সিডনি থেকে হ্যালিফ্যাক্স-তৃতীয় পর্ব

বুঝতে বাকি রইল না, এনার কথাই হেলেন বলেছিলেন।

বললাম, সকালেই হেলেন আপনার কথা বলেছেন।

আমি: উনি তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ! আমার তো শুনে যা ভালো লাগছিল।
সরকার ভাই: ও! তাই নাকি? হ্যাঁ, ওরা তো অঙ্কের মতো নম্বর দেয়। কখনো গড়িমসি করে না। বুঝতে পারবেন নম্বর তোলা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। কোন কোন সাবজেক্ট নিয়েছেন?

লরি চলে এসেছে। কাজেই কিছুক্ষণ বিরতি দিতে হবে। অনেকটাই পদার্থবিজ্ঞানের মতো লাগছিল। জুল, কেলভিন—এসব নিয়ে লেকচার সাজানো। সূত্রও দেখতে পাচ্ছি। ভাবছি, এগোতে হবে কীভাবে? গণিতের মারপ্যাঁচ শিগগিরই শুরু হয়ে যাবে হয়তো! একটু করে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে দেখলাম, কীভাবে এগোব?

দেখেন কী হয়? খুব কঠিন কিছু না! বললেন উনি।

রসকষহীন ক্লাসের পরিসমাপ্তি ঘটল! ভাবছি, শুরুতেই এ অবস্থা, সামনে কী হবে, কে জানে? লরির ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। গত ক্লাসে যত উপস্থিতি ছিল, আজ তার চেয়ে কমে অর্ধেক হয়েছে।

দেখলাম, ক্লাস শেষ হতেই এক চায়নিজ তরুণী ভাইয়ার কাছে কোনো ডকুমেন্ট চাইতে এল। ভাইয়া চট করে ব্যাগ থেকে বের করে দিয়ে দিলেন। আর এক আফ্রিকান তরুণীকেও দেখতে পাচ্ছি। ওকেও বেশ কিছু কাগজপত্র ভাইয়া দিয়ে দিলেন। তরুণী আমাকে দেখিয়ে জানতে চাইল, এটা কে? উনি বললেন, আমার দেশীয় ছেলে।

ভাইয়া: ওর নাম এমিলি। ও নাইজেরিয়ান। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে।

করমর্দন করে তরুণী জানতে চাইল, এমিলি, হাই! তোমার নাম কী?

আমি পুরো নাম বলার পর ও কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল ‘গুপ্তা’? আমি তোমাকে গুপ্তা বলেই ডাকব, ঠিক আছে তো? স্বাভাবিকভাবেই সায় দিলাম। আমার রুটিনটা দেখতে চাইল ও। দেখে সঙ্গে সঙ্গেই ফোন নম্বরটাও নিয়ে নিল। কারণ, দুজনেরই রুটিন হুবহু একই রকম। তারপর আমাকে আর ভাইয়াকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।

কোর্স নিয়ে ভাইয়ার সঙ্গে বিস্তারিত বাক্যালাপ শুরু হয়ে গেল। প্রথমে বার্ণিকে নিয়ে বললেন, ‘বার্ণি কী কী পড়িয়েছেন এখন পর্যন্ত?’

আমি: স্টেফাইলোকোক্কাস অরিয়াস শেষের পথে।

ভাইয়া: ঠিক আছে। আমার কাছে কিছু পুরোনো প্রশ্ন আছে। পরের ক্লাসে নিয়ে আসব আপনার জন্য। আচ্ছা! এমিলিকে তো দেখলেন, ওকে ওই প্রশ্নগুলোই দিয়েছি। ওর কাছ থেকেও নিতে পারেন। প্রফেসর সাহেবের প্রশ্ন করার ধরনটা অন্য সবার চেয়ে ভিন্ন। ভেতরে মনোযোগসহ খুঁটিনাটি না পড়লে প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারবেন না। রচনামূলক আর সংক্ষিপ্ত—উভয় ধরনের প্রশ্নই থাকবে। ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। কিছু না বুঝলে ফোন দিয়েন।

আমি: অকুপেশনাল হাইজিন নিয়ে কী করব? অসংখ্য পয়েন্ট দেওয়া, কোনোটা ছেড়ে কোনোটা মনে রাখব, সেটাই তো বুঝি না!

ভাইয়া: পুরোটাই পড়ে যাবেন। ক্লাসে বুঝতে পারবেন উনি কোনো জায়গার গুরুত্ব বেশি দিচ্ছেন, প্রশ্ন ওখান থেকেই আসবে। চিন্তা করবেন না, নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নেই পরীক্ষা হয়। হেলেনের পরীক্ষা সব সময় সহজ হয়। ম্যালিসার ফুড হাইজিন সবচেয়ে সহজ! নম্বর তোলাও পানি-ভাত।

আমি: বুঝলাম! আর ওনার আরেকটা বিষয়ও আছে, পাবলিক হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। কীভাবে পড়ব?
ভাইয়া: চিন্তার কিছু নেই। ম্যালিসা হিন্টস দিয়ে দেবে। এই বিষয়ে কোনো পরীক্ষা হয় না। শুধু অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবেন।

আমি: কী? আমাদের ক্লাসে যে সিলেবাস দিয়েছে, ওখানে তো পরীক্ষার তারিখ দেওয়া আছে।

ভাইয়া: তাই নাকি? তাহলে পাঠ্যসূচি বদলে ফেলেছে। ছাত্র-ছাত্রী অনেক বোধ হয়।

আমি: অনেক কি না, জানি না। তবে আপনাদের ক্লাস থেকে তো বেশি হবেই। তাহলে সহজ বলতে গেলে শুধু ফুড হাইজিন।

আরও পড়ুন

ভাইয়া: আরে সবই সহজ। বললাম না, নম্বর তোলা ডালভাত! শুধু বার্ণি কিছুটা কার্পণ্য দেখাতে পারে!

তারপরও যা উনি চাইছেন, ওটা লিখতে পারলে পুরো নম্বর দিয়ে দেন। যথার্থ যাচাই না করে নম্বর দেন না, এই আর কি! আচ্ছা! আজ এরপর ক্লাস কয়টায়? আড়াইটায়?

আমি: হ্যাঁ।

ভাইয়া: তাহলে চলেন ঘুরে আসি। আমি নো-ফ্লিলস যাব। মসলা কিনতে চাইলে ওখানে যাবেন। গেছেন কখনো?

আমি: না।

ভাইয়া: কোনো কাজ নেই তো?

আমি: না! চলেন!

বাইরে বরফের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি! আমি আর ভাইয়া গাড়ির পার্কিং লোকেশনের দিকে যাচ্ছি। গাড়ি রাখারও নিয়ম আছে। দাগ কাটা আছে। একটা জায়গায় কমপক্ষে পাঁচটি গাড়ি রাখা যায়। ওই নির্দিষ্ট জায়গার বাইরে রাখলেই জরিমানা। ভাইয়ার হয়েছিল। কারণ, বরফে ঢাকা থাকার কারণে উনি সঠিক জায়গার বাইরে চলে গিয়েছিলেন।

যেতে যেতে প্রথম দিককার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন, যখন উনার গাড়ি ছিল না। বাসে একটু বেশি জিনিসপত্র নিয়ে উঠলেই ড্রাইভার আপত্তি জানাত। তাঁকে অনুনয়-বিনয় জানিয়ে কোনোমতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া! কোনো জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে আর একই সময় কোনো বাস না থাকলে ট্যাক্সি ডাকা ছাড়া কোনো রাস্তা নেই। ট্যাক্সি ডাকা মানেই ডলারের শ্রাদ্ধ! বাসের অবস্থাও শোচনীয়, এক ঘণ্টা পরপর বাস। কোনো কারণে বাস চলে গেল মানে এক ঘণ্টার বিরতি, যেটা কানাডার মতো দেশের জন্য অনেক বড় কিছু। এখানে এক সেকেন্ডেরও অনেক দাম!

পৌঁছে গেলাম নো-ফ্রিলস সুপারশপ। এশিয়ান নানা রকমের মসলা বিশেষ করে ভারতীয় মসলা, চাল, ডালসহ আরও হরেক রকমের মুদির দোকানের জিনিসপত্র অনায়াসেই পাওয়া যায়। বলতে গেলে সুলভ মূল্যে পাওয়া যায় এখানে। কানাডিয়ানদের পাশাপাশি এশিয়ান মানুষ—বাংলাদেশি, ভারতীয়, চায়নিজ—সবার জন্য কেনাকাটার অন্যতম ভরসাস্থল নো- ফ্লিলস।

ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,  মসলাপাতি কিনেছেন?

বললাম, ‘না, এখনো কেনা হয়নি! জানিই না কোথায় পাব? এত দিনে আপনি আসল ঠিকানার সন্ধান দিয়েছেন।’

কোথায় কী পাব, সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে দিতে লাগলেন।

ওয়ালমার্টের মতো বিশাল না হলেও এদের অনেক জিনিস আছে, যা ওখানে পাব না। যেমন: চিড়াভাজা, ভেলপুরি, মটরভাজা। সবই প্যাকেটে পাওয়া যায়, যেগুলো ভারতীয়। সবজির দামও কম মনে হচ্ছে! দুধ কিনলেন ভাইয়া। দেখতে দেখতে ভাইয়ার শপিং কার্ট ভর্তি হয়ে গেল। আমারও দুহাতে থাকা শপিং ব্যাগ ভারী হয়ে গেছে!

বাইরে তুষারঝড় হচ্ছে। আজকে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রাতে ঘূর্ণিঝড় হবে। পুরো শহরে রেড অ্যালার্ট, মানে আবহাওয়াজনিত, অন্য কিছু নয়। সবার কাজকর্ম স্বাভাবিকভাবেই চলবে, শুধু ঝড়ের সময় বাইরে না গেলেই হলো। আমরা জিনিসপত্র গাড়ির পেছনে রেখে ইউনিভার্সিটিতে ফেরত যাচ্ছি।

দুজনেরই ক্লাস আছে প্রায় একই সময়ে! ক্লাস শেষে আবার একসঙ্গে ফিরে যাব, এমনই কথা হলো। ভাইয়ার সঙ্গে গাড়িতে ফিরছি, গান বাজিয়েছেন শ্রীকান্তের, ‘আমি যামিনী,  তুমি শশী হে..’। কানাডার মাটিতে স্বদেশের পরশ পাচ্ছি, খুব না হলেও আলতো পরশ বলব!

যেতে যেতে ভাইয়াকে গাড়ির গতিসীমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম। অতিক্রম করলে কত ডলার ফাইন হয়, সর্বোচ্চ কত পর্যন্ত হতে পারে, কোনো রকমের টিকিট দেয় কি না, দিলে সেটা কত দিনের জন্য—এসব আর কি।

প্রথমত, গতিসীমা রাস্তায় যেসব নির্দেশনা দেওয়া থাকে, ওভাবে দেওয়া থাকে, ভাইয়া আমাকে দেখিয়ে দিলেন একটা। দ্বিতীয়ত, ফাইন নির্ভর করে অপরাধের মাত্রার ওপর।
তৃতীয়ত, টিকিটের ফি তখনই দিতে হয়।

আরও পড়ুন

আবার হাইওয়ে পুলিশ সাধারণ মানুষের বেশেও থাকে। ব্যবহৃত গাড়ি দেখেও বোঝার উপায় নেই ভেতরে পুলিশ বসে আছে। এদের ঘোস্ট পুলিশ (ভূত পুলিশ) বলে। লুকিয়ে ফাঁদ পেতে থাকার পর হঠাৎ এসে উপস্থিত হওয়ার জন্যই হয়তো এমন নাম! যা-ই বলি না কেন, নামটা বেশ মজার!

ঘোস্ট পুলিশ যেকোনো সময় পাকরাও করতে পারে নিয়মভঙ্গকারীকে।

যেতে যেতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে সামনের গাড়ির পেছনের চাকায় লেগে একটুকরা বরফের খানিকটা অংশ এসে সরাসরি পড়ল আমাদের গাড়ির কাচের সামনে। কিছুক্ষণের জন্য সব অস্পষ্ট হয়ে গেল, কারণ কিছুই দেখা যাচ্ছে না! তাড়াতাড়ি সিগন্যাল দিয়ে ভাইয়া গাড়ির গতি কিছুটা কমিয়ে গাড়ির গ্লাসের ওয়াইপার ব্লেড  দিয়ে বরফ সরিয়ে ফেললেন। পুরো ঘটনাই ঘটে গেল কয়েক মিনিটের ব্যবধানে! এখানে ড্রাইভিং আসলেই অনেক সহজ। কারণ, সবাই প্রতিটা নিয়ম মেনে চলে অক্ষরে অক্ষরে; কিন্তু গাড়ি চালাতে হয় খুবই সতর্কতার সঙ্গে। কখন কী ঘটে যাবে, কেউই জানে না! খুবই সামান্য একটা ভুল দেখা দিতে পারে বিষফোড়া হয়ে! এই যেমন এখন যা ঘটছিল!

ভাইয়া কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও পরিস্থিতি বেশ ঠান্ডা মাথায় সামাল দিলেন। উনিও একবার অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলেন। গাড়ির গতি সামান্য বেশি থাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকটি গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে উভয় গাড়ির গতিই বেশি ছিল। ভাইয়ার পায়ে কিছুটা ক্ষত হয়েছিল, ব্যথাও পেয়েছিলেন। তবে সেটা বিশেষ কিছু ছিল না। ফাইন হয়েছিল।

পৌঁছে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্লাসে যাওয়ার পালা। আপাতত বিদায় বলে চললাম ক্লাসের দিকে। ম্যালিসার ‘পাবলিক হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ ক্লাস।

ক্লাস শেষে বাইরে এসে দেখি তুষারঝড় শুরু হয়ে গেছে। এখনো ততটা প্রবল নয়, তবে হতে কতক্ষণ? ভাবছিলাম, আজ পৌঁছাব কীভাবে? বাসে হোক বা গাড়িতে!
ভাবতে ভাবতেই ভাইয়ার ফোন, ‘কোথায়? আপনার ক্লাস শেষ?’
বললাম, ‘হ্যাঁ, আপনি কোথায়?’

ভাইয়া:  চলে আসেন। আমি লাইব্রেরির গেটে আছি। উঠে বসলাম গাড়িতে। আমাদের দেশে যেমন সজোরে বৃষ্টিপাত হয়, তেমনি এখানেও একই দৃশ্য, পার্থক্য শুধু ওখানে পানির ফোঁটা আর এখানে বরফ!

গাড়ি স্বাভাবিকভাবেই এগোচ্ছে। ভাইয়া গ্লাসের ওয়াইপার ব্লেডটা অটো করে দিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরপর বরফের শুভ্রতায় গাড়ির সামনের গ্লাস সাদা হয়ে যাচ্ছে আর সেগুলো সরিয়ে দিচ্ছে ব্লেড। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কিছুটা কমে এসেছে। ভাইয়া বলতে লাগলেন, এ সময় খুব সাবধান হয়ে গাড়ি চালাতে হয়। যেতে যেতে আমার ঘরের আশপাশের কোনো একটা রাস্তায় ঢুকে পড়লেন। উনি গাড়িতে জিপিএস দিয়েই যাচ্ছিলেন; কিন্তু ওখানে যাওয়ার পর কিছুটা ভুল কমান্ড দেওয়ার কারণে গাড়ির গতিপথ গেল পাল্টে।

আমি ফোন বের করে উনাকে দেখালাম। এক মোড়ে এসে সামনের  স্টপ সাইনটা খেয়াল না করেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই অপর দিক থেকে আরেকটা গাড়ি হঠাৎ সামনে চলে এল। ভাইয়া আগেই ব্রেক কষলেন সজোরে! মোটামুটি মাঝারি ধরনের একটা দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেলাম। আর কিছুটা সামনে এগোনোর পরই আমি রোডটা চিনতে পারলাম।

ভাইয়াকে বাসাটা দেখিয়ে দিলাম। আমাকে নামিয়ে দিয়ে ভাইয়া চললেন। গাড়ির পেছন থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে নিয়ে তাড়াহুড়ো করেই ঘরে ঢুকে পড়লাম। আবহাওয়ার পরিস্থিতি যেভাবে বেগতিক দিকে মোড় নিচ্ছে, তাতে ভাইয়া কীভাবে বাসায় পৌঁছাবেন, সেটা ভেবে রীতিমতো শঙ্কিত হলাম। তখনই ভেবে রাখলাম, ঠিক এক ঘণ্টা পর ভাইয়াকে একটা কল দিতে হবে। জিনিসপত্র একে একে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে দেখি যে জিনিস নেওয়ার জন্য এত সংগ্রাম, সেই মসলার ব্যাগটাই উধাও! এখন কী হবে? চলবে....