জীবন ও যুদ্ধ-চতুর্থ পর্ব

ইতিমধ্যে অনিক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ফার্মটিতে প্রায় বছরখানেক সময় অতিবাহিত করেছে। এ সময়ে সে অনেক কিছুই জেনেছে, শিখেছে, আর প্রয়োগও করার সুযোগও পেয়েছে। প্রায় প্রতি মাসে সে নিয়ম করে ৩ থেকে ৪ দিনের জন্য জেলা শহরে যায়—যেখানে নীলার সঙ্গে অন্তত আধা দিন সে নিরবচ্ছিন্ন সময় ব্যয় করে থাকে। কখনোবা নীলার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটের ছায়ায়, কখনোবা  নদী বা বিলে নৌবিহারে, কখনোবা শহরের কেন্দ্রে প্রাচীন পার্কের পানির ফোয়ারার কাছে, আর বৃষ্টি-বাদলের দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে।

গত সন্ধ্যায় অনিক তার জেলা শহর থেকে ফিরেছে আর আজই সকালে অফিসে যেতেই ওর ডাক পড়ল বিভাগীয় প্রধান ম্যাডামের কক্ষে। ও প্রবেশ করতেই ম্যাডাম ওকে বসতে বলে বেশ কোমল স্বরে বললেন,
‘তা অনিক, বাড়িতে আপনার সময় কেমন কাটল?’

এত দিন এ অফিসে কাজ করে এটা সে ভালো করেই জানে যে ম্যাডামের মিষ্টি কথার পেছনে কিছু একটা লুকিয়ে থাকে। তবু সেটার পাঠোদ্ধারে না গিয়ে অনিক বলল,
‘জি ম্যাডাম, বাড়ি থেকে ফিরে নিজেকে বেশ তরতাজা লাগছে।’

আরও পড়ুন

এবারে ম্যাডাম আর কোনো ভণিতা না করে বললেন,
‘আমরা নতুন একটা প্রজেক্ট পেয়েছি, আর আমি চাই আপনি এটার নেতৃত্ব দেবেন।’
‘তা আমি কি পারব?’

‘শুনুন, আপনি তো প্রজেক্ট সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই বলে ফেললেন পারবেন কি না?’

ম্যাডামের এ হেন মন্তব্যের পর অনিক বেশ লজ্জা পেল। আর তাই নিচুস্বরে বলল,
‘ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না। এবারে যদি প্রজেক্টটা সম্পর্কে বলতেন?’
‘আমাদের এই প্রজেক্টের কাজ হলো দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের খুলনা জেলার অন্তর্গত একটা উপজেলায় অবস্থিত একটি পোল্ডারের জন্য চিংড়ি চাষের বিস্তারিত ডেটাবেজ তৈরি করা। আর এর জন্য আপনাকে কমপক্ষে সপ্তাহখানেকের জন্য ফিল্ড ট্যুরে সেখানে যেতে হবে। আমি চাই আপনার সঙ্গী হিসেবে যে নতুন দুজন ছেলে-মেয়ে আমাদের বিভাগে যোগ দিয়েছে তারাও যাক।’
‘তা ম্যাডাম, আমি তো জানি না পোল্ডার কি জিনিস?’

‘পোল্ডার হলো আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নিচু জমির চতুর্দিকে বেড়িবাঁধ দিয়ে বেষ্টিত এলাকা, যাতে করে জোয়ারের সময় লবণাক্ত পানি অনুপ্রবেশ না করতে পারে। আর আপনারা যে পোল্ডারটিতে যাচ্ছেন সেখানে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাগদা চিংড়ির চাষ শুরু হয়।’
‘তা কবে নাগাদ আমাদের যেতে হবে।’
‘যত শিগগিরই সম্ভব।’

আরও পড়ুন

কয়েক দিন হলো অনিকেরা ফিল্ডে এসেছে। তারা স্থানীয় লোকজন, পুরোনো আর নতুন ম্যাপ পর্যালোচনা করে দেখল পোল্ডারের ভেতরে চিংড়ির চাষের পরিধি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। কিন্তু একটা বিষয় অনিককে সেই এখানে আসার দ্বিতীয় দিন থেকেই ভাবিয়ে তুলেছে—সেটা হলো চিংড়ি চাষ তো প্রচুর বৈদেশিক অর্থ আমদানি করে, কিন্তু এলাকার উন্নয়ন খুব একটা দৃশ্যমান নয় কেন?

অলংকরণ: আরাফাত করিম

এর একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাও সে পেয়েছে গত বিকেলে পোল্ডারের এক কোণে চায়ের টংদোকানে যখন ওরা সেখানে চা পানের বিরতি নিয়েছিল। সেখানে ৫-৭ জন বিভিন্ন বয়সী লোক চা পান করছিল। একজন বয়স্ক লোক অনিকদের উদ্দেশে বললেন,
‘তা বাবাজিরা, কয়দিন ধরে দেখছি আপনারা আমাদের এলাকায় ঘোরাঘুরি করছেন, তা আমাদের এখানে আপনাদের কেমন লাগছে?’

উত্তরে অনিক বেশ বিনয়ের সঙ্গে বলল,
‘আমি জীবনে এই প্রথম বাগদা চিংড়ির ঘের এলাকায় এলাম। আমার খুবই ভালো লাগছে। তা চাচা, চিংড়ির চাষ করে আপনারা তো ভালোই আছেন, তাই না?’
‘নারে বাবা, আমার দুই বিঘা জমি আছে এই পোল্ডারের ভেতরে। আমি সেখানে ধান চাষ করতে চাই। কিন্তু আমার আশপাশের সবাই চিংড়ি চাষ করে। আর তাই আমাকেও বাধ্য হয়ে চিড়িং চাষ করতে হয়।’

আরও পড়ুন

‘তা চাচা, ধান চাষ করলে ধান তো বন্যায় বা খরায় বা পোকার আক্রমণে নষ্ট হতে পারে। আর যদিও ধানের ফলন ঠিকঠাক মতো হয়, তাহলে আপনি যা পাবেন, তার চেয়ে চিংড়ি চাষে কমপক্ষে তিন গুণ বেশি টাকা পাবেন। আর তাতে তো আপনারই লাভ, তা-ই না?’

‘তা বাবাজি, টাকার হিসাবটা আপনার ঠিকই আছে। তবে একটানা বছরের পর বছর চিংড়ি চাষ জমির জন্য তো ভালো না।’
‘তা চাচা, এই বেশি টাকাটা কি করেন?’

উত্তরে অনিক উপস্থিত লোকজনদের কাছ থেকে জানল, কেউ ঘরের ছাউনি মেরামত করে, কেউ ছেলের জন্য সাইকেল কিনে দেয়, কেউ স্ত্রীর নাকের নথ বানায়, কেউ নতুন ঘর তোলে ইত্যাদি ইত্যাদি। এবারে অনিক তাদের প্রশ্ন করল,
‘তা যারা বড় চিংড়িচাষি, তারা লাভের টাকা দিয়ে কি করে?’

এবারে মাঝবয়সী একজন বললেন,
‘আমাদের চেয়ে বড় চাষি থানা শহরে, তার চেয়ে বড় চাষি জেলা শহরে, তার চেয়ে বড় চাষি বিভাগীয় শহরে, আর তার চেয়ে বড় চাষি রাজধানীতে বাড়িঘর তৈরি করে থাকে।’
অনিকের মনে হলো চিংড়িচাষিরা যদি এমন বাড়িঘর স্থানীয় এলাকার বাইরে গিয়ে তৈরি করে, তাতে তো এলাকার উন্নয়ন হবে না। ও ভাবল যদি চিংড়ি চাষের লভ্যাংশের একটা অংশ স্থানীয় পর্যায়ে শিল্প স্থাপন বা অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করা যেত, তবে হয়তো এলাকায় একটা টেকসই উন্নয়ন দেখা যেত।

আজই অনিকদের এখানে শেষ দিন। সেই সন্ধ্যা থেকে বাতি না জ্বালিয়ে অন্ধকারে উদাস মনে গেস্ট হাউসের বেডরুমের সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। এরই মধ্যে অন্তত চারবার নীলার জন্য রক্ষিত রিংটোনটি বেজেছে, কিন্তু অনিকের একটিবারের জন্যও ওর মুঠোফোনটা ধরতে ইচ্ছা করেনি। হঠাৎ কি মনে হলো—ও মুঠোফোনটা হাতে তুলে নিয়ে অনেকটা অনিচ্ছার সঙ্গে নীলাকে কল করল। একটিবার রিং হতেই ওপাশ থেকে নীলার রাগত কণ্ঠস্বর ভেসে এল,
‘আচ্ছা অনিক, তোমার সমস্যাটা কী? সন্ধ্যার পরও কি তোমার ফিল্ডে কাজ থাকে?’
‘দেখো নীলা, মনটা আমার ভীষণ খারাপ। এমনকি তোমার সঙ্গেও কথা বলতেও ইচ্ছা করছে না।’
‘কিন্তু, কেন সেটা বলবে তো?’

‘আচ্ছা, তবে শোনো। আজ দুপুরের দিকে আমাদের ট্যুর এলাকাতে একটি বিয়ে হচ্ছিল। এই এলাকাতে আমরা গত সাত দিন ধরে ঘোরাফেরা করছি, আর তাই এলাকার লোকজন আমাদের একপ্রকার জোর করে ওখানে নিয়ে গেল।’

‘এটা তো খুব ভালো কথা। বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছ, ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া করেছ, আর কী চায়?’

‘আসলে বিয়ের আসরে বসে মনে হচ্ছিল টোপর পরে আমি নিজেই বর! কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, আরে আমি বর হলে পাশে তোমারই থাকার কথা। আর সেই থেকেই আমার মনটা ভালো নেই।’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এ পর্যন্ত কথা বলার পর মুঠোফোনের দুই প্রান্তেই যেন অনন্তকালের নিস্তব্ধতার ঢেউ বয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর অনিক খানিকটা গলা কেশে মৃদুস্বরে বলল,
‘দেখ নীলা, তোমার তো অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। আমরা কি এখন এক ছাদের নিচে বসবাস করার উদ্যোগ নিতে পারি না?’
‘অবশ্যই পারি। কিন্তু আমি তো মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি।’
‘তা কি করে সম্ভব! তোমার তো রেজাল্টই বের হয়নি, তাই না?’
‘ও আচ্ছা। দেখছি, তুমি তো জানোই না যে আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনার্সের রেজাল্টের আগেই মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়ে যায়। আর আমার মাস্টার্সের ক্লাসও তো প্রায় মাস তিনেক হয়ে গেছে।’
‘তো দেখছি, তলে তলে জল বহুদূর গড়িয়েছে!’
‘শোনো অনিক, আমার মাস্টার্সটা শেষ করতে খুব বেশি হলে ৮/৯ মাস সময় লাগবে। এটুকু সময় অপেক্ষা করা কি তোমার জন্য খুবই কঠিন?’
‘আমি তোমার জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারি, সেটা কোনো সমস্যা না।’

‘তাহলে সমস্যাটা কী?’
নীলার এই একাধারে সরল আর অন্য ধারে জটিল প্রশ্নের উত্তরে অনিকের আর কিছুই বলতে ইচ্ছা করল না। শুধু মৃদুস্বরে নীলাকে শুনিয়ে আওড়ে গেল ওর প্রিয় কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর লেখা কথোপকথনের একটি কবিতা,
‘তুমিই আমার ধ্বংস হবে তা জানলে
এমন করে কি ভাসাতাম ডিঙ্গি নৌকো?
ভাসাতাম?
তুমি চলে যাবে সমুদ্রে আগে বলনি
তাহলে কি গায়ে মাখাতাম ঝড়-ঝঞ্ঝা?
মাখাতাম?
নুড়িতে-পাথরে নূপুর বাজিয়ে ছোট্ট
জলরেখা ছিলে দুই হাত দিয়ে ধরেছি।
ধরা দিয়েছ।
এখন দুকূল ভরেছে প্রবাহে প্লাবনে
উঁচু মাস্তুলে জাহাজ এসেছে ডাকতে।
ওকে সাড়া দাও।’
চলবে...