জীবন ও যুদ্ধ-শেষ পর্ব
বছর খানেক হলো নীলা আর অনীক সামাজিক রীতিনীতি মেনে একত্রে বসবাস করছে। মাস তিনেক হলো নীলাও একটা বেসরকারি শিশু ও নারী উন্নয়ন সংস্থায় যোগদান করেছে। ওর কাজ হলো নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর শিশু ও নারীদের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে রিপোর্ট তৈরি করা।
আর তাই ওরা আর আগের মতো দিনের আলোয় প্রেমালাপ তো দূরের কথা, দৈনন্দিন সাংসারিক আলাপেরও তেমন সুযোগ পায় না। সন্ধ্যায় দুজনেই ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফেরে আর খানিকটা বিশ্রামের পর ওরা একত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়ে খাবার তৈরির আয়োজনে বা সংসারের অন্যান্য কাজে। ইদানীং ওদের উপলব্ধি হলো, বাস্তবতার চাপ ওদের মধ্যকার প্রাক্-বৈবাহিক সময়ের ভালোবাসার রঙিন মুহূর্তগুলোর ওপর আস্তর ফেলতে শুরু করেছে।
আর তাই ওরা ঘটা করে সাপ্তাহিক দুই ছুটির দিনে ঘণ্টাখানেক পার্কে প্রাতর্ভ্রমণ আর দুপুরের পর এখানে–ওখানে, যেমন ক্রিসেন্ট লেক, রমনার বটমূল, বোটানিক্যাল গার্ডেন, জাদুঘরসহ বিভিন্ন জায়গায় অলস সময় কাটায়, যাতে ভালোবাসার রং ফিকে হলেও যেন হারিয়ে না যায়।
আজও নীলা আর অনীক ওদের সাপ্তাহিক রুটিন অনুযায়ী প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছে। মিনিট চল্লিশেক হাঁটার পর নীলা বলল—
‘আজ কেন জানি একটু ক্লান্ত লাগছে, চলো না কোথাও বসি।’
‘বসার জন্যে তো কোনো বেঞ্চ খালি দেখছি না।’
‘তাই তো দেখছি!’ কিছুক্ষণ পরই হঠাৎই নীলা আবারও বলে উঠল—
‘ওই দেখো ওই দূরের বেঞ্চটার এক কোণে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক বসে আছে। ওই বেঞ্চটার অন্য কোণে আমরা গিয়ে তো বসতে পারি, তাই না?’
‘তা পারি, কিন্তু উনি যদি বিরক্ত হন?’
‘সেটা উনি হতেই পারেন। কিন্তু পার্ক তো কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি না, তাই না?’
ওরা ভদ্রলোকের অনুমতি নিয়েই বেঞ্চটিতে বসে পড়ল। খানিকক্ষণ পর নীলা বলল—
‘অনীক, চলো না আজ বিকেলে আশুলিয়ায় যেখানে তুরাগ নদী বর্ষার পানিতে দুকূল ছাপিয়ে নিচু এলাকাকে প্লাবিত করে, অনেক দিন নৌবিহারেও কিন্তু যাওয়া হয়নি।’
এমন প্রস্তাবে অনীক বলল—
‘জানো নীলা, আমিও মনে মনে এমনটাই ভাবছিলাম। কিন্তু গত সপ্তাহে তোমাকে বলেছিলাম ক্রিসেন্ট লেকের ধারে কৃষ্ণচূড়ার সমারোহ দেখতে যেতে, তুমি তো যেতে চাওনি?’
এভাবেই থেমে থেমে ওরা একে ওপরের সঙ্গে কথা বলছিল।
কথায় বলে না, মেয়েদের নাকি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সদা জাগ্রত আর তাই নীলার মনে হলো, ওদের বেঞ্চের অন্য প্রান্তে বসা ভদ্রলোকটি কেন জানি বেশ আগ্রহভরে ওদের দেখছে আর কথোপকথন শুনছে। নীলার অনুভবের সত্যতার প্রমাণের লক্ষ্যেই যেন ধীর কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে ভদ্রলোকটি বলে উঠলেন—
‘নীলা আর অনীক, আপনারা আমার অনেক অনেক দিনের পরিচিত। বয়সে আপনারা আমার অনেক ছোট, তাই আপনাদের তুমি বলছি।’
ভদ্রলোকের কথা শুনেই নীলা আর অনীক দুজনেই কেমন যেন একাধারে বিস্মিত, অন্যধারে কৌতূহলী হয়ে উঠল। বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে নীলাই প্রথম মুখ খুলল—
‘তা, আপনাকে তো আমি চিনিই না। কখনো দেখেছি বলে মনেও করতে পারছি না।’ এবারে অনীকের দিকে ফিরে বলল—
‘তা অনীক, তুমি কি এই ভদ্রলোককে চেনো, নাকি উনি তোমার পূর্বপরিচিত?’
প্রত্যুত্তরে অনীক ‘না’সূচক ঘাড় নাড়াল। এবারে ভদ্রলোক মুখ খুললেন—
‘সত্যি বলতে কি, আজই তোমাদের কথোপকথন শুনেই বুঝতে পারলাম আমি তোমাদের গভীরভাবে চিনি ও জানি। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানো, তোমরা হলে আমারই লেখা ‘জীবন ও যুদ্ধ’ নামক গল্পের দুটি প্রধান চরিত্র, যা কিনা ধারাবাহিকভাবে একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।’
নীলা আর অনীক দুজনেই সমস্বরে বলে উঠল— ‘ও, তাহলে আপনিই সেই লেখক? তা আপনার লেখার কারণেই আমাদের ব্যক্তিগত জীবন আজ পত্রিকার পাতায়!’
‘কিন্তু আমি ভাবছি, এটা কী করে সম্ভব! গল্পের চরিত্র কীভাবে বাস্তবে দেখা যায়? বাস্তব আর কল্পনার একবিন্দুতে এমন মিলন আমার কাছে অবিশ্বাস্য!’ ভদ্রলোক বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন। উত্তরে নীলা বলল—
‘সেটা তো বলতে পারব না। তবে আপনি কেন ছদ্মনামে লেখেন?’
‘না না, এটা তোমাদের একেবারে ভুল ধারণা! ক খ হাসান হলো আমার প্রকৃত নাম। তোমরা একটু অবাক হতেই পারো, কিন্তু আমি অন্য অনেকের মতোই নামের সংক্ষিপ্তকরণ ইংরেজিতে না করে বাংলায় করেছি মাত্র।’
এবারে অনীক বলল—
‘তা আপনি তো দেশের বাইরে থাকেন। তাহলে এখানে কী করছেন?’
‘আমি কয়েক দিন হলো দেশে এসেছি, একটা সেমিনারে যোগ দিতে। আর আমার বয়োবৃদ্ধ বাবার সঙ্গে সপ্তাহ দুয়েক সময় কাটাতে।’
বেশ কিছুক্ষণ হলো কেউ কোনো কথা বলছে না, যেন বলার আর কিছুই নেই। খানিকটা উসখুস করে নীলা বলল—
‘আচ্ছা, একটা বিষয়ে আমি বেশ সন্দিহান। আপনার লেখায় দেখেছি, আমার বা অনীকের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে আলোকপাত করেন। অথচ দেশের সমস্যা দেশে বসে সমাধান না করে কেন যে প্রবাসে বসে এসব বিষয়ে নাক গলান, তা আমার বোধগম্য নয়।’
‘দেখো, এই মাটিতে আমার জন্ম, এখানেই আমার শিকড়, এখানকার জলবায়ু আর মাটি গায়ে মেখে আমার বেড়ে ওঠা—এ কথা আমার কৃতজ্ঞচিত্তে সর্বদা স্মরণ ও কাজকর্মে প্রতিফলিত হওয়া উচিত কি না?’
এতক্ষণ অনীক চুপচাপ নীলা আর লেখকের মধ্যকার বাক্যালাপ গভীর মনোযোগসহ শুনছিল। ও এবারে বলল—
‘তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আপনি কেন প্রবাসী হলেন, সেটা কি আমাদের একটু বুঝিয়ে বলবেন?’
‘দেখো, স্থানান্তর বা অভিবাসন মানুষ মূলত তিনটি কারণে করে থাকে। প্রথমত, যদি কারও জীবন বিপন্ন হয়, যেমন অধিকাংশ পবিত্র ধর্মগ্রন্থে দেখা যায় মহাপুরুষেরা জীবন বাঁচাতে অন্যত্র গমন করেছেন। দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থানের সংকট, যেমন তোমাদের জেলা শহরে কর্মসংস্থান বা চাকরির সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় অনীক ঢাকা এসেছে আর নীলা তুমি এসেছ বৈবাহিক কারণে। তৃতীয়ত, কৌতূহলের কারণে, যেমন কিছু মানুষের মতে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন। আর আমি প্রবাসী হয়েছি কর্মসংস্থান এবং কৌতূহলের কারণে।’
‘কী যে বলেন না—প্রায়ই শুনি আমাদের দক্ষ জনবলের অভাব।’
‘কিন্তু তোমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে চাহিদা আর সরবরাহ সব সময় এক রকম থাকে না।’
অনীক হঠাৎই লক্ষ করল, নীলাকে কেমন জানি আনমনা দেখাচ্ছে। আর ও তাই কনুই দিয়ে নীলাকে একটা হালকা ধাক্কা দিতেই নীলা যেন আবারও বাস্তবে ফিরে এল। ও কিছুটা চাপা স্বরে লেখককে বলল—
‘আচ্ছা, আপনি তো আমাদের না দেখে না চিনে আমাদের যাপিত জীবন নিয়ে লিখেছেন। এখন বলুন তো, এ ঢাকা শহরে আমাদের নেই কোনো নিকট আত্মীয়, নেই কোনো নির্ভরযোগ্য সাহায্যকারী, আর অপ্রতুল চাইল্ড কেয়ার সেন্টার—তাই আমি বুঝে উঠতে পারি না কীভাবে আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে পৃথিবীর বুকে এনে লালনপালন করব। কেননা, এটা করতে না পারলে মানুষের অস্তিত্ব আর সভ্যতার ক্রমবিকাশ রহিত হবে।’
নীলার এ জটিল প্রশ্নের উত্তরে লেখক ভদ্রলোক দৃঢ়তার সঙ্গে ওদের উভয়ের উদ্দেশে বললেন—
‘আমি কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই এ প্রশ্নের সঙ্গে একমত। কিন্তু এর উত্তর আমার জানা নেই। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, নীলা ও অনীক, তোমরা দুজনেই যথেষ্ট বুদ্ধিমান আর তোমরাই এ সমস্যার সমাধান বের করতে সক্ষম হবে।’