জীবন ও যুদ্ধ-প্রথম পর্ব
প্রকৌশল বিদ্যায় সদ্য স্নাতক অনিকের মনটা আজ সত্যিই ভালো নেই। ওর ভাবতে খুবই কষ্ট হচ্ছে যে শুধু জীবিকার উদ্দেশ্যে ওকে জন্ম শহর, পিতা-মাতা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন আর প্রাণাধিক প্রিয় প্রেমিকা নীলাকে ছেড়ে ঢাকা যেতে হচ্ছে।
কর্মসংস্থান বা চাকরির জন্য তেমন সুযোগ-সুবিধা যে তার জেলা শহরে বা বিভাগে খুবই কম, এটা সে আগে থেকেই জানত। এ তো কয়েক মাস আগের কথা। অনিক তখন চতুর্থ বর্ষের অষ্টম সেমিস্টারের ছাত্র। ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র, যিনি বর্তমানে নর্থ আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী এসেছিলেন ওদের ওখানে এক সেমিনারে। সেখানে এক প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক আলী বললেন—
তোমরা হয়তো জেনে খুশি হবে যে আমার ব্যাচের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট নর্থ আমেরিকায় বসবাস করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা মেধাবী ও সুন্দরী ছাত্রী তনিমা মাথার দুদিকে বেণি দুলিয়ে প্রশ্ন করল—
‘স্যার, এটা তো এক কথাই ব্রেন ড্রেন!’
অধ্যাপক আলী বেশ নরম স্বরে বললেন—
‘সেটা অবশ্যই ঠিক। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে। সেটা হলো আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম থেকে এ পর্যন্ত যত প্রকৌশলী বা ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করেছে, তার ৫ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট কি আমাদের এই বিভাগে বা অঞ্চলে বসবাস করে?’
অধ্যাপক আলীর এমন প্রশ্নে পুরো সেমিনার কক্ষে পিনপতন নীরবতা লক্ষ করা গেল। একটু গলা কেশে তনিমা আবারও বলল—
‘স্যার, ‘আপনার কথা সত্য। কিন্তু কর্মসংস্থান না থাকলে ইঞ্জিনিয়াররা কীভাবে এই অঞ্চলে থাকবে?’
ওই দিনের আলাপচারিতা অনিকের একদমই ভালো লাগেনি। মনে মনে ভেবেছে কৃষক–শ্রমিকের ঘামে ঝরা পয়সায় আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করি অথচ আঞ্চলিক অর্থনীতিতে আমরা অবদান রাখার সুযোগটাও পাই না। তবুও নিজ এলাকায় থাকার শেষ একটা উপায় হিসেবে সে আর তার আরেক সহপাঠী রহমানকে সঙ্গে নিয়ে জেলা শহরের বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন বা বিসিক সহকারী পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল দিন কয়েক আগে। ওদের পরিচয় পর্ব শেষে অনিক পরিচালক সাহেবকে প্রশ্ন করল—
‘স্যার, আমরা শুনেছি বিসিক ইঞ্জিনিয়ারদের ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তোলার জন্য সহযোগিতা করে থাকে।’
‘অবশ্যই। তার আগে আমি জানতে চাই, ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরির বাজার কি এতই খারাপ যে আপনাদের শিল্প উদ্যোক্তা হতে হবে?’
এ ধরনের প্রশ্নের জন্য অনিকরা আদৌ প্রস্তুত ছিল না। ও আর রহমান একে অপরের সঙ্গে চোখাচোখি করল। এবার রহমান বলল—
‘স্যার, আসলে চাকরির সুযোগ তো জেলা শহরে খুবই কম। আর আমরা চাই পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতে। এ জন্য আমরা চিন্তা করলাম, যদি শিল্প উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়, তাহলে শুধু যে নিজ শহরেই থাকতে পারব তা নয়, বরং আমরা কর্মসংস্থান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গঠন করে দেশ ও জাতির ধারাবাহিক উন্নয়নে শামিল হতে পারি।’
পরিচালক সাহেব মাথা নেড়ে বললেন—
‘খুবই ভালো কথা। আমি অত্যন্ত আনন্দিত আপনাদের চিন্তাভাবনায়। আসলে আমি যেটা আপনাদের জন্য করতে পারি সেটা হলো ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা।’
‘তাহলে তো খুবই ভালো হয়’ অনিকেরা সমস্বরে বলে উঠল। পরিচালক সাহেব এবার ধীরে ধীরে বললেন—
‘লোনের জন্য আপনাদের লোনের অর্থের সমপরিমাণ সম্পত্তি ব্যাংকে জামানত রাখতে হবে—আপনারা কি পারবেন?’
অনিক আর ওর বন্ধু রহমান আবারও চোখাচোখি করল এবং দুজনই না সূচক ঘাড় নাড়াল। এবার অনিক মুখ খুলল—
‘স্যার, আমরা সদ্য পাস করা যুবক, আমাদের নিজস্ব কোনো সম্পত্তি নেই, যা কিছু আছে সবই আমাদের পিতা-মাতার। মনে হয় না তারা এ কাজে তাদের সম্পত্তি দিতে রাজি হবে। রহমান, তুই কী বলিস?’
উত্তরে রহমানও ঘাড় নেড়ে বন্ধুর কথায় সম্মতি দিল। এবার পরিচালক সাহেব বললেন—
‘সম্পত্তি জমাদান ছাড়া আপনাদের লোনের ওপর প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ সুদ আর সমপরিমাণ আসল টাকা প্রোডাকশন শুরুর পর থেকে দিতে হবে। আচ্ছা, আপনারা তো ইঞ্জিনিয়ার, আপনারাই বলুন কী এমন শিল্প আছে, যা থেকে এই পরিমাণ মুনাফা করা যাবে? এ ছাড়া আপনাদের নিজেদের জন্যও চাকরির বেতনের সমপরিমাণ অর্থের প্রয়োজন।’
অনিক যখন ঢাকা যাওয়ার ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত, এমন একটা সময়ে ওর মনে উদয় হলো বিষয়টা নিয়ে নীলার সঙ্গে আলাপ করা উচিত। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পরদিন নীলার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সে হাজির হলো বেলা ১১টার দিকে।
ও আগে থেকেই জানত আজকের এই সময়টাতে নীলার ক্লাস থাকে না, আর তাই তাকে বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে গাছের ছায়ায় আড্ডায় পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। আড্ডাস্থলের কাছাকাছি হতেই অনিক চেষ্টা করছিল কীভাবে নীলার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। এরই মাঝে একপ্রকার হঠাৎই নীলা ওকে দেখতে পেল আর তখনই অনিক হাতের ইশারায় নীলাকে কাছে ডাকল। নীলা অনিককে দেখে বেশ খানিকটা অবাকই হলো, কারণ অনিক সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস চলাকালে ওর সঙ্গে দেখা করতে আসে না। নীলা আড্ডা ছেড়ে আসতেই অনিক বলল—
‘তোমার কি একটু সময় হবে?’
‘কেন বল তো?’
‘না মানে, একটা জরুরি বিষয়ে আলাপ ছিল। চল না ক্যাম্পাসের ও পাশটায় নদীর ঢালে কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় বসে কথা বলি।’
নীলা জানে মে-জুন মাসের রক্তরাঙা ফুলে ফুলে ভরা কৃষ্ণচূড়া অনিককে কতটা আবেগে আন্দোলিত করে, আর তাই সে মাথা নেড়ে সায় দেয়। বেশ কিছুক্ষণ হলো ওরা দুজন চুপচাপ বসে আছে আর অনিক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বহমান নদীর স্রোতের দিকে আর চিন্তা করছে কীভাবে শুরু করা যায়। ওদিকে নীলার মাথায় তখনো আড্ডার রেশ লেগে ছিল। ও এবার নীরবতা ভেঙে বলল—
‘তা কী তোমার জরুরি কথা? কোনো কথাই তো বলছ না।’
‘না মানে, বুঝতে পারছি না কীভাবে শুরু করব।’
‘তাই নাকি! তোমার তো কখনোই কথার ঘাটতি হয় না।’
‘আজ আসলে মনটা খুবই খারাপ। তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম, আমাদের জেলা বা বিভাগে ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মসংস্থান একেবারেই কম। এ ছাড়া আমার বন্ধু রহমানকে নিয়ে বিসিকে গিয়েছিলাম।’
অনিকের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই নীলা তড়িঘড়ি করে বলে উঠল—
‘তা ওখানে কী আলোচনা হলো? নিশ্চয়ই ভালো কিছু?’
এবার অনিক সংক্ষেপে বিসিক সহকারী পরিচালকের সঙ্গে ওর আর রহমানের কথোপকথনের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করে বলল—
‘আচ্ছা নীলা, তুমিই বল জেলা শহরে থাকার আর কি কোনো উপায় নেই?’
নীলাকে এবার খুবই চিন্তিত মনে হলো। হঠাৎ করে সে বলল—
‘শোন, সেদিন আমাদের ভিসি স্যার এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিলেন যে এই শিক্ষাবর্ষে আমাদের এখানে প্রথমবারের মতো ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি খোলা হবে। আমার মনে হয় যেহেতু তোমার রেজাল্ট খুবই ভালো আর প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট, তাই তোমার এখানে শিক্ষক হতে পারার সম্ভাবনা খুবই বেশি। আর সেটা হলে তো সোনায় সোহাগা, তা–ই না?’
‘দেখো নীলা, আমাদের দেশে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিধারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবুও আমি মনে করি যে শিক্ষকতার জন্য দরকার উচ্চতর ডিগ্রি যেমন পিএইচডি বা নিদেনপক্ষে মাস্টার্সসহ কয়েক বছরের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অভিজ্ঞতা, যাতে তারা শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণা কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয়।’
‘কী যে বলো না! তুমি দেখি বেশি বেশি বোঝো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকের তো না আছে উচ্চতর ডিগ্রি, না আছে গবেষণার বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা।’
‘দেখো নীলা, তোমার সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ মানেই শিক্ষা আর গবেষণার সহাবস্থান। যাহোক, আমার যেহেতু গবেষণার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই, তাই আমি অর্ধশিক্ষিত শিক্ষক হিসেবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করাকে নৈতিকতার অধঃপতন বলে মনে করি।
‘দেখো অনিক, তাহলে তুমি কী করতে চাও?’
‘আমি ঢাকা যেতে মনস্থির করেছি। দু–এক দিনের মধ্যে রওনা হতে যাচ্ছি।’ এ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে অনিকের মনে হলো যাক বাবা, শেষ পর্যন্ত সে নীলাকে আসল কথাটা বলতে পেরেছে। এদিকে নীলা প্রতিউত্তরে যে কী বলবে, তা ভেবে কোনো কূল–কিনারা দেখতে পেল না।