সিডনি থেকে হ্যালিফ্যাক্স—২য় পর্ব

সিডনি শহরের নানা জায়গাছবি: লেখক

২০১৮ সালে কানাডায় প্রথম গ্রীষ্মে সিডনির সৌন্দর্যে চোখ জুড়িয়েছে। এমন অনেক দিক গেছে যখন জীবনের প্রতি মুহূর্ত সংকটের চূড়া ছুঁয়েছে। কিন্তু কষ্ট ভুলতে বাইরে বেরিয়ে চারপাশের অবারিত সবুজ, দূরের পোটল লেকের শান্ত ঢেউয়ের আকাশের নীলের আভায় মিলে যাওয়া, ডাউনটাউনের সুনসান নিস্তব্ধতা, লাইব্রেরিতে নতুন-পুরোনো বইয়ের পাতার গন্ধ এবং কেপ ব্রেটনের স্থানীয় মানুষের সুমিষ্ট ব্যবহারে দিনগুলো কেটেছে বেশ। জীবনের গতিপথে সিডনি শহরের বিচিত্র ঘটনাবলি অভিজ্ঞতার খাতায় নতুন পালক যুক্ত করেছিল তা সন্দেহাতীত।

তবে এখানকার বাসস্থানসংকট, চাকরির অপ্রতুলতা, যানবাহনের দীর্ঘসূত্রতার কারণগুলোই আমার মতো যেকোনো প্রবাসী ছাত্রছাত্রীর জীবনে নিত্যনতুন সমস্যার সৃষ্টি করেছে।

বাসস্থানসংক্রান্ত সমস্যার কারণ অতিরিক্ত প্রবাসী ছাত্রছাত্রীর চাপ।

২০১৭ সাল পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে কেপ ব্রেটন  ইউনিভার্সিটি লাগাম রাখলেও ২০১৮ থেকে এর অবনতি ঘটে এবং এখনো তা অব্যহত রয়েছে। সমস্যা তখনই ঘনীভূত হয়, যখন কোনো জায়গায় প্রয়োজনের তুলনায় অধিক পরিমাণ বিষয়বস্তুর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এ ক্ষেত্রে আমরা হলাম সেই বলির পাঠা! ২০১৮ সালে আমার সময়ে যেখানে ভর্তি হতো ১ হাজার ৯৮২ জন, পরে ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৬১৬ জন। সেই একই সংখ্যা পাঁচ বছর পরে গত বছরের সেপ্টেম্বর হয়ে গেছে ৮ হাজার ৫১৭ জন! ২০২৩ সালে গত পাঁচ বছরে ভর্তি হওয়া প্রবাসী ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২৫০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০০ জনে।

বাসের অপেক্ষায়
ছবি: সংগৃহীত

প্রবাসী ছাত্রছাত্রীরা প্রতি শিক্ষাবর্ষে কমবেশি ২০ হাজার ডলার পড়াশোনার খরচ এবং বেতন বাবদ বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিশোধ করে থাকেন। বোঝাই যায়, কতটা ব্যয়বহুল পড়াশোনার খরচ!

দ্বিতীয় যে সমস্যা সব সময় দেখে এসেছি—কর্মসংস্থানের অভাব। ইউনিভার্সিটিতে সবাইকে গল্প করতে শুনতাম চাকরি পাওয়া না–পাওয়া নিয়ে বেশি আর পড়াশোনা নিয়ে কম, একদম কম! প্রথম পর্বে যে সিডকোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা শুনিয়েছিলাম, মূলত তখন থেকেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও খারাপের দিকে চলে যায় সিডনিতে। কারণ, অত বড় আর কোনো কোম্পানি সিডনিতে গড়ে ওঠেনি।

সিডনির দ্বিতীয় বৃহৎ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে কেপ ব্রেটন ইউনিভার্সিটি ঘিরে। কাজেই এখানে যাঁরা জড়িত আছেন, তাঁদের তেমন একটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না। আমি নিজেও ছাত্র থাকা অবস্থায় এখানে চাকরি করেছি এবং সেই সুযোগ–সুবিধার অংশীদার ছিলাম। ওরা ছাত্রদেরও নিজেদের কর্মকর্তার মতো নানা সুবিধা দিয়ে থাকে। মুশকিল হচ্ছে, এত প্রতিযোগিতার মধ্যে চাকরি পাওয়াটাই কঠিন কাজ।

আরও পড়ুন

তৃতীয় সমস্যার কারণ অবশ্যই উপযুক্ত সরকারি যানবাহনের অপ্রতুলতা। কেপ ব্রেটন ট্রানজিট সিডনির সরকারি যানবাহন সংস্থা। আমি যখন ক্লাস শুরু করি, তখন দুটি বাস পাল্টে ইউনিভার্সিটিতে যেতাম।

প্রথম যে বাসায় গিয়ে আমি উপস্থিত হই, সেখান থেকে প্রথম বাস ১৩ নম্বর। এরপর আরেক জায়গা থেকে ১ বা ৯ নম্বরে সোজা ইউনিভার্সিটি। সমস্যা হচ্ছে ১৩ নম্বর বাসের অপেক্ষায় থাকা এবং এর অপ্রতুলতা। আর ওই বাস চলত সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। এরপরে ওই রুটে আর কোনো বাস নেই! এমন অনেক দিন গেছে যখন আমি ওই জায়গা থেকে সটান হেঁটেই বাসায় গেছি। তা–ও মাইনাস ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে! যাদের নিজস্ব গাড়ি ছিল, তাদের কখনোই তেমন কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো না। বাসের জন্য অনেক দীর্ঘ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বাসে ওঠার বিষয়টি অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল ওই সময়। বাড়তি ছাত্রছাত্রীর চাপ সামলাতে পৃথক বাসের ব্যবস্থা করেছিল কেপ ব্রেটন ট্রানজিট। ওই বিশেষ বাসগুলো শুধু আমাদের আনা–নেওয়ার কাজ করত। এরপরও ক্রমাগত আসতে থাকা ছাত্রছাত্রীদের চাপ সামলাতে ওরাও হিমশিম খেত। ২০১৮ সালে অনেক অনেক অসুবিধার মধ্যে কাজ, পড়াশোনা চলেছে। পরবর্তী বছরে এর চেয়ে সমস্যা অনেকাংশেই কমে এসেছিল। ওরা অনেক দূরের রুটের বাসও রাত নয়টা পর্যন্ত রেখেছিল। তবে সবখানে সমানভাবে করতে পারেনি। সেই সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। কানাডাতে একটা সময় পরে নিজস্ব গাড়ির ব্যবস্থা করতে হয়। নচেত অদূর ভবিষ্যতে কপালে দুর্গতি লেখা রয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত

কানাডাজুড়েই এই কথা প্রযোজ্য। পৃথিবীজুড়ে কার্বন নিঃসরণ বেড়েই চলেছে। সামনেও তা অব্যাহত থাকবে। কেন? নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।

মূলত বেশ কয়েকটা জায়গার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সিডনি শহর। এক প্রান্তে ডমিনিয়ন, গ্লেস বে থেকে শুরু করে নিউ ওয়াটারফোর্ড পেরিয়ে সিডনি, সিডনি রিভার এবং নর্থ সিডনি। এর মধ্যে আমার যাতায়াত ছিল সিডনিজুড়েই। প্রথম কর্মস্থল ছিল সিডনির এক প্রান্তে নর্থ সিডনিতে। এরপর সিডনিতেই, আমার ইউনিভার্সিটিতে। আর পড়াশোনার পর গ্লেস বে থেকে নর্থ সিডনি পর্যন্ত যাতায়াত ছিল আমার। সিডনি শহরের মানুষের স্বভাব ছিল দুর্দান্ত। ওরা কারণে–অকারণে গল্প করতে পছন্দ করত। নিজের আপনজন ভেবে কথা বলত। একটা প্রশ্ন প্রায় সবাই করত, ‘তোমার দেশকে তুমি কতটা মিস করো?’
দেশকে সবাই ভালোবেসে নানা অনুষঙ্গের অভাব অনুভব করি। তবে কিছু মানুষের উপস্থিতি আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। আমার জীবনে এমন একজন মানুষ ছিলেন এবং এখনো আছেন—সরকার ভাইয়া। অহিদুজ্জামান সরকার। যখন ইউনিভার্সিটিতে প্রথম দিন আমাদের ডিন হেলেনের সঙ্গে দেখা হয়, ওই দিনই উনি ভাইয়ার কথা আমাকে বলেছিলেন।

বাসে ওঠার ঠিক আগে
ছবি: সংগৃহীত

ঘটনাটা ছিল এ রকম—
আজ মঙ্গলবার। ভাবলাম হেলেনের সঙ্গে একটু দেখা করে আসি। ওনার ক্লাস নেই। গেলাম পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টে। মোট পাঁচটা রুম আছে এখানে। প্রথম দিকের দুই রুম বাদ দিয়ে এগিয়ে কিছুটা ভেতরে গেলেই ম্যালিসার রুম, এরপর বার্নি আর শেষেরটা হেলেনের। রুমের সামনে দাঁড়াতেই হেলেন ডাক দিলেন—
হেলেন, হ্যালো অতনু! কেমন আছ? আসো, ভেতরে আসো!
আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ হেলেন?
হেলেন—ভালো, খুব ভালো। কেমন লাগছে ক্লাস? সবার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে? নতুন বন্ধু?
আমি—হ্যাঁ, এই তো! অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে। আমার রুমমেট-ই তো পাঞ্জাবি!
ও! তাই নাকি? ভালো, ভালো! তোমার জন্য আফসোসের বিষয় এই যে এবারের জানুয়ারি ব্যাচে কোনো বাংলাদেশি নেই! কিন্তু আমার দৃঢ়বিশ্বাস তুমি শিগগিরই অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নেবে। ঠিক কি না?
হ্যাঁ, অবশ্যই!
তবে তুমি আগের ব্যাচের একজন বাংলাদেশিকে খুঁজে পাবে—সরকার! খুবই মেধাবী! গত সেমিস্টারে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া ছাত্র—৯০ শতাংশের বেশি।
সরকার? উনার পুরো নাম কী?
অসুবিধা নেই! ক্লাসে আগের ব্যাচের কাউকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। ওকে সবাই চেনে।
ঠিক আছে। আজকেই জিজ্ঞাসা করব।
বাকি সবকিছু ঠিকঠাক?
হ্যাঁ, সব ঠিক! আসি তাহলে?
ঠিক আছে। আবার দেখা হবে।
অবশ্যই। বাই!
হেলেন ইশারায় হাত নাড়লেন।
পরের ক্লাস, এয়ার পলিউশন—প্রফেসর লরি ডি অরসে।

লরির ক্লাসটা হতো বেশ বড় একটা রুমে। কারণ, দুটি কোর্সের সবাই একত্র হতো—পাবলিক হেলথ আর এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং। ভিন্ন কোর্স হলেও একই বিষয় উভয় কোর্সের জন্য প্রযোজ্য।
আজকে ক্লাসে ঢোকার পর সামনের সারির দিকে এগোতেই একজন মধ্যবয়স্ক সুদর্শন যুবককে দেখতে পেলাম। ডেকে জিজ্ঞেস করলেন—‘বাংলাদেশি নাকি?’ কিছুটা হতবাক হয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ।’ পাশের সিটে রাখা ব্যাগ দ্রুত সরিয়ে নিয়ে জায়গা করে দিলেন। বসে পড়লাম। তিনি বললেন, ‘আমি অহিদুজ্জামান সরকার।’ বুঝতে বাকি রইল না এনার কথাই হেলেন বলেছিলেন। চলবে...

তথ্যসূত্র: সিবিসি নিউজ এবং সিটিভি নিউজ, দ্য আটলান্টিক