সিডনি থেকে হ্যালিফ্যাক্স-পঞ্চম পর্ব
কেপ ব্রেটনের সিডনিতে কাটানো তিন বছরের সময়কাল নিয়ে একটা আস্ত উপন্যাস লিখে ফেলাটা আমার জন্য এখন আর তেমন কোনো দুষ্কর কাজ নয়।
শুরুতে ভাড়া বাসা নিয়ে ঝঞ্ঝাট থেকে শুরু করে নতুন বাসায় ওঠা, একে একে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আসা অগণিত মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, নতুন বন্ধুবান্ধবীর সাহচর্য, কিছু প্রিয় অধ্যাপক, শীতের কাঁপুনি থেকে শুরু করে নবযৌবনা গ্রীষ্ম এবং হরেক রঙের শরৎকালের মধ্য দিয়ে বছরের অন্তে ঋতুর পুনরাবৃত্তি। পড়াশোনা ও খণ্ডকালীন চাকরির যুগপৎ মেলবন্ধন। অধ্যয়নের সফল পরিসমাপ্তি এবং পূর্ণকালীন চাকরির প্রারম্ভিক পর্যায়ে ভয়ংকর কোভিড অতিমারির আগমন এবং সিডনিতে চাকরির জন্য হাহাকার। পরবর্তীকালে আমার হ্যালিফ্যাক্স শহরে স্থানান্তরিত হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত সিডনি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। এর বিস্তারিত অংশের ঘটনাক্রম আমার বই ‘কানাডার পথ ও রথের বৃত্তান্ত’–এ বর্ণিত রয়েছে। আগ্রহী ব্যক্তিদের উল্টে দেখার আমন্ত্রণ রইল।
সিডনি কিছু বিষয়ে অন্য যেকোনো শহর থেকে অনন্যময়ী।
প্রথমত, এর স্থানীয় অধিবাসীরা। কেপ ব্রেটনের মানুষের মতো মিষ্টি স্বভাবের লোকজন আমি কানাডার অন্য কোনো শহরে দেখিনি।
তাঁরা আপনার সঙ্গে অকারণে হেসে কথা বলবেন। অনেক গল্প জুড়ে দেবেন এবং আবার দেখা হলে গল্প যেখানে শেষ হয়েছিল, সেখান থেকে শুরু করবেন। আমার সঙ্গে বেশ কয়েকবার এ ঘটনা ঘটেছে। খুব মন খারাপের একদিনে যখন আমি বাসে চড়ে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরছি, তখন একজন বৃদ্ধের সঙ্গে হঠাৎ সাক্ষাৎ এবং মজার সব গল্প শুনে খুব আত্মতুষ্টির হাসি নিয়ে বাসায় ফিরেছি। আবার দেখা গেছে, সকালে ইউনিভার্সিটিতে যাব, বেশ মন মরা লাগছে। বাসে উঠতে গিয়ে নারী বাস ড্রাইভার খুব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘গুড মর্নিং সুইটহার্ট! হাউ আর ইউ টুডে?’
বোঝেন অবস্থা? এরপর আর মন ভালো না করে কোনো উপায় আছে?? এমন অসংখ্য ছোট ছোট স্নিগ্ধ শান্তির পরশ বোলানো ঘটনায় পূর্ণ হয়েছে আমার সিডনির জীবন!
দ্বিতীয়ত, এর চোখজুড়ানো অবারিত সৌন্দর্য! ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় চাকরির সুবাদে আমার তিনটি জায়গায় নিত্যদিন যাতায়াত ছিল। বাসা থেকে ইউনিভার্সিটি ও নর্থ সিডনি।
আমি সকাল সাতটা-সাড়ে সাতটায় বাসা থেকে বেরিয়ে ফিরতাম রাত সাড়ে ১১টার পর। সিডনি শহর থেকে নর্থ সিডনির দূরত্ব প্রায় ২৮ কিলোমিটার। মূল বাসস্ট্যান্ড ডরচেস্টার থেকে শুরু করে মধ্যখানের এলাকা সিডনি রিভার পেরিয়ে যাওয়ার পথে দুর্গম পথের মধ্য দিয়ে যেতে হতো। পাহাড়ি রাস্তায় কোল ঘেঁষে ছিল এক বিশাল লেক, নাম ‘পোটল লেক’।
এই লেকের মনমর্জি একেক সময়ে একেক রকম হয়ে আমাদের চোখের সামনে উন্মুক্ত হতো। শীতের কাঁপুনির সময় পুরো হ্রদের পানিই জমে সাদা বরফখণ্ডে পরিণত হতো। দূর থেকে চোখ ঝাপসা করে আসা শুধু ধোঁয়াটে কুয়াশা আর কুয়াশা। অথচ গ্রীষ্মে আর শরতে তার হাবভাব পুরোই অন্য দৃশ্যপট নিয়ে হাজির হয়। আকাশের নীল আর জলের রঙে একাকার হয়ে দূরের নীলিমায় মিলে যায়। মনে হয়, পৃথিবীর শেষ দিগন্তে উপস্থিত আমরা।
কনসেন্ট্রিকসে কাজের সময় গ্লেস বে যাওয়ার পথে বাসের জানালা দিয়ে ডমিনিয়নের সমুদ্রের তীর দেখতে পাওয়া যায়। পাহাড়ের ওপর দিয়ে বেশ ঘোরানো সেই পথে বাস যাওয়ার সময় মনে হতো আমরা এই বুঝি অন্য পথ বেয়ে সমুদ্রের তীরে গিয়ে পৌঁছাব। ওপেন হার্থ পার্কের সৌন্দর্য অতুলনীয়। এক বিকেলে জাসলিনের সঙ্গে বসে যখন কথোপকথনরত, তখন আমরা দুজনেই দেখলাম তিন রঙে রাঙানো আকাশের অপার স্নিগ্ধ রূপ। ওখানকার জলাশয়ে ঝরনার তরঙ্গে আকাশের তিন রং মিলে হোলি খেলার আয়োজন করা হয়েছে, এমনটা ঠাওর হতো।
তৃতীয়ত, মানুষের সহজ–সরল জীবনযাপন।
সিডনি আপনাকে কর্মব্যস্ত দিন শেষে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে দেবে। এ শহরের মানুষেরা তাড়াহুড়ো করে কম। তারা ধীরস্থির স্বভাবের। হয়তো ছোট শহর বলেই তাদের জীবনযাত্রার ধরন প্রাণকেন্দ্র হ্যালিফ্যাক্স বা টরেন্টো থেকে একদম আলাদা। জীবিকার অন্বেষণে দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা ভুলেই যাই, মাঝেমধ্যে দম নিতে হয়! একা বা একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে বসে সুখ-দুঃখের দিনগুলো নিয়ে কথা বলতে হয়। এই তো জীবন!
আরও অনেক কারণে সিডনি আমাকে যে অনুভূতি দিয়েছে, তা অন্য কোথাও খুঁজে পাব না। কারণ, পৃথিবীর সব ভিন্ন অনুভূতির পৃথক সৌন্দর্য রয়েছে। আমার জন্ম যে শহরে, কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনা সেই শহর সারা জীবন তিলোত্তমা হয়ে রইবে। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমাদের আড়াই–তিন ঘণ্টার পথ পেরিয়ে চট্টগ্রাম শহরে যাতায়াত করতে হতো। কিন্তু সেই ছোট্ট শহরের মায়া আমি কোনো দিনই ছাড়তে পারব না। কানাডার সিডনিও আমার কাছে ঠিক তা–ই! পৃথিবীর আর কত শহর আমার দেখার বাকি আছে জানি না, তবে কেপ ব্রেটন সিডনি অনন্যা, অদ্বিতীয়া, তুলনাহীনা!
এবার আমরা কথা বলব প্রদেশ নোভাস্কোশিয়ার প্রাণকেন্দ্র হ্যালিফ্যাক্স শহর নিয়ে। এতে আমাদের বন্ধু হয়েছেন ডালহৌসি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি তরুণ প্রান্ত কুমার কুরী। ক্রমে...