবনের উল্টো পথে হাঁটার কথাগুলো। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষে পড়ি, কয়েকটা জুনিয়র মেয়ে আমাকে হলে দেখতে এসছিল, বিছানার চাদর বিছাতে পারি কি না?

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
আরও পড়ুন

বিভাগের এক শিক্ষক বলেছিলেন, ‘তুমি কোনো দিন সংসার করবে, সেটা দেখতে চাই।’ জীবন কী অসম্ভব শক্তিশালী, সেই শিক্ষক এখন এই শহরেই থাকেন, আমার খুব কাছের তিনি। আমার বাসায় আসেন। আমার সাজানো সুন্দর ঘরে ঘোরেন আর বলেন, ‘না না লুনা, হিসাব মেলে না, কিছুতেই মেলে না।’ আমার রান্না করা খাবার খান আর বলেন, ‘তুমি রান্না করেছ, তুমি রান্না করেছ।’ তিনি মেলাতে পারেন না নিজেকে, যেমন আমি চিনতে পারিনি নিজেকেই। মাহবুব পিয়ালের সেই মুর্শিদি গানের মতো ‘আমার ভাবনার কিন্তু দূর হইল না, ও মুরশিদ, আমার ভাবনার কিন্তু দূর হইল না।’ চলবে...

আরও পড়ুন