জীবন ও যুদ্ধ: তৃতীয় পর্ব

এই তো সপ্তাহ দুয়েক হলো অনিক তার নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়েছে। ছাত্রজীবনে প্রায়ই তাদের শিক্ষকেরা বলতেন, বাস্তব আর পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে যোজন যোজন ব্যবধান রয়েছে। এ চিরন্তন সত্য বুঝতে ওর এই দুই সপ্তাহকে যথেষ্ট বলেই মনে হয়েছে। এই যেমন দিন কয়েক আগে লাঞ্চের কিছুক্ষণ পরপরই অনিক তার বিভাগীয় প্রধান ম্যাডামের কক্ষের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, আর ভেজানো দরজার ওপাশ থেকে শুনতে পেল বিভাগীয় প্রধান ম্যাডাম আর একজন সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার নিজেদের মধ্যে ওর সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। অনিক খুব ভালো করেই জানে এবং বিশ্বাস করে, আড়ি পেতে অন্যদের কথা শোনা একেবারেই অনৈতিক, তবু সে নিজের সম্পর্কে অন্যদের আলোচনা শোনার লোভ সামলাতে ব্যর্থ হলো। ওর সিনিয়র সহকর্মী বিভাগীয় প্রধান ম্যাডামকে বললেন–
‘অনিক তো সদ্য পাস করা ইঞ্জিনিয়ার। আর আমরা তো সারা দেশে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজ করি। আমাদের এ ধরনের কাজে ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক আর কৃষি সম্পর্কে জ্ঞান, যেমন বন্যা অববাহিকায় ভূমির ব্যবহার, ফসল উৎপাদনের পঞ্জিকা, আর্থসামাজিক অবস্থা বিষয়ে জানা খুবই প্রয়োজন, যা অনিকের না থাকাই স্বাভাবিক।’

উত্তরে ম্যাডাম বললেন–
‘আমি আপনার সঙ্গে একমত। কিন্তু, এটাও তো ঠিক, ইঞ্জিনিয়ারিং ও বাংলাদেশের ভৌগোলিক আর কৃষি সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন কাউকে তো সহজে পাওয়া যায় না, তাই না?’
এ পর্যন্ত শুনেই অনিকের আর ইচ্ছা করল না ওখানে দাঁড়াতে। তার মনে হলো নিজের শরীরে ওজন হঠাৎই ভীষণ বেড়ে গেছে আর তাই ক্লান্ত পদে সে তার ডেস্কে ফিরে এল।
কতক্ষণ যে সে ঝিম ধরে মাথা নিচু করে তার ডেস্কে বসে ছিল, তা বুঝতে পারল না।

মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো অন্যের সমালোচনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, তবু কেন জানি অনিক ওর বিভাগীয় প্রধান ম্যাডাম আর সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যকার আলাপচারিতার সত্যতার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারল না। যে মুহূর্তে ও একমত হলো আর তখনই মনে হলো বসে না থেকে ওর ফার্মের লাইব্রেরিতে গিয়ে বাংলাদেশের ভৌগোলিক আর কৃষি বিজ্ঞানসম্পর্কিত বই খোঁজাখুঁজি করা। যেমন ভাবা তেমন কাজ। প্রায় ঘণ্টাখানিক সময় লাইব্রেরিতে ব্যয় করার পর অনিক প্রায় ৬০০ পাতার ‘জিওগ্রাফি অব বাংলাদেশ’ নামে হারুন অর রশিদের লেখা একটি বই খুঁজে পেল। বইটি উল্টেপাল্টে ওর কাছে মনে হলো এটা উপকারী হতে পারে। ওই দিনই অফিসের পর সে বইয়ের দোকান থেকে বাংলাদেশের গোটাকয় ‘অ্যাটলাস’ বা মানচিত্রের বাঁধানো বইও কিনে ফেলল। আর ওর শুরু হলো প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশের ভৌগোলিক আর কৃষিবিজ্ঞান সম্পর্কে জানার নতুন অধ্যায়।

আরও পড়ুন

আগামীকাল সকাল ছয়টায় অনিককে তার এক বছর চার কি পাঁচেক সিনিয়র নারী সহকর্মীর সঙ্গে ফিল্ড ট্যুরে যেতে হবে টাঙ্গাইল সদর আর তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় দিন তিনেকের জন্য। সন্ধ্যা থেকে সে তাই প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত, এরই মধ্যে নীলার ফোন।

অনিক ওর কলটা ধরতেই নীলা বলল–
‘কি ব্যাপার অনিক, গত কয়েক দিন তোমার কোনো কল পেলাম না যে?’
‘তুমি তো জানোই নতুন চাকরি, তাই কাজ আর পড়াশোনা নিয়ে খুবই ব্যস্ত।’
‘কি যে বলো, চাকরিতে আবার কিসের পড়াশোনা, আরে সেটা তো শুধু আমার মতো ছাত্রছাত্রীদের জন্য?’
‘আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে তো যেকোনো বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান দিয়ে থাকে। আর তাই কর্মজীবনে ভালো করতে হলে অনেক পড়াশোনা করতে হয়।’
‘তা না হয় বুঝলাম। তা আর কী খবর বলো?’
অনিক সংক্ষেপে টাঙ্গাইল ফিল্ড ট্যুরের কথা বলতেই নীলা বলল-
‘আমার তো মনে হচ্ছে নারী সহকর্মীর সঙ্গে তোমার বেশ ভালোই সময় কাটবে!’
‘দেখো নীলা, কাজের ব্যাপারে একদম বাজে কথা বলবে না। আর উনি তো শুধু যে আমার সিনিয়র তা নয়, উনি কিন্তু এক সন্তানের জননীও।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার নারী সহকর্মীকে নিয়ে আর কোনো কথা নয়। তবে তুমি কি জানো টাঙ্গাইল তাঁতে বোনা শাড়ির জন্য সেই ব্রিটিশ আমল থেকে বিখ্যাত?’
‘তা আমি কি করে জানব, আমি কি শাড়ি ব্যবহার করি?’
‘তুমি কেন শাড়ি পরবে? সেটা তো আমি পরব। আর তোমার কাজ হলো টাঙ্গাইল থেকে আমার জন্য একটা জামদানি আর আরেকটা সুতি আর সিল্কের মিশ্রণে তৈরি শাড়ি কিনে আনবে।’

‘শাড়ি আমি দুটোই কিনব, কিন্তু একটা তোমার জন্য আর আরেকটা আমার মায়ের জন্য।’

‘আসলে টাঙ্গাইলের শাড়ির কথা মনে হতেই কেন জানি স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথাই ভেবেছি। তবে শোনো, শাড়ি কেনার সময় কিন্তু আমাকে ফোন করতে ভুলবে না।’

আরও পড়ুন

তিন দিন ধরে অনিক আর তার নারী সহকর্মী তাদের অফিসের গাড়ি আর ড্রাইভারসহ টাঙ্গাইল সদর আর তার পার্শ্ববর্তী এলাকার অনেক স্থানে গেছে। অনিক জেনেছে, এলাকাটি যমুনা নদীর তিনটি শাখা নদী পুংলি, লৌহজং আর এলংজানি দিয়ে গঠিত একটি বন্যা অববাহিকা বা প্লাবন ভূমি। এই প্লাবন ভূমির মাঝখানের এলাকাটি, যা লৌহজং প্লাবন ভূমি নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত, সেটা বাঁধ দিয়ে ঘেরা, যাতে করে বর্ষার মৌসুমে বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর এর বাইরের এলাকায় বন্যার পানি অনায়াসে যাওয়া-আসা করে থাকে। অনিক এ এলাকার অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ে যেমন বন্যার পানির সাধারণ গভীরতা ও স্থিতিকাল, ফসল উৎপাদনের চক্র ও ভূমির ব্যবহারও জেনেছে। কিন্তু গত তিন দিনে ওর নারী সহকর্মীর একটি আচরণ ও বুঝে উঠতে পারেনি। সেটা হলো অনিক সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সারাটা সময় ওর নারী সহকর্মীর সঙ্গেই ছিল, কিন্তু একটিবারের জন্যও তাকে প্রকৃতির ডাকে যাওয়ার জন্য কোনোরকম ছুটি নিতে দেখেনি। ও আরও দেখেছে, ওর নারী সহকর্মীর হাতব্যাগের সঙ্গে ঝোলানো এক ২৫০ মিলিলিটারের পানির বোতল, যা সব সময়ই প্রায় অর্ধেকটাই ভরা, তবে মাঝেমধ্যে তাকে দেখেছে, ওই বোতল থেকে খুব সামান্য পরিমাণ পানি পান করতে, যা দিয়ে হয়তো কোনোরকমে গলাটা ভেজে। বিষয়টি ওকে বেশ ভাবায়—এটা কি করে সম্ভব। সারাটা দিন বাথরুম বা টয়লেট ব্যবহার না করে কীভাবে মানুষ থাকতে পারে। পরক্ষণেই ওর মনে হলো ও তো বোকার মতো ভাবছে, মফস্বল শহর বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকাতে কোনো পাবলিক বাথরুম বা টয়লেটের অস্তিত্ব নেই। আর কোথাও যদি থেকেও থাকে তবে তা হবে ব্যবহারের অনুপযোগী। অনিকের এই আত্মোপলব্ধি ওকে বেশ পীড়া দেয়—বয়স্ক, নারী, আর শিশুদের জন্য ভ্রমণ তো তাহলে খুব কষ্টের। শুধু কি তাই, ছেলেদেরও খোলা আকাশের নিচে যেখানে-সেখানে  প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া দূষণ আর অসভ্যতা ছাড়া আর কিই-বা হতে পারে।

আজই টাঙ্গাইলে অনিকদের সফরের শেষ দিন। গত সন্ধ্যায় সে তার আবাসিক হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে টাঙ্গাইলের বিখ্যাত শাড়ি কোথা থেকে কেনা যায় আলাপ করেছিল। তার কাছ থেকে অনিক জেনেছিল যে শহরের শাড়ির দোকান থেকে না কিনে যদি সে বাজিতপুরের তাঁতিদের বাড়ি থেকে কিনতে পারে, তবে অনেক সস্তায় পেতে পারে। বেলা তিনটার দিকে তাদের সব কাজ শেষে সে তার সহকর্মীকে জানাল-
‘আপা, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে ঢাকায় ফেরার আগে আমি একটু বাজিতপুরে যেতে চাই ঘণ্টা দুয়েকের জন্য।’
‘কিন্তু কেন?’
‘না মানে, আমি দুইটা টাঙ্গাইলের শাড়ি কিনতে চাই সরাসরি তাঁতির বাড়ি থেকে।’
‘কিন্তু, আপনি তো অবিবাহিত, তাই না?’
অনিক খানিকটা মাথা চুলকিয়ে নিচু স্বরে বলল-
‘জি আপা। একটা কিনব আমার মায়ের জন্য আর একটা আপনাকে বলা যাবে না।’
‘ও আচ্ছা, আর বলতে হবে না। তা আপনি ড্রাইভারকে নিয়ে আপনার শাড়ি কিনে আনুন আর আমি এরই মধ্যে হোটেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিই।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই অনিক বাজিতপুর এলাকায় পৌঁছাল আর সে দেখতে পেল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক তাঁতিবাড়ি। অধিকাংশ বাড়ি আর তাঁতের ভগ্নদশা, যেন কোনোরকমে টিকে আছে। অনিক সত্যিই বিস্মিত হলো যে এ দরিদ্র তাঁতিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি হচ্ছে দামি দামি শাড়ি আর তাঁরাই যাপন করছেন মানবেতর জীবন—এ ধারার পরিবর্তন না হলে হয়তো এ শিল্প টেকসই না হয়ে বিলুপ্ত হতে বাধ্য হবে! জীবনে এই প্রথম অনিক একা শাড়ি কিনতে এসেছে। মায়ের জন্য মেটে রঙের জমিন আর গোলাপি পাড়ের একটা জামদানি শাড়ি কিনে ফেলল খুব বেশি সময় ব্যয় না করেই।

কিন্তু নীলার জন্য কিনতে গিয়ে ওর মনে পড়ল, তাই তো নীলা ওকে বলেছিল, শাড়ি কেনার সময় তাকে মোবাইল করতে। তাই কোনো রকম কালক্ষেপণ না করে অনিক নীলাকে ফোন করল। প্রতিটি রিং বাজছে আর অনিকের মানবচিত্তে ভেসে উঠছে, নীলা দ্রুত ছুটে আসছে ওর কলটা ধরার জন্য। চলবে…