সিডনি থেকে হ্যালিফ্যাক্স - প্রথম পর্ব
সিডনি এবং আমি
সিডনি শহর কানাডার আটলান্টিক প্রদেশগুলোর মধ্যে অন্যতম নোভা স্কসিয়ার কেপ ব্রেটন দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই এটা অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহর নয়।
সিডনিতে যখন আমি পৌঁছাই, তখন রাত সাড়ে তিনটা। হ্যালিফ্যাক্স থেকে এয়ার কানাডার সিডনিগামী ফ্লাইট বাতিল হয়ে গিয়েছিল। কানাডার সরকারি বিমান সংস্থা এয়ার কানাডা বিমান কর্তৃপক্ষ ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিল। ওতেই এসে পৌঁছালাম গভীর রাতে। আমি যখন টরন্টোতে ইমিগ্রেশন বিভাগ অতিক্রম করি তখন ২৯ তারিখ আর যখন সিডনি এসে পৌঁছাই তখন ৩১ ডিসেম্বর গভীর রাত। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে চারদিকে নিশ্চুপ নীরবতায় শুভ্রতার গালিচা মোড়ানো তুষারপাতের সেই দৃশ্য আজীবন মনে থাকবে। আর মনে থাকবে ট্যাক্সিচালকের সততার কথা। সেই ভদ্রলোক আমার সব ভারী জিনিস নামিয়ে দেওয়ার পর বললেন, ‘তুমি দরজায় বেল দাও। আমি যতক্ষণ কেউ দরজা না খুলছে অপেক্ষা করছি।’ তিনি আমার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। চেনাজানা নেই, এমন এক ব্যক্তির প্রতি তাঁর আন্তরিকতা ভুলতে চাইলেও ভোলার মতো নয়। যত দিন বেঁচে আছি, তাঁর কথা মনে রাখব।
সিডনিতে আমার আগমন অনেকটা রাজমহল ছেড়ে সরাসরি বনের গহিনে কোনো রেস্ট হাউসে গিয়ে থাকার মতো অবস্থা। মা–বাবার কনিষ্ঠ সন্তান হওয়ায় আমি বাইরে ভ্রমণে যেতে পেরেছি একবারই—বান্দরবানে। তা–ও বন্ধু–বান্ধবীসমেত। দেশের বাইরে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। ছোটবেলায় দাদামণি নাম দিয়েছিল, ফার্মের মুরগি!!
ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল জানুয়ারির ৪ তারিখে। আমার সামনে প্রথমেই অভিবাসন–সংক্রান্ত কিছু জটিলতা হাজির হয়। সেসবের গল্প কানাডার চাকরি বৃত্তান্তে বিস্তারিত লিখেছি। আগ্রহী পাঠকেরা দূর পরবাসের পাতায় পুরো বৃত্তান্ত পেয়ে যাবেন।
আমি অভিবাসনের জটিলতা প্রাথমিকভাবে সামাল দিয়ে ৪ তারিখের ক্লাসে হাজির হই। ক্লাস নিজের গতিতে আগাতে থাকে। আমার পঠিত বিষয় ছিল পাবলিক হেলথ। এটা অ্যাডভান্সড ডিপ্লোমা। দুই বছরের কোর্স।
চাকরির জন্য সবার তখন মরণপণ অবস্থা।
আস্তে আস্তে কিছু বিষয় চোখের সামনে ক্রমেই পরিষ্কার হতে লাগল। এখানকার বাসস্থানের সংকট, চাকরির অপ্রতুলতা, যানবাহনের দীর্ঘসূত্রতা। কেন এ অবস্থা? আমরা যদি একটু সিডনির ইতিহাসের দিকে তাকাই—
নোভা স্কসিয়ার সিডনি পিছিয়ে থাকা প্রদেশগুলোর মধ্যে একটি। এই ছোট্ট শহরের নানা অসুবিধার মধ্যে অন্যতম সমস্যা এর বেকারত্ব। আগে এই শহরই ছিল এ প্রদেশের মধ্যে অন্যতম সমৃদ্ধিশালী শহর। বিংশ শতাব্দীতে যখন সিডনিতে উত্তর আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ স্টিল কারখানাগুলোর একটা (ডেসকো) ছিল, তখন সেখানে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি লক্ষ করা গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে ডেসকোতে শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত কমতে থাকে। কানাডিয়ান সরকার নোভা স্কসিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ কর্মসংস্থান প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রক্ষার নিমিত্তে এটিকে সরকারীকরণ করে। তখন এর নাম হয় ‘সিডকো’ (সিডনি স্টিল করপোরেশন)। কিন্তু ১৯৭০ সালের পর থেকে প্ল্যান্টের উৎপাদনক্ষমতা ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে এবং কর্মসংস্থানের নিমিত্তে শ্রমিকেরা অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়ে চলে যান। অবশেষে ২০০১ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯০০ সালে যে ইস্পাত কারখানা শুধু কানাডাতেই নয়, পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম বৃহৎ কারখানা ছিল, এক শতাব্দীর ব্যবধানে তা কালের গর্ভে হারিয়ে গেল। এর জন্য আন্দোলনও হয়েছিল।
তখন থেকেই এখানে কর্মসংস্থান জোগাড় করা কঠিন হতে থাকে। ২০১৮ সালে আমি যখন আসি, তখনো একই দৃশ্য দেখেছি। এ শহর সম্পর্কে আমার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। দেশে ডেন্টিস্ট্রি নিয়ে পড়লেও কানাডায় সরাসরি এসে প্র্যাকটিস করার কোনো সু্যোগ নেই। এর জন্য বেশ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ লাইসেন্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়, যা আমার মতো আরও প্রায় ৪০ সহপাঠীরও হয়তো অসম্ভব মনে হয়েছিল। কারণ, আমরা সবাই ডেন্টিস্ট, কিন্তু ভর্তি হয়েছি (বাধ্য) পাবলিক হেলথে। আমি এই ব্যাচে একমাত্র বাংলাদেশের প্রতিনিধি। অন্যরা ভারত, নাইজেরিয়া, চীন ও স্বদেশি কানাডার ছিল। অধিকাংশ কানাডিয়ান আমাদের চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ।
ওই সময়কালে আমি চাক্ষুষ সিডনির জনসংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে দেখেছি। প্রচুর প্রবাসী ছাত্রছাত্রীর পদচারণে মুখর আমার কেপ ব্রেটন ইউনিভার্সিটি। ২০১৮-১৯ সালে, বিশেষ করে ২০১৯ সালেই বিপুলসংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থী আসেন সিডনি শহরে। তখন ইউনিভার্সিটিতে ইন্টারন্যাশনাল অফিসে কাজ করি। ওটা ছাত্রাবস্থায় থাকাকালীন সময়ের চাকরি। আমাদের কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল নবাগত ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ করে অভিবাসন–সংক্রান্ত কাজে সাহায্য করা, প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করা এবং ইমিগ্রেশনের ব্যাপারে দায়িত্বরত ইউনিভার্সিটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দেওয়া। এত শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সিডনির মতো ছোট্ট শহরে ছিল না বললে চলে। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের ইন্টারন্যাশনাল অফিসের উপদেষ্টারা যথেষ্ট অসন্তুষ্ট ছিলেন। ওই সময় চাকরির ব্যবস্থা করতে না পেরে অনেকেরই দূরবর্তী ও প্রত্যন্ত জায়গায় গিয়ে কাজ করতে হয়েছে।
জনসংখ্যা বেড়েছে, এটা বেশি টের পেতাম যখন বাসের লাইনে দাঁড়াতাম। আমি যখন শুরু করি তখন যেমন সবাই সুশৃঙ্খলভাবে লাইন করে বাসে উঠত। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সবকিছুতে এলোপাতাড়ি করতে লাগল সবাই। তখন বাসচালকদেরও হস্তক্ষেপ করতে হতো। এমনও হয়েছে যে একবার লাইনে দাঁড়িয়ে তিনটি বাস চলে গেছে, তারপর ওঠার সুযোগ পেয়েছি। বাস সার্ভিসও বাড়ানো হয়েছিল মিউনিসিপ্যালিটি থেকে। কেপ ব্রেটন ট্রানজিটের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি হলো ইউনিভার্সিটির। একবার আমাদের টার্ম ফাইনালের দিন বাসের অপেক্ষায় থেকে আমরা ইউনিভার্সিটিতেই পৌঁছাতে পারিনি। সবাই দাঁড়িয়ে আছি আর বাস দাঁড়ায় না। কারণ, ভেতরে কোনো জায়গা নেই। পরে আমাদের ডিনকে জানানো হলে তিনি নিজে কেপ ব্রেটন ট্রানজিটে ফোন করে আমাদের জন্য আলাদাভাবে একটি বাসের ব্যবস্থা করেন। আমরা পরে বাড়তি সময় নিয়ে ডিনের নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষা শেষ করি।
আমার স্টাডি পারমিটের সমস্যা থাকা নিয়ে অনেক চড়াই-উতরাই গেছে। চাকরির জন্য হাড়ভাঙা খাটনির বৃত্তান্ত আমার বই ‘কানাডার পথ ও রথের বৃত্তান্ত’–এ লিখেছি।
সিডনির অপার সৌন্দর্য সব হতাশা, বেদনাকে নিমেষে ভুলিয়ে দিত। ছোট্ট একটা শহর, কিন্তু তার মায়া অপরিসীম। ক্রমশ...
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]