জীবন ও যুদ্ধ: দ্বিতীয় পর্ব
অনীক ঢাকায় এসেছে কয়েক মাস হলো। ওর এবারের ঢাকা আসা অন্যবারের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কেননা এবারের আগমন জীবন আর জীবিকার সন্ধানে। এরই মধ্যে বেশ কিছু চাকরির দরখাস্তও সে করেছে, যার অধিকাংশই প্রাইভেট ফার্মগুলোয়। কয়েকটা ফার্মে সে ইন্টারভিউও দিয়েছে, যদিও এখনো ব্যাটে–বলে সংযোগ হয়নি।
তবে গত সপ্তাহের ইন্টারভিউটা ওর মনে বেশ আশার সঞ্চার করেছে, সে গিয়েছিল একটা পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা–সম্পর্কিত ফার্মে। তার ইন্টারভিউ বোর্ডের নেতৃত্বে ছিলেন ফার্মটির চেয়ারম্যান ম্যাডামসহ আরও দুজন। এটা দেখে অনীক ভাবল এত দিন সে নারীর ক্ষমতায়ন দেখেছে পত্রপত্রিকায় আর টেলিভিশনের পর্দায় কিন্তু আজ চাক্ষুষ প্রমাণ দেখে মনে মনে বেশ খুশিই হলো। ইন্টারভিউর একপর্যায়ে চেয়ারম্যান ম্যাডাম বললেন—
‘অনীক, আমাদের দেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে, আর অন্যদিকে বর্ষার সময় একটু বেশি বৃষ্টি হলে অনেক এলাকার রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে যায়। এ বিষয়ে আমাদের কী করণীয় হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?’
‘দেখুন ম্যাডাম, আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা একেবারেই নেই বললেই চলে। তবু আমি মনে করি, বর্ষাকালে আমরা পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে পারি।’
এবার চেয়ারম্যান ম্যাডামের ডানে বসা বোর্ড সদস্য বললেন—
‘কিন্তু, কীভাবে?’
‘আমরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোকে ভরাট না করে সংরক্ষণ করতে পারি আর হারিয়ে যাওয়াগুলোকে বিশেষ করে যেগুলো খাসজমিতে, তাদের উদ্ধার করতে পারি। এ ছাড়া প্রবল ঝড়বৃষ্টির পানি ধরার জন্য কৃত্রিম জলাধার (স্টর্ম পন্ড) আর বহুতল বিল্ডিংগুলোর নিচতলার মাটির নিচে পানি ধরে রাখার বড় ট্যাংকও নির্মাণ করতে পারি।’
‘বুঝলাম, কিন্তু এতে কী হবে?’
‘পানি যদি ঠিকমতো ধরতে পারি, তবে প্রবল বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়া থেকে আমরা যেমন রক্ষা পেতে পারি, তেমনি এই পানি সরাসরি পান করা ছাড়া অন্য সব কাজে ব্যবহারও করতে পারি। আর শোধন করে পানের যোগ্যও করে তুলতে পারি।’
এবার বোর্ডের তৃতীয় সদস্য বললেন—
‘এ ছাড়া আর কী করতে পারি?’
‘ঢাকা শহরের বড় একটা অংশের ভূপৃষ্ঠ কংক্রিট দ্বারা আবৃত, ফলে পানি মাটির ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। আমার মনে হয়, বাড়িঘরের আশপাশের জায়গাগুলোয় অপ্রয়োজনীয় কংক্রিটের ব্যবহার বন্ধ করে ফুলের বাগান, ঘাস, গাছপালা লাগাতে পারি। এ ছাড়া অনেক ফুটপাত আর রাস্তাতে পানি প্রবেশযোগ্য উপাদান, যেমন ছিদ্রবিশিষ্ট ইটের সলিং বা পানি প্রবেশযোগ্য কংক্রিট ব্যবহার করতে পারি।’
ইন্টারভিউর এ পর্যায়ে চেয়ারপারসন ম্যাডাম বললেন—
‘আমার মনে হয়, আমরা সবাই একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। চলুন, আমরা একটা চা–পানের বিরতি নিয়ে নিই। আর অনীক, আপনি আমাদের রিসেপশন ফ্লোরের গেস্টরুমে যান, ওখানে চা-নাশতা পাবেন সঙ্গে আরও দেখতে পাবেন লেকের মনোরম দৃশ্য।’
গেস্টরুমে যেতেই অনীক দেখতে পেল ওর জন্য জলখাবার প্রস্তুত। ও সেটা গ্রহণ করেই দাঁড়িয়ে পড়ল একবারে বিশাল গ্লাস জানালার সামনে, আর তখনই ওর দৃষ্টিসীমার মধ্যে দেখতে পেল বিশাল এক লেক। লেকের টলমলে পানি আর এখানে ওখানে কচুরিপানার সমারোহ দেখতেই অনীকের মানসপটে মুহূর্তে উদিত হলো এক অনুপম দৃশ্যের। কত যে বিকেল ও আর নীলা ডিঙি নৌকায় তারুণ্যের উদ্দীপনায় ভরা প্রেমময় সময় কাটিয়েছে নীলার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে কুলকুল রবে বয়ে যাওয়া শান্ত নদীতে। অনীকের কাছে আজও সবচেয়ে আনন্দদায়ক আর শিহরণের বিষয় হলো নীলার সঙ্গে ওর প্রথম নৌবিহারের স্মৃতি। নীলা তো সেদিন ভয়ে আধামরা—ওর ধারণা ছিল নৌকায় উঠলেই ও টাল সামলাতে পারবে না, আর পড়ে যাবে নদীতে। সেদিন বহু কষ্টে ও নীলাকে আশ্বস্ত করতে পেরেছিল যে ওর ওপর নীলা আস্থা রাখতে পারে। ও বলেছিল, নিজে নদীতে পড়বে কিন্তু নীলাকে কখনোই পানিতে পড়তে দেবে না। আজ এ কথা মনে হতেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা দেখা দিয়েও মুহূর্তে মিলিয়ে গেল, আর ওর বুক চিরে বেরিয়ে গেল দীর্ঘশ্বাস, কেননা চাইলেই তো আর নীলার সঙ্গে সশরীর দেখা করতে পারছে না! তবু একটা বিষয়ে অনীক সব সময়েই নির্ভার। সেটা হলো, নীলা আর ওর অভিভাবকদের ওর বিয়ের ব্যাপারে অভিমত। এই তো গত শরতের কোনো এক হালকা শুভ্র মেঘাচ্ছন্ন বিকেলে নীলা আর ও নদীর তীরে বসে কাশবনের সৌন্দর্যে অভিভূত হলেও অনীক একটু উসখুস করে জানতে চেয়েছিল—
‘আচ্ছা নীলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীরা সাধারণত বিয়ের ব্যাপারে পারিবারিক চাপে থাকে, তা তুমিও কি তেমন অবস্থায় আছ?’
মৃদু হেসে নীলা ঘাড় নেড়ে বলেছিল—
‘দেখো, আমার অভিভাবকেরা বিশেষ করে আমার পিতা সব সময়ই বলে গ্র্যাজুয়েশন শেষ না করে কখনোই তাদের মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসার অনুমতি দেবে না।’
‘কিন্তু, ধরো তুমি যদি নিজেই এ কাজ করে বসো?’
‘সেটা হতেই পারে। কিন্তু আমিও আমার পরিবারের সবার মতো বিশ্বাস করি যে অন্তত অনার্স ডিগ্রিটা শেষ না করে বিয়ে করা উচিত না।’
‘সত্যিই, আমি তোমাদের সবার চিন্তাধারায় অভিভূত। তাহলে তোমার তো দেখছি মেয়েদের বিয়ের বয়সটা ২২–২৩ বছরে উন্নীত করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’
‘অবশ্যই, সেটাই কি হওয়া উচিত নয়?’
ঠিক এমনই সময়ে সুন্দরী রিসেপশনিস্ট তরুণী অনীককে জানাল যে ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যরা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পুনরায় বসতে চান। আর তাই অনীককে তখনই ইন্টারভিউ রুমে ফিরে যেতে অনুরোধ করল। ইন্টারভিউয়ের এই পর্বে চেয়ারম্যান ম্যাডাম বললেন—
‘দেখুন, এবার টেকনিক্যাল বিষয়ের বাইরে কিন্তু প্রাসঙ্গিক একটা প্রশ্ন করা যাক। সেটা হলো আমাদের সমাজে ইঞ্জিনিয়ারদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের ধারণা হলো এরা দুর্নীতিপরায়ণ—এ ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন?’
এ বিষয়টা নিয়ে অনীক ছাত্র থাকাকালে অনেক ভেবেছে। তাই এর উত্তরটা অনেকটাই প্রস্তুত ছিল। ও বলল—
‘দুর্নীতি আমাদের সমাজে একটা দুরারোগ্য ছোঁয়াচে ব্যাধির মতো। এর বিস্তার আমাদের সমাজে প্রায় সব ধরনের পেশাজীবীর মাঝে দেখা যায়। সত্যি কথা বলতে কি, যখনই সাধারণ জনগণ কোনো সেবার জন্য কোনো সরকারি দপ্তরে যায়, তখনই দুর্নীতি মাথাচাড়া দেয়। এ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান যখন তাদের কোনো কাজের জন্য কোনো ঠিকাদার বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা গ্রহণ করে থাকে। আমার জানামতে ইঞ্জিনিয়াররা মূলত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে দুর্নীতি করে থাকে।’
এবার বোর্ডের আরেকজন সদস্য প্রশ্ন করলেন—
‘তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু এর কি কোনো প্রতিকার নেই?’
অনীক অনেকটা ধীরস্থির কণ্ঠে বলল—
‘আসলে আমাদের টেন্ডারগুলোয় সচরাচর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো লভ্যাংশ ধরা থাকে না। তাহলে প্রশ্ন হলো, একটা প্রতিষ্ঠান যদি তার কোনো দৃশ্যমান লাভ না থাকে, তবে কেনই–বা তারা কাজ করবে। অথচ দেখুন, তারা কিন্তু লাভ নেই জেনেই কাজ নেয় আর তাদের কাজের গুণগত মানের সঙ্গে আপস করতে হয়। আর এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ঠিকাদারেরা অনেক সময়ই বাধ্য হয়ে দুর্নীতি করে আর ইঞ্জিনিয়াররা তাদের এ কাজের সহযোগী হয়ে ওঠে।’
এবার বোর্ডের তৃতীয় সদস্য বললেন—
‘তাহলে আপনি কি মনে করেন যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে লভ্যাংশ প্রদান করলে এ সমস্যার সমাধান হবে।’
উত্তরে অনীক বলল—
‘আমার মনে হয়, এটা হয়তো এ সমস্যার অনেক সমাধানের একটিমাত্র।’
ইন্টারভিউর এ পর্যায়ে পুরো কক্ষে নীরবতা লক্ষ করা গেল। একটু গলা কেশে চেয়ারম্যান ম্যাডাম বললেন—
‘অনীক, আমাদের আর কোনো প্রশ্ন নেই। তবে ইদানীং আমরা যাঁরা ইন্টারভিউতে আমাদের এখানে আসে তাঁদের আমাদেরকে প্রশ্ন করার সুযোগ দিয়ে থাকি, তাই আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে?’
ইতিপূর্বে যে কয়টা ইন্টারভিউতে অনীক গেছে বা অন্যদের কাছ থেকে শুনেছে, কেউ কখনোই এ ধরনের সুযোগের কথা বলেনি। তাই সে একটু অপ্রস্তুত বোধ করলেও সামান্য গলা কেশে বলল—
‘আমি সত্যিই আনন্দিত আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে। তবে যদি কিছু মনে না করেন, আপনাদের রিসেপশনের তরুণীটি চোস্ত ইংরেজিতে আমার সঙ্গে বাদানুবাদ করেছিল। কিন্তু উনি কি আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে পারতেন না?’
চেয়ারম্যান ম্যাডাম একটু লজ্জার সঙ্গে বললেন—
‘অনীক, বাংলা ভাষার প্রতি আপনার ভালোবাসা আমার ভালো লেগেছে। সত্যি বলতে কি রিসেপশনিস্টকে বলা আছে বাংলাদেশি কারোর সঙ্গে যেন ইংরেজিতে কথা না বলে। কিন্তু সমস্যা হলো আপনি যেমন আমাদের বললেন অন্য কেউ তেমনটা বলে না। ফলে এ বিষয়টা আমার জানা ছিল না। তারপরও প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে আমি খুবই বিব্রত।’
আজ দুপুরের কাছাকাছি একটা সময়ে অনীক গত সপ্তাহে সে যে ফার্মে ইন্টারভিউতে গিয়েছিল, তাদের কাছ থেকে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো—মা স্কুলে, বাবা অফিসে, আর নীলা ক্লাসে থাকার কারণে প্রিয়জন কাউকেই সে মোবাইল করতে পারেনি। বিকেলের দিকে বাড়ির সবার সঙ্গেই ওর কথা হয়েছে কিন্তু নীলার মোবাইলে কোনোভাবেই কল ঢুকছে না। কী আর করা। মাসখানেক আগে ওর এক সহপাঠীর সঙ্গে আলাপে শুনেছিল, সংসদ ভবন আর গণভবনের মাঝে লেক রোডের দুপাশে প্রায় কিলোমিটারব্যাপী সারিবদ্ধ কৃষ্ণচূড়ার সমারোহ আর একপাশে ক্রিসেন্ট লেক। নীলার সঙ্গে কথা বলতে না পারলেও অনীক আর ওর উভয়েরই পছন্দের নদী আর কৃষ্ণচূড়াতলের বিকল্প হিসেবে ক্রিসেন্ট লেক এলাকায় বেড়াতে গেল। অনীক দেখতে পেল লালে লাল হয়ে যেমন ফুটে আছে হাজারো কৃষ্ণচূড়া ফুল আর তেমনি চারদিকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে অসংখ্য যুগলবন্দী কপোত-কপোতীর দল। আর ঠিক এমনই সময়ে অনীকের মোবাইলে নীলার জন্য রক্ষিত রিংটোনটি সুমধুর সুরে বেজে উঠল। চলবে...