উদ্বাস্তুর ইতিকথা-পঞ্চম পর্ব
দিন পেরিয়ে সপ্তাহ, সপ্তাহ পেরিয়ে মাসও অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু রিতা আজও তার ভাই টুটুলের কোনো খোঁজ পায়নি। কোথাও সে যায়নি? রাজনৈতিক দলের অফিস, হাসপাতাল, মর্গ, পুলিশ স্টেশন সবখানেই গেছে রিতা। দলের অফিস ছাড়া অন্য সব জায়গাতে রিতার ছায়াসঙ্গী ছিল ওর ভাইয়ের বন্ধু ও রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী রফিক। কিন্তু কোথাও টুটুলের কোনো সন্ধান মেলেনি। প্রতিটি দিন গেছে আর অনিশ্চয়তা রিতাকে রাহুর মতো গ্রাস করেছে আর সেই সঙ্গে ক্রমেই বেড়ে চলেছে তার দুঃখের গভীরতা। এভাবে আর কত দিন?
একদিন সন্ধ্যার দিকে টুটুলের খোঁজ করা থেকে বস্তিতে ফেরার পথে রফিক বলল—
‘দেখো রিতা, আমার মনে কয় টুটুল বেঁচে আছে’
‘ক্যান তোমার ইডা মনে হলো?’
‘ইডা তো সহজ কথা। ওর লাশ কি এহনও আমরা পাইচি নাকি?’
‘আরে, তুমি ঠিকই কইচাও। ভাই আমারে একা ফেলি মরবার পারবি না কলাম কিন্তুক।’ এ কথা বলতে বলতে রিতার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। একপর্যায়ে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। রফিক ভাবল সান্ত্বনা দেওয়ার চাইতে রিতা খানিকটা কাঁদুক, তাতে হয়তো ওর মনের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হলেও হতে পারে।
রিতা রফিকের সঙ্গে ভাইকে খোঁজাখুঁজি করতে করতে তাদের মধ্যে কথাবার্তায় তুমি-আমিতে নেমে এসেছে নিজেদের অজান্তেই। আর রিতা যেন রফিকের দেখা পেলে ভাইকে না খুঁজে পাওয়ার কষ্ট কিছুটা হলেও কম অনুভব করে থাকে। এ বিষয়টা আগে না লক্ষ্য করলেও কেন জানি রফিক কয়েক দিন হলো বুঝতে পারে। সত্যি বলতে কি রিতাকে সে যেন মনে মনে পছন্দ করতেও শুরু করেছে, কিন্তু শোকাহত রিতাকে সে কথা বলতে সে সংকোচ বোধ করে।
কিছুদিন হলো রিতা পোশাক কারখানার কাজে নিয়মিত হয়েছে। সত্যি বলতে কি তার কারখানা কর্তৃপক্ষ ওর ভাইকে খোঁজাখুঁজির ব্যাপারে শুধু যে ওকে খণ্ডকালীন কাজ করবার সুযোগ দিয়েছে, তা নয় বরঞ্চ সঠিক বুদ্ধি–পরামর্শও দিয়েছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রিতার সীমিত আয়কে বৃদ্ধাগুলো দেখিয়ে চলেছে। ও মাঝেমধ্যে ভাবে আচ্ছা এই বিশাল পোশাক কারখানাগুলো যদি রাজধানীতে না গড়ে উঠে অন্য খানে হতো, যেমন অনুর্বর কোনো এলাকায়, তাহলে হয়তো ওর স্বল্প আয়ে জীবনযাপন বেশ চলে যেত! এ ছাড়া ক্রমঃবর্ধমান জনসংখ্যার ভারে নতজানু হয়ে চলতে থাকা রাজধানীও মেরুদণ্ড খাড়া করে চলার অবকাশ পেত!
এই তো সেদিন দুপুরের দিকে। রিতার পোশাক কারখানার দুই ম্যানেজার রিতার কাজের টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন। এতে রিতা খানিকটা অস্বস্তি বোধ করলেও কান খাড়া করে তাদের আলাপচারিতা শ্রবণ করছিল। আলাপচারিতার একপর্যায়ে প্রোডাকশন ম্যানেজার জেনারেল ম্যানেজারকে বললেন—
‘জানেন স্যার, কারখানার শ্রমিকেরা না প্রায়ই বলাবলি করে যদি পোশাক কারখানাগুলো রাজধানীর বাহিরে অন্য শহরে হতো তাহলে ওদের সীমিত আয়ে জীবন ভালোভাবেই চলে যেত।’
‘ওরা কিন্তু খারাপ কিছুই বলে না। কিন্তু সমস্যা হলো দেশের অধিকাংশ শহরে ইলেকট্রিসিটি আর গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নেই। এর বাহিরে কাঁচামাল আর তৈরিকৃত মালামাল পরিবহন, ক্রেতা-বিক্রেতার সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজধানীতে অবস্থান, এ ছাড়া শিল্প উদ্যোক্তাদের ইচ্ছা—সব কিছু মিলিয়ে এটা করা সত্যিই কঠিন।’
‘স্যার, আপনার সব কথাই সঠিক। কিন্তু, দেখেন একটা সময়ে আমাদের সিংহভাগ শিল্পকারখানা ছিল ডেমরা আর খুলনা অঞ্চলে। তাই আমরা ইচ্ছা করলেই সবই সম্ভব।’
‘শোনেন, আমরা ভাই এই পোশাক খাতের সামান্য কর্মচারী-কর্মকর্তা। আমাদের মতো আদার ব্যাপারীর কি জাহাজের খবর নিলে চলে?’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল ম্যানেজারের কণ্ঠ চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
সেদিন কাজ শেষে কারখানা থেকে বের হতেই রিতার চোখ পড়ল রাস্তার ওপারে চায়ের টং দোকানে সামনে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে রফিক। ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে রিতা রফিকের নিকটবর্তী হওয়ার পরও রিতার মনে হলো রফিক ওর উপস্থিতি টের পাইনি। আর তাই রফিকের একবারে কাছাকাছি গিয়ে একটু গলা কেশে রিতা বলল—
‘কত খুন ধরি খাড়াই আছ? তুমার দেহি কুনু হুশ নাইক্কা।’
আসলে কী তা–ই? রফিক তো ইচ্ছা করেই এমন ভান ধরে রিতার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তবুও সে বলল—
‘এই দিক দিয়ে যাতিছিলাম। মনে বললো এড্ডু চা খাই। তাই আর কি?’
‘হুনো, আমার লগে মিছা কবা না কলাম কিন্তুক। আমি জানি তুমি ঠিকই আমার জন্নি এহানে খাড়াই আছো।’ এক গাল হেসে রফিক বলে উঠল—
‘আর তুমার লগে লুকাইয়ে কী হবি! তুমার সঙ্গে দেকা করার জন্নিই তো এখানে আইচি, তা-ই না? ...বস্তির ঘরে তুমি একা থাহো, সেখানে কি আমি তুমার কাজের পরে দেখা করতি যাতি পারি? তুমিই কও?’
রফিকের কথার জবাবে রিতা উত্তর দেওয়া তো দূরে থাক, লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। কিন্তু রিতার ভাগ্য ভালোই বলতে হয়—আলোক আঁধারির মধ্যে রফিক রিতার এই লজ্জাবনত অবয়বটা দেখতে পেল না।
কয়েক দিন ধরে রিতার কারখানার পার্শ্ববর্তী কারখানাতে শ্রমিকেরা মালিক পক্ষের এক কর্মচারীর চাকরিচ্যুতির দাবি তুলেছে। তাদের অভিযোগ মালিক পক্ষের সেই কর্মচারী কারণে-অকারণে অন্য শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে থাকে। এ বিষয়ে অনেকবারই মালিকপক্ষকে জানানো সত্ত্বেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। বরং জুটেছে আরও লাঞ্ছনা। এতে করে সৃষ্টি হয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ, যার ফলে মালিকপক্ষ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই ঘটনাতে অন্য কারখানার শ্রমিকেরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছে আর দিয়েছে ধর্মঘটের ডাক। যোগ হয়েছে পারিশ্রমিক বাড়াবার মতো চিরন্তন দাবি, যা আকাশে–বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
চলমান শ্রমিক ধর্মঘট তখন তুঙ্গে। কারখানার কর্মকর্তারা বিচলিত—অনেকেই চালান পাঠাবার সময়সীমার একেবারে দ্বারপ্রান্তে। এক কারখানার জেনারেল ম্যানেজার অন্য আরেক কারখানার ম্যানেজারকে বললেন—
‘ভাই, আপনি জানেন কি না, জানি না আমাদের দেশের অন্যতম ক্রেতা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চেইনশপ আমেরিকার ওয়ালমার্ট তাদের দোকানগুলোতে শ্রমিক ইউনিয়ন গড়তে উঠতে দেখলেই ভয়ানক আচরণ করে থাকে।’
‘তাই নাকি ভাই? কি যে, বলেন না? তা ওদের দোকানগুলোতে কি শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তোলা নিষিদ্ধ?’
‘নারে ভাই, তা হবে কেন? ওরা কঠোরভাবে দৃষ্টি রাখে আর প্রচারণা করে শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর। আর যদি ওদের কোনো দোকানে শ্রমিকেরা ইউনিয়ন করেই ফেলে, তাহলে ওরা সেই শাখাটিই বন্ধ করে দেয়।’
‘এ তো দেখছি একবারে জোর জবরদস্তি! তা আমেরিকার সরকার ওদের কিছুই বলে না?’
‘ওরে ভাই, হয়তো বলে। এই পৃথিবীতে জোর যার মুল্লুক তার, এ বিষয়ে আপনার কি কোনো সন্দেহ আছে?’
পোশাক শ্রমিকদের ধর্মঘট ইতিমধ্যে সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। রিতা আজ ধর্মঘটে না গিয়ে ঘরেই আছে। দুপুর ১২টার দিকে কথা নেই, বার্তা নেই কোথা থেকে রফিক এসে উপস্থিত। রিতার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ও বলল—
‘রিতা, আমার মন কচ্ছিল তুমি আজকে ঘরে থাকতি পার। তা এক কাম করলি কেমন হয়?’
‘কি কাম করতি হবি?’
‘চলো, দুপুর একটু গড়ালি আমরা বুড়িগঙ্গায় নৌকায় করি বেড়াতি যাই।’
নদীর কথা উঠলেই রিতা বরাবরই চুপ করে থাকে। ওর মানসপটে ভাসে ওর বালিকাবেলার স্মৃতি—নদীর সেই ভয়াবহ ভাঙন আর বেঁচে থাকবার নিরন্তন নিষ্ঠুর সংগ্রাম। ওর চুপ থাকা দেখে রফিক আবারও বলল—
‘আমার খুব করি মনে হচ্ছিল তুমি আমার সঙ্গে যাতি রাজি হবা কিন্তুক।’
পড়ন্ত বিকালে রিতা আর রফিককে দেখা গেল বুড়িগঙ্গার বুকে পালতোলা ছোট্ট এক নৌকায়। কিন্তু বুড়িগঙ্গার দূষিত পানি দেখে রিতার মনে হলো পোশাক আর অন্য শিল্পের বর্জ্যপানি রাজধানীর আশেপাশের নদীগুলোতে ফেলবার আগে যদি যথাযথভাবে শোধন করা হতো, তাহলে বাঁচত নদী, বাঁচত পরিবেশ, রক্ষা পেতো জীববৈচিত্র্য। রিতাকে চিন্তাযুক্ত দেখে রফিক বলে উঠল—
‘ওই রিতা, কি এত ভাবতাছো? আমারে এড্ডু কও না?’
রিতার একবার মনে হলো রফিককে ওর নদী ভাবনার কথা বলে। পরে মনে হলো রাজনীতিক কর্মী রফিককে এটা বললে ও রাজনৈতিক নেতাদের মতো বড় বড় বক্তৃতা দিয়ে এই সুন্দর মায়াময় পড়ন্ত বিকালকে হয়তো নষ্ট করে ফেলতে পারে। আর তাই হঠাৎই বলে উঠল—
‘কিছুদিন ধরে আমি একটা কথা তোমারে কব কব বলে ভাবি। কিন্তুক কওয়া হয় না।’
‘তা কি কবা কয়ে ফেলাও।’ এবারে রিতা চোখ বন্ধ করে বলল—
‘দেখো, নদী খেয়েচে আমাগের বাড়িঘর, রাজধানী কেড়ে নেচে আমার বাপ-মা আর ছোট্ট ভাইডারে। হারায় গেচে আমার ভাই। তুমি আমারে কথা দিলে আমারে একলা ফেলি চলি যাবা না।’
কোন উত্তর না করে রফিক নির্বাক অপলক দৃষ্টিতে রিতার দিকে তাকিয়ে রইল।
চলবে ....