বীথি: পর্ব ২২
বীথি,
আমরা চার বোন যখন স্কুলে পড়ি, তখন আমাদের মা অনেক কাজ করতেন—সেই কথাগুলো এখন মনে পড়ে প্রায়। ভাবি, আম্মা কেন এমন করতেন?
এই যেমন ধরো, আমরা কখনো স্কুল কামাই করতে পারতাম না, আম্মা সহ্য করবেন না সেটা। কারণ, আমরা চলে যাওয়ার পর যে ফাঁকা সময়টা থাকে, সেটা মায়ের জীবনে খুব জরুরি ছিল। বাবা অফিসে, আমরা স্কুলে, মা মন দিয়ে নিজের মতো সংসার গোছাতেন, বাজারে যেতেন বা হয়তো এক কাপ চা নিয়ে বসতেন। আমি সেই সময়, মানে সেই ১৯৮০–৮৩ সালেও সময় সময় আম্মার হাতে কফি দেখতাম, নেসক্যাফে কফি। হয়তো প্রবাসী কোনো আত্মীয় এনে মায়ের হাতে দিয়েছেন। মা সেই কফির বাহারি বোতল তুলে রাখতেন স্টিলের আলমারিতে। আমাদের বাসায়ও ছিল একটা আলমারি।
আজ এই মুহূর্তে নাইয়া চলে যাওয়ার পর শূন্য হয়ে গেল এই সাজানো ঘর। বিছানায় জোর করে শুয়ে শুয়ে টের পাচ্ছি, ছেলে গোসল করল, নাশতা করল, নিজে লাঞ্চ তৈরি করল, গতকালের রিসাইকেল ফেলে দেবে বলে প্রস্তুত করল, এরপর আমাকে বলে, মা আসি।
বাবু চলে গেল। ভাবলাম, এই তো জীবন, ফুরিয়ে যাবে একদিন। কত স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা আর ইচ্ছাকে জয় করার বাসনা নিয়ে বড় হতে থাকে প্রতিটি মানুষ। খুব কি মেলে সেই জীবনের সঙ্গে যাপিত সময়গুলো? সপ্তাহের কোনো এক দিনও এমন হয় না যে নাইয়া স্কুল যাবে, কিন্তু আমি বাসায় আছি। আজকের দিনের মতো দিন খুবই কম আসে, সারা বছরে হয়তো একটা বা দুটো।
এই শহরে কোনো দিন নাইয়াকে স্কুলে পৌঁছে দিইনি, কোনো দিন ছেলে লাঞ্চ আওয়ারে বাসায় এসে লাঞ্চ করেনি। এসব কথা গর্ব করে বলছি না। এসব আমার বাস্তবতা। আমার ভাবতে হয়েছে জীবন চালাতে হবে। আমি থামলেই জীবন থমকে দাঁড়াবে। তাই আজ জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু কাজহীন একাকী সময়।
আমিও বসেছি কফি নিয়ে। শূন্য বাসা। ঘরের কিছু কাজ আছে, শুরুও করেছি। একবার মনে হলো নাশতা করে নিই।
কফিটা বানিয়ে হাতে করে নিজের ঘরে আসতেই মায়ের কথা মনে পড়ল। আমার মা সেই ধানমন্ডির বাসায় একা, আমিও একা। যুগে যুগে মা–মেয়ের জীবনের অনুভূতি এক হয়ে যায় বলেই মেয়েরা অনেক বেশি দায়িত্ববান হয়। মেয়েরা অনেক বেশি সমাজকে এগিয়ে নেয়। কারণ, মেয়েরা নিজের অনুভূতি দিয়ে সমাজের খোলস পাল্টাতে পারে। ছেলেরা জন্ম দেয় না বলেই শুধু বাইরে থেকে দেখে খোলসকে।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo. com
গত সোমবার ঠিক এই সময় আমি ইউনিয়ন স্টেশনে দাঁড়ানো। টিটিসিতে আমার প্রথম দিন। সে কী উত্তেজনা? সকাল ৬টা থেকে ১০ পর্যন্ত রাশ আওয়ার। আমরা কাজ করছি। হাজারো ছুটে চলা মানুষের ভেতরে অনেকেই নতুন এসেছে এই শহরে। কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই তাদের চেনা যায়।
প্রতি পাঁচ থেকে ছয় মিনিটে কেউ না কেউ বলে, ‘মে আই হ্যাভ অ্যা কুইক কোশ্চেন?’ অথবা দিশাহারা মুখ দেখে এগিয়ে গিয়ে বলি, ‘মে আই হেল্প ইউ?’ এইটুকুই, চোখের পলকে দশটা বেজে যায়, শিফট শেষ। আবার ফিরতে হবে বাড়ি। আবার শিফট শুরু বেলা তিনটা থেকে সাড়ে ছয়টা।
একে বলে স্প্লিট শিফট। আমি কোনো দিনও এভাবে কাজ করিনি। ১০ বছরে এই অভিজ্ঞতা আনকোরা নতুন। এভাবেই কাটল গত সপ্তাহে সোম থেকে শুক্রবার।
মাঝে মঙ্গলবারে বিকেলে একটা দোভাষীর কাজ পেয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করে মঙ্গলবার বিকেলের শিফট ক্যানসেল করে দিই। জীবন খুব বেশি কড়ায়–গন্ডায় হিসাব করা শিখিয়েছে আমাদের। ডলারের হিসাব যে এত অমানবিক আর নির্মমভাবে শিখতে হবে, মাত্র তিন বছর আগেও সেটা বুঝতে পারিনি। কিছুতেই বিশ্বাস করিনি জীবনে শুধু ডলারের হিসাবটাই সত্য, বাকি সব মিথ্যা আর প্রতারণা।
আজও তাই একটু বাড়তি ডলার উপার্জনের কথা ভাবলেই বোবা কান্না আসে, এখনো বিশ্বাস করি না, সৎ আবেগের কাছে এতটা বোক ছিলাম?
জানিস বীথি, দোভাষীর একটা কাজে আমি দুই ঘণ্টায় যা পাই, টিটিসির কাজে ৬ ঘণ্টায় তা পাই না।
এরপর গতকাল কাজ করলাম সেন্টক্লেয়ার স্টেশনে। তুলনামূলকভাবে বড়লোকদের এরিয়া, তাই ভিড় কম। টিমের অনেকেই দাঁড়াল বাইরে, রাস্তায়। ছোটবেলার স্কুলবন্ধু শানু, যে আমাকে এই কাজের সন্ধান দিয়েছে, সে বলে, লুনা, তুই টার্মিনালের ভেতরে দাঁড়াস কেন? ওখানে তেমন ভিড় নেই। মানুষ দেখা যায় না। আমি বাইরে দাঁড়াব, কত মানুষ, দামি দামি গাড়ি, কত আলো–বাতাস। আমি বলি, না রে শানু, আমি ভেতরেই দাঁড়াব, এখানে টিটিসি স্টাফরা থাকে, শান্ত জায়গা, নীরব।
দূরে এক–দুজন অলস মানুষ দেখা যায়, সময় পাওয়া যায়। আমি ভাবতে ভালোবাসি, কী করছি? কী করার কথা ছিল? জীবন আমাকে কোথায় আনল, এসব ভাবতে ভাবতে দেখি, বাস থেকে টুপটুপ করে মানুষ নামছে। তাদের বলে দিই অন্য পথের কথা, বলে দিই আজ ট্রেন সার্ভিস বন্ধ। সাদা সাদা রুপালি আলোর নরম রোদে বেলা বাড়তে থাকে। নীরব এলাকা, বাতাসের শব্দও যেন অনুভব করা যায়। আস্তে আস্তে কথা এগোতে থাকে ডনমেরি–মিমিজি–ফ্লয়েডের সঙ্গে। প্রতিটা মানুষের ভেতরে একটা করে দেশ বাস করে, একটা করে জাতি বাস করে, সমাজ বাস করে। যেমন আমার ভেতরে বাস করে বাংলাদেশ।
সেখানেই যাই, যত দূরেই যাই, বহন করি ফেলে আসার তীব্র নীল যন্ত্রণা। আমাকে মুক্তি দেবে কোন ব্যস্ততা? উত্তর মেলে না, বীথি। চলবে...