১.
‘জীবনে প্রথম এই “নেহারি” বানালাম, সাগর ভাইয়ের জন্য। এর আগে কখনো আমি এটা করিনি।’
সাজুর কথা শুনে আমি খুশি হব নাকি হকচকিত হব, ভেবে পাচ্ছি না। সাজেদা চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষে ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। আমেরিকাবাসী হয়েছেন, সে–ও কত দিন হলো। তিনি কিনা নিজে নেহারি রেঁধেছেন, এই যুক্তরাষ্ট্রে বসে!
ডাইনিং টেবিলটায় চোখ আটকে থাকে। সকালের নাশতায় কেউ এত কিছু করে! এইমাত্র চুলা থেকে নামিয়ে আনা ভাজা পরোটাও আছে দেখছি। নেহারির সঙ্গে মুচমুচে গরম পরোটা—এটা নাকি মোগলদের খাবারের ঐতিহ্য। সাজু তাহলে নেহারির পুরো ঐতিহ্যটাই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছে।
বিদেশে যাঁরা থাকেন, তাঁদের অনেকেই নানা রকম রান্না করেন। দৈনন্দিন খাবারই কেবল নয়, শৌখিন খাদ্যসামগ্রীও তুমুল উৎসাহ নিয়ে রান্না করেন তাঁরা। মিষ্টি বানাতে বানাতে টরন্টো-নিউইয়র্কের অনেকের নামই তো হয়ে গেছে ‘মিষ্টি ভাবি’। বলা চলে, প্রবাস সংস্কৃতির এটি একটি অপরিহার্য অংশ এখন। কিন্তু তাই বলে নেহারি!
নেহারি বাংলাদেশের পরিচিত খাবার হলেও একেবারে সহজে রেঁধে ফেলার মতো খাবার নয়। চট্টগ্রাম, পুরান ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় নেহারি একধরনের ঐতিহ্য হিসেবেই বিবেচিত হয়। ইতিহাস বলে, নেহারির উৎপত্তি নাকি অষ্টাদশ শতাব্দীতে মোগল আমলে, মোগলদের সকালের নাশতায় এই খাবার পরিবেশন করা হতো। আরবি ‘নাহার’ শব্দ থেকে নেহারির উদ্ভব ঘটেছে বলে বলা হয়ে থাকে। নাহার শব্দের অর্থ হচ্ছে দিনের বেলা। মোগলদের সকালের নাশতায় এটি পরিবেশিত হতো বলে এর নাম নেহারি। মূলত গরু, খাসি বা ভেড়ার পায়া দিয়েই এটি রান্না করা হয়। নাম নেহারি হলেও এটাতে বড়সড় হাড্ডিই থাকে এবং সেই হাড্ডির ভেতরের অংশটা (বোনম্যারো) এই খাবারের বড় আকর্ষণ।
চট্টগ্রাম, পুরান ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় নেহারি একধরনের ঐতিহ্য হিসেবেই বিবেচিত হয়। ইতিহাস বলে, মোগলদের সকালের নাশতায় এ খাবার পরিবেশন করা হতো। মূলত গরু, খাসি বা ভেড়ার পায়া দিয়েই এটি রান্না করা হয়। নাম নেহারি হলেও এটাতে বড়সড় হাড্ডিই থাকে এবং সেই হাড্ডির ভেতরের অংশটা (বোনম্যারো) এই খাবারের বড় আকর্ষণ।
কিন্তু সাজুর মাথায় নেহারি রান্নার চিন্তাটা এল কেন? সাজু কিংবা স্বপন ভাই দুজনের কেউই চট্টগ্রাম বা পুরান ঢাকার নন। তাঁরা সিলেটের। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে আমি দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে থেকেছি, সেটা একটা কারণ হতে পারে। সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের কানেটিকাটে চট্টগ্রামের একটা ভাইভ দেওয়ার চেষ্টা! নেহারির সঙ্গে আবার গরম গরম রুটি–পরোটা দুটোই রাখা হয়েছে টেবিলে। একেবারে মোগল বাদশাহর কারবার!
২.
কানেটিকাটে আজ আমাদের শেষ দিন। বেলা দুইটায় জাহেদ আসবে নিয়ে যেতে। আমাদের বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী মঞ্জুর আলম শাহীন তাঁর ভাগনেকে পাঠাচ্ছে নিয়ে যেতে। শাহীন নিজে থাকে ফ্লোরিডায়, নিউইয়র্কে এসেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের একটা পুনর্মিলনীতে যোগ দিতে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেট থেকে আরও অনেকেই আসছেন। শাহীন চায় আমি যেন এই পুনর্মিলনীতে যোগ দিই। তাহলে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। আমি নিউইয়র্কে আসছি জেনে আমাদের বন্ধু বিষ্ণু (বিষু গোপ) যোগাযোগ করেছিল। আমি যেন অ্যালামনাইয়ের পুনর্মিলনীতে যোগ দিই। বিষ্ণু আবার এর প্রেসিডেন্ট।
ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাইয়ের পুনর্মিলনীতে যোগ দিতে আমার কোনো সমস্যা নেই, বরং ভালোই লাগার কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রবাসের আরও অন্যান্য স্থানের মতো নিউইয়র্কেও অ্যালামনাই দুই ভাগে বিভক্ত। বন্ধু বিষ্ণু এক অংশের প্রেসিডেন্ট, আরেকটা অংশের প্রেসিডেন্ট নিহার। বিষ্ণু আমার সহপাঠী, বন্ধু, সাবিনা শারমিন নিহার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা। ফলে কোনো একটি অংশের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়াটা সমীচীন হবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় আছি। তা ছাড়া আমি তো এসেছি ঘুরতে, একজন পর্যটকের অডিটরিয়ামে বসে অনুষ্ঠান দেখে সময় কাটালে চলবে!
কিন্তু শাহীনের কথা হলো, ‘সেটা পরে দেখা যাবে, দুপুরে মুনমুনের বাসায় আমরা একসঙ্গে খাব। তুমি আসছ বলে আরও অনেককে আসতে বলেছি। আমার ভাগনে জাহেদ তোমাকে কানেটিকাট থেকে ড্রাইভ করে নিউইয়র্কে নিয়ে আসবে।’ শাহীন আমাদের বন্ধু, তার সঙ্গে জোরজবরদস্তি করা চলে না। ঠিক হয় শাহীনের ভাগনে জাহেদ বেলা দুইটায় সাজু-স্বপন ভাইদের বাসা থেকে নিয়ে যাবে।
বিষ্ণু আমার সহপাঠী, বন্ধু, সাবিনা শারমিন নিহার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা। ফলে কোনো একটি অংশের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়াটা সমীচীন হবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় আছি। তা ছাড়া আমি তো এসেছি ঘুরতে, একজন পর্যটকের অডিটরিয়ামে বসে অনুষ্ঠান দেখে সময় কাটালে চলবে!
‘চলেন, চলেন। আমাদের এখনই বের হতে হবে’—স্বপন ভাই তাগাদা দেন। কানেটিকাটে আমাদের এক মুহূর্ত সময়ও যাতে ‘নষ্ট’ না হয় সে জন্য তাঁর চেষ্টার কমতি নেই। কম সময়ে কত বেশি জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়, বেশি জায়গা দেখানো যায়, তা নিয়ে সাজু-স্বপন ভাই দুজনেরই প্রাণান্ত চেষ্টা।
৩.
শেষ সময়টায় স্বপন ভাই-সাজুরা যে এভাবে আমাদের চমকে দেবেন, সেটা একবারের জন্য ভাবনায় আসেনি। ‘আপনারা হাঁটতে থাকেন’ বলে একটা জায়গায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে তিনি পার্কিংয়ের নির্ধারিত জায়গায় গেলেন গাড়ি পার্ক করতে। আর আমরা নেমে হাঁটব কি—একবার এদিকে, আরেকবার ওদিকে তাকাতে থাকি। চারদিকে গাছগুলোর পাতায় পাতায় রং ধরেছে, ঝকঝকে রোদ আর মাথার ওপর দিগন্তবিস্তৃত নীল আকাশ। এ কদিন আমরা নানা ঐতিহাসিক স্থাপনায় ঘুরে বেড়িয়েছি। আজ আমরা এসে পড়েছি একেবারে প্রাকৃতিক একটা জায়গায়।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
‘আমাদের তো ফল দেখাও হয়ে গেল, এবার আর দূরে কোথাও যেতে হবে না। গাছগুলো কেমন নানা রঙে সেজে আছে,’ হাঁটতে হাঁটতেই সেরীন বলে।
অক্টোবর মাসটায় প্রকৃতির রং দেখা—উত্তর আমেরিকার মানুষদের অত্যন্ত প্রিয় হবি। কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরের মানুষ দূর থেকে দূরান্তে ছুটে যান কেবল গাছের পাতর রং দেখতে। অক্টোবর মাসে, যেটি এখানে ফল সিজন হিসেবে পরিচিত, গাছগুলোর পাতার রং বদলায়, তারপর শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সেই পাতাগুলো পড়ে যেতে থাকে।
আমরা যে জায়গাটায় এসেছি তার নাম ‘উইকহাম পার্ক’। পার্ক বললে যে চিত্রটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, এটি তার চেয়ে বেশি কিছু। প্রায় ২৮০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা পার্কটায় যেমন আছে বিস্তীর্ণ খোলা ভূমি, তেমনি আছে পুকুর, বনভূমি, নানা রকমের বাগান আর ছোট্ট একটি চিড়িয়াখানা। আছে গলফ খেলার মাঠও। কানেটিকাটের শিল্পোদ্যোক্তা ক্লারেন্স উইকহামের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল এটি।
পরে এটিকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের আওতায় দিয়ে দেওয়া হয়। পুরো জায়গাটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে এটি কানেটিকাটের মানুষদের জন্য একটি বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। পিকনিক করতে, করপোরেট হাউসের সভা–সেমিনার করতে, এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠান করতেও এই পার্কে আসেন মানুষ। সবকিছুর জন্যই আগেভাগে বুকিং দিতে হয়, ফি–ও দিতে হয়। ফি অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা সময় কাটাতে যান তাঁদেরও দিতে হয়। এই ফি–টা আবার চমৎকার—প্রতিটি গাড়ি হিসেবে (প্রাইভেট কার, বাস বা বড় প্যাসেঞ্জার গাড়ির ফি ভিন্ন) সোম থেকে শুক্রবার প্রতি গাড়ি ৭ ডলার এবং ইউকএন্ড ও ছুটির দিনে ১০ ডলার।
উইকহাম পার্কের ভেতর দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি। বনভূমির ভেতরের সরু রাস্তায় জমে থাকা রঙিন পাতার ওপর দিয়ে, কখনো খোলা মাঠের সবুজ চত্বর আর ঢাল বেয়ে বেয়ে নিচের দিকে নামার চেষ্টা। চিড়িয়াখানাটায় পাখির সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে আমাদের সময় কেটে যায়। উইকহাম পার্ক—এমন একটা জায়গা, যেখানে এলে পুরো দিন হাতে নিয়ে আসতে হয়। আর আমরা কিনা এসেছি নিউইয়র্ক ফেরার তাড়া মাথা নিয়ে।
৪.
স্বপন ভাইয়ের অস্থিরতাটা মনে হয় খানিকটা বেড়ে গেছে। ‘জাহেদ সাহেব যে আমাদের পিক করতে আসবেন, তাঁকে খেতে দিতে হবে। বেরোনোর আগে আমাদের আরেক দফা খেয়ে নিতে হবে। নিউইয়র্কে গিয়ে কখন আবার খাব’—এসব নিয়ে তাঁর অস্থিরতা। এদিকে একটু পর পর শাহীনের ফোন, ‘তোমরা রওনা হয়েছে তো। আমরা অপেক্ষায় আছি। সবাই অপেক্ষায় আছি।’ প্রশ্নের পর প্রশ্ন তার।
এরই মধ্যে জাহেদ পৌঁছে যায়। তাকে অনেকটা গলাগলি করে নিয়ে ঘরে ঢোকেন স্বপন ভাই। ‘উনি আসবেন আপনাদের নিতে, সেটা তো বলেননি’—স্বপন ভাইয়ের কথা শুনে আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাই।
আসলে তারা দুজন দুজনের পরিচিত। দুজনের মধ্যে মজার একটা ব্যাপার আছে। সোয়েলুর রহমান স্বপন, মানে আমাদের স্বপন ভাই কানেটিকাট বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আর সেই সময়টায় আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিল জাহেদুল হক জাহেদ। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতার মধ্যে কী আন্তরিক সম্পর্ক! প্রবাস বলেই বোধ হয় এটা সম্ভব।
জাহেদের গাড়িতে চড়ে বসি আমরা। শাহীনের অস্থির করে তোলা ফোনের পর ফোন। ব্রুকলিনে মুনমুনের বাসায় অপেক্ষায় অতিথিরা। মাঝখানে প্রায় ১৩০ মাইলের মতো দূরত্ব। পথে জ্যাম না থাকলেও আড়াই থেকে তিন ঘণ্টার ড্রাইভ। আর নিউইয়র্কের রাস্তা মানেই তো জ্যামের পর জ্যাম। জাহেদ গাড়ি ছেড়ে দেয়। ম্যানচেস্টারে সাজু আর স্বপন ভাইদের বাড়িটা পেছনে ফেলে জাহেদের গাড়িটা এগোতে থাকে। সেরীন পেছন ফিরে তাকায়। বলে, ‘আহা! স্বপন ভাইয়ের চোখ দুটো কেমন ছলছল করছে। আমি আর সেদিকে তাকাতে পারি না।’
জাহেদের কৌশলী ড্রাইভিংয়ে গাড়িটা গতি পেতে শুরু করেছে। নিউইয়র্ক ডাকছে কি না...। চলবে...