সিডনি থেকে হ্যালিফ্যাক্স: চতুর্থ পর্ব
আগের পর্বের ধারাবাহিকায়...
সরকার ভাইয়ার গাড়ি থেকে মসলার প্যাকেটগুলো সংগ্রহ করে নিই। পরের ক্লাসের দিন পেয়ে যাই ওগুলো। গাড়ির পেছনেই রাখা ছিল।
সিডনির গল্পে সরকার ভাইয়াকে ছাড়া আমার গল্প অপূর্ণ থেকে যেত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সবার জীবনেই এমন এক বা একাধিক মানুষ রয়েছেন। আমার টিকে থাকার পথকে এসব সুহৃদ বরাবরই মসৃণ, সুগম করেছেন। তাঁদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।
কেপ ব্রেটনের সিডনির গল্প বলতে গেলে কিছু বাস্তবধর্মী পরিস্থিতির সঙ্গে আরও অনেক কিছুর কথা চলে আসে অকপটে। বন্ধুদের গল্প, পড়াশোনার গল্প, ভ্রমণের গল্প, হারানোর গল্প, অর্জনের গল্প এবং আরও অসংখ্য না বলা স্মৃতিরা ভিড় করে।
প্রথম তিন পর্বে ২০১৮-২০১৯—এই সময়কাল এবং সরকার ভাইয়ার কথা শুনিয়েছি। এবার আমরা ২০২০ মহামারি–পরবর্তী সিডনির অবস্থা দেখার চেষ্টা করব। পাশাপাশি কিছু তথ্যও জেনে নেব।
সব জায়গার মতো সিডনিও কোভিডে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়। আমার অধিকাংশ সহপাঠীর সঙ্গে মূলত এ সময়ই যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারা ভিন্ন ভিন্ন শহরে চলে যেতে শুরু করে। একদিকে আগে থেকেই সিডনির কর্মসংস্থানের টালমাটাল পরিস্থিতি আর এদিকে তার ওপর যুক্ত হয় অতিমারি কোভিডের মরণকামড়। অনেক রেস্তরাঁ, কফি শপ ওই সময় মারাত্মক আর্থিক অসচ্ছলতার মুখে পড়ে কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়। আমাকে সেই দুর্ভাগ্যের শিকার তখন হতে না হলেও পরবর্তী সময়ে কর্মপরিস্থিতি ও স্থায়ী নাগরিকত্বের খোঁজে সিডনিতে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। শুধু আমিই নই, আরও কত হাজার হাজার শিক্ষার্থী সিডনিকে তখন বিদায় বলে রাজধানী হ্যালিফ্যাক্স বা অন্যান্য পার্শ্ববর্তী শহরে চলে গিয়েছিল, তার ইয়ত্তা নেই। আমি গিয়েছি বা একপ্রকার যেতে বাধ্য হয়েছি ২০২১ সালে। বাকিরা অনেক আগেই পাড়ি জমিয়েছে। এত সুন্দর শহর! ছেড়ে গেলেও বারবার ফিরে আসার ইচ্ছে জাগে।
অধিকাংশ কানাডিয়ান ঘরবন্দী হয়ে যান! যাঁরা শীর্ষস্থানীয়, তাঁরা বাদে বাকি সবাই। আমি তখন ওয়ালমার্টে কর্মরত ছিলাম। ওদের রীতিমতো কর্মী–সংকট দেখা দেয়। তখন সেচ্ছায় যে কেউ কাজে না এলেও তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত না করার রীতি ছিল। আমরা এশিয়ানরা মূলত কাজ করে গেছি ওই সময়। অন্য কর্মকর্তাদের কাজে অনুপস্থিতির সুযোগে আমরা কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে ভালো টাকাও উপার্জন করেছি। কিন্তু একদিকে স্বয়ং যমদূতের উপস্থিতি আরেক দিকে জীবনের অন্বেষণে অবিরাম ছুটে চলা! মহামারি কোভিড পুরো পৃথিবীকেই নড়বড়ে করেছে! অগণিত প্রাণহানির পাশাপাশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও হারিয়ে গেছে, পর্যটনশিল্পে মহাধস নেমেছে। চিকিৎসা খাতে কি মহাদুর্যোগ চলেছে, তা আর না বললেও চলে। বিশ্বব্যাপী চিকিৎসক, সেবিকা ও সেচ্ছাসেবীরা জনগণকে বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে গেছেন। এখানেও তা–ই দেখেছি। তাঁদের সেই অমূল্য ঋণ যুগযুগান্তরেও শোধ হবে না।
ওই সময় যানবাহনের সংকটও ঘনীভূত হয়েছিল। প্রতিটি বাসে আটজনের বেশি যাত্রী বহন করা যেত না। এর বিস্তারিত গল্প দূর পরবাসের পাতায় ‘গাড়ি চালনার যত কেচ্ছায়’ শুনিয়েছি। আগ্রহীরা উলটে দেখতে পারেন।
নিরুপায় হয়ে নিজস্ব গাড়ীর ব্যবস্থা করতে হয়েছিল অনেকের মতো আমাকেও। গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ—লাইসেন্স ও ইনস্যুরেন্স। কানাডায় লাইসেন্স পরীক্ষা পাস না করলে গাড়ির ইনস্যুরেন্স পাওয়া যায় না। আমার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়েছিল! কারণ যে কর্মকর্তা আমার ফোন রিসিভ করেছিলেন, হয় তিনি নতুন ছিলেন বা তখন কোনো কারিগরি ত্রুটি হয়েছিল। কারণ, আমার পূর্ণাঙ্গ লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও ইনস্যুরেন্সের কাজ ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর একই কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে বিষয়টা খোলাসা হয়। কত বিচিত্র এই পৃথিবী! কানাডার মতো দেশেও এমন কাজে ভুল হওয়াটা আসলেই অস্বাভাবিক ঘটনা! এভাবে ইনস্যুরেন্স কোনো ভুলভাল অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির হস্তগত হলে অনেকের জীবন বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে ওই সময় মহামারি পরিস্থিতি বিবেচনায় ইনস্যুরেন্স কোম্পানি কোনো বিশেষ ছাড় দিয়েছিল কি না, সেটা আমার অজানা। হয়তো ওই সুযোগে আমি পেয়ে গেছি।
বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সিদ্ধান্ত আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত হয়তো করেছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। কখন কোভিডের পাল্লায় পড়ে যাই?
তখন কানাডা সরকার বিশেষ প্রণোদনা হিসেবে অনিচ্ছুক থাকার কারণে চাকরি হারানো প্রত্যেক ব্যক্তিকে মাসিক দুই হাজার ডলার খরচ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য যাঁরা অকারণে বা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে এই সুবিধা বাগাতে চাইবেন, তাঁদের কাছ থেকে এর খরচ পরিশোধ পরবর্তী সময়ে করা হবে এই মর্মে। সেটার বাস্তব প্রতিফলন অনেকের বাসায় কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি থেকে (সরকারি কর সংস্থা) চিঠি আসার মাধ্যমে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেছি।
কেপ ব্রেটনের সিডনির আশপাশে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম ক্যাবট ট্রায়াল। আমার প্রদেশ নোভা স্কোশিয়া অনুসন্ধানকারী ব্যক্তি জন ক্যাবট, যিনি একজন ইতালিয় নাবিক। ১৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই প্রদেশের সন্ধান পান। তাঁর নামানুসারেই ওই স্থানের নাম রাখা হয়েছে ক্যাবট ট্রায়াল। সমগ্র কানাডার ১০টি দর্শনীয় স্থানের মধ্যে একটি এটি।
দূর প্রদেশের পর্যটকেরা অবশ্যই এই জায়গা ঘুরে যেতে ভোলেন না। সর্পিল আকারের অনেকগুলো পাহাড়ের সারির সঙ্গে আটলান্টিক মহাসাগরের মিলন। দেখে মনে হয় কোনো শিল্পী নিপুণ কৌশলে কারুকার্য করে এই জায়গা সৃষ্টি করেছেন।
আর মূল সিডনি শহরের প্রতীক হিসেবে যে জায়গার নাম উঠে আসে, তা হচ্ছে বিগ ফিডল বা বৃহৎ বেহালা। বিশেষত্ব এই যে এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেহালা। সিডনি শহরে গেলে এই জায়গা যেন কোনোভাবে বাদ না পড়ে। আশপাশের আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত জায়গাগুলোর মধ্যে রয়েছে ফোট্রেস অব লুইসবার্গ এবং অপার স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দেওয়া অসংখ্য সমুদ্রসৈকতের উপস্থিতি।
সিডনি আমাকে কানাডায় ঠাঁই দেওয়া, তার অপার সৌন্দর্যে আমাকে মুগ্ধ করা ছাড়াও যে কাজটি করেছে, তা হচ্ছে সত্যিকারের কিছু বন্ধু উপহার দিয়েছে। তিনজনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করব—ধ্রুব, গ্র্যান্ড, হারপ্রিত। তিনজন ভারতের তিন প্রদেশের বাসিন্দা। গুজরাট, কেরালা ও পাঞ্জাব। আমার জীবনের বিশেষ কিছু সময়ে এদের উপস্থিতি অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছিল। পরিস্থিতি অনেক ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল। এরা না থাকলে হয়তো আমাকে ফেরতও যেতে হতো।
আর দীর্ঘদিন আমি স্বদেশি ভাইদের প্রতিবেশী হয়ে সিডনির রকক্লিফ এলাকায় ছিলাম। ওখান থেকেই চলে আসি হ্যালিফ্যাক্সে। ওটাকে বাঙালিপাড়াই বলা যায়। আমরা এক বাসায় পাঁচজন করে থাকতাম। পাশের অ্যাপার্টমেন্টে বাকি ছেলেপেলেরা থাকত। সবাই একসঙ্গে পিকনিক করার চল ছিল। ওখানে সুমন, রাহুল, জুয়েল, আকিব, নূর (আগের পর্বের সরকার ভাইয়ার শ্যালক)—এদের কথা না বললেই নয়।
আমাদের মজা করার, আড্ডা দেওয়ার জায়গা ছিল জুয়েলের ঘর। চাকরি শেষে সন্ধ্যা থেকে আমরা সবাই একসঙ্গে মুভি দেখতে বসে পড়তাম। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুভি বাছাইয়ের দায়িত্ব থাকত আকিবের কাছে।
এমন বন্ধুত্বের ঘটনা সম্ভবত খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। সবকিছুর শুরু আছে, শেষও আছে। তবে এর রেশ সারা জীবন বয়ে নিয়ে যাই আমরা। আমার সিডনি শহর থেকে প্রস্থান এসবের অন্তরায় এনে দেয়। ক্রমে...
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]