উদ্বাস্তুর ইতিকথা - তৃতীয় পর্ব

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ইতিমধ্যে বছর দুয়েক সময় পেরিয়ে গেছে। সন্তানের ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষাদময় স্মৃতি মিনা বেগমের মানসপটে এখনো পরিপূর্ণভাবে সতেজ। এ দুঃখ আর কষ্ট কেন জানি সে মুহূর্তের জন্যও ভুলে থাকতে পারে না। বিশেষ করে তিন–চার বছরের কোনো শিশু দেখলেই তার মনের ভেতরটা কেঁদে ওঠে। কিন্তু যখনই সে টুটুল আর রিতার দিকে তাকায়, তখনই বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে, তার মনে হয় এই দুইটির জন্য তাকে অবশ্যই বাঁচতে হবে, আর বাঁচবার লক্ষ্যে করতে হবে কঠোর পরিশ্রম।

সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। টুটুল গাড়ির মেরামতের কাজ বেশ ভালোভাবেই শিখতে থাকে, ওর দ্রুত শেখা দেখে ওর গ্যারেজের মালিক ওর ওপর খুবই খুশি। আর রিতা যেন বস্তিতে ছোটোখাটো একটা শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র খুলে বসেছে। প্রতিদিন গড়পড়তা দুই তিনটা বাচ্চা ওর তত্ত্বাবধানে থাকে। সব কিছু মিলিয়ে মিনা বেগম তার দুই সন্তান নিয়ে বেশ শান্তিতে দিন পার করতে থাকে।

কোন এক সন্ধ্যায়, লাল সূর্য যখন দিগন্ত রেখার নিচে ডুবে যাবার কালে বস্তির ওপর দীর্ঘ ছায়া ফেলে, টুটুল মিনা বেগমকে দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, ‘মা, আমি রিতার জন্নি কলাম মেলা দিন ধরে ভাবতাছি। ইরাম করি অন্য মানসির বাচ্চাকাচ্চা হারাদিন দেখলি কি হবি?’
মিনা বেগম একেবারেই বুঝতে পারে না টুটুল কী বলতে চায়। তাই সে বলল, ‘তা বাজান, তুই কী কবার চাস? আমি তো তোর কথা বুজতাম নারে।’

বেশ খানিকটা সময় টুটুল চুপ থাকে। তারপর একটু গলা কেশে অনেকটা কান্না ভেজা মৃদু কণ্ঠে বলে উঠল, ‘মা রে, আমি তো আর ইস্কুলে যাতি পারলাম না। কিন্তুক আমি চাই রিতা ইস্কুলে যাক। ও লিহাপড়া শিখুক।’ এবারে রিতার উদ্দেশে টুটুল বলল, ‘তা রিতা, তুই কি ইস্কুলে যাবার চাস, নাকি পরের বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে থাকপার চাস?’

এ কথা শোনার পর রিতার চোখে-মুখে এক আনন্দের ঝিলিক বয়ে গেল। সে ভাইয়ের উদ্দেশে বলল , ‘কি যে কও না, আমি তো ইস্কুলে যাইবার জন্নি সারাখুন এক পায়ে খাড়াই থাহি।’

ভাই–বোন কথা চালিয়ে গেলেও মিনা বেগমকে কেমন জানি আনমনা দেখাচ্ছিল। আর তাই টুটুল ওর মাকে আলতো একটা ধাক্কা দিয়ে বলল , ‘এই মা, কী এত ভাবতাছ? কথা কও না ক্যানে?’

ছেলের ধাক্কা খেয়ে মিনা বেগম হঠাৎই যেন বাস্তবে ফিরে এল আর মৃদু স্বরে বলে উঠল , ‘নারে টুটুল, আমারও মন চায় রিতারে ইস্কুলে পাঠাইতাম। কিন্তুক তোরে ইস্কুলে পাঠাইতে পারি নাইক্কা। তাই ডরে তোরে কইতে সাহস পাই নাইক্কা।’ এরপর খানিকটা দম নিয়ে আবারও বলল, ‘তা হ্যারে টুটুল, ইস্কুলে পাঠাইলে তো মেলা টাহা লাগ তো নারে?’
টুটুল এবারে হাসতে হাসতে বলল , ‘ক্যান রে মা, রিতারে তো আমাগো বস্তির এনজিওর ইস্কুলে পাঠামু। হ্যাগো ইস্কুলে টাহা লাগতো নাইক্কা।’

পরের দিন সকালবেলা। বস্তির বর্ণহীন রংচটা আকাশে নতুন সূর্য উদিত হয়েছিল কিনা কে জানে। কিন্তু যাপিত জীবনের সকল প্রতিবন্ধকতা আর বাধাকে এক প্রকার পাশ কাটিয়েই মিনা বেগম আর টুটুল দুজনে মিলে রিতাকে নিয়ে হাজির হলো তাদের বস্তির এনজিও পরিচালিত স্কুলে। শুরু হলো রিতার নতুন জীবনের। স্কুলের শিশুদের কোলাহল রিতার মনে সঞ্চার করল এক অনাবিল আনন্দের শিহরণ।

রিতার স্কুলে যাওয়া-আসা অবশ্যই মিনা বেগমের পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা কিছুটা হলেও কমিয়েছে। তারপরও মিনা বেগমের মনে সেটা নিয়ে কোনোরূপ আক্ষেপ নেই। বরং স্কুলে যাওয়ার সময় মিনা বেগম রিতার চোখে যে আনন্দের আর আলোর ঝলকানি দেখতে পায়, তা যেন মহা মূল্যবান এক সম্পদ। তার কাছে মনে হয়, এনজিওর স্কুল শুধু শিক্ষাই দেয় না, সেখানে জীবন গড়ার স্বপ্নেরও জন্ম হয়, সুযোগ পায় বৃক্ষের মতো ডাল-পালা বিস্তৃত করে পৃথিবীর বুকে নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার।

সময় বয়ে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে টুটুল ওর মায়ের সমান্তরালে পরিবারের দায়দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতে থাকে। ছেলেটার দায়িত্ববোধ মিনা বেগমের মনে প্রায়ই সুখের আবেশ সৃষ্টি করে, কিন্তু স্বামী আর কোলের বাচ্চাটার চিরবিদায়ের কথা মনে হলেই মনটা বিষিয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন

ইতিমধ্যে রিতা এনজিও পরিচালিত স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছে। পড়ালেখার প্রতি ওর আগ্রহ খোলা আকাশের মতো বিশাল। শুধু কি সে, তার মা আর ভাইও ভাবে তার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া দারিদ্র্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায়। কিন্তু বস্তিতে কোন উচ্চবিদ্যালয় তো ছিলই না আর সবচেয়ে কাছেরটি ছিল কয়েক কিলোমিটার দূরে। যেখানে রিতাদের বস্তির কেউই পড়তে যায় না।

রিতা যখন উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশুনার জন্য আকুল, টুটুল তখন যন্ত্রপাতি আর গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার একজন সদ্য কৈশোর পেরোনো দক্ষ এক মোটর মেকানিক। কিন্তু কিছুদিন হলো, মিনা বেগম টুটুলের মধ্যে এক সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ্য করতে থাকে। টুটুল আজকাল প্রায়ই বেশ রাত করে ঘরে ফেরে আবার মাঝেমধ্যে বলা নেই কওয়া নেই দুই–তিন দিনের জন্যে লাপাত্তা। কেউই বলতে পারে না সে কোথায় গেছে বা কী করছে। মিনা বেগম আর রিতা দুজনেই টুটুলের জন্য দুঃশ্চিন্তা করে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না কীভাবে বিষয়টা টুটুলের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে।

এক অমাবশ্যার রাত্রিতে টুটুলের ঘরে ফেরার কোন নামগন্ধ নেই। ওই দিকে মিনা বেগম আর রিতা অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে যে কখন টুটুল ফিরবে। আজ মিনা বেগমকে যেন জানতেই হবে টুটুল কী এমন রাজকার্য সমাধানে সময় ব্যয় করে থাকে। অবশেষে প্রায় মাঝরাতের দিকে যখন বস্তিবাসীরা ঘুমের অতলে, টুটুল ঘরে ফেরে। সে কল্পনাও করতে পারে নি যে ওর মা আর বোন ওরই অপেক্ষায় বসে আছে।

মিনা বেগম বলে উঠল, ‘হ্যাঁরে টুটুল, ওই টেবলের ওপর তোর ভাত ঢাকা আছে। জলদি জলদি খাইয়া আয়, তোর লগে কথা আছে।’ মায়ের কণ্ঠ শুনে টুটুল বেশ খানিকটা বিব্রতবোধ করে। সে বলল, ‘আমার খিদা নাইক্কা। কি কবার চাও, জলদি কইয়া ফালাও কিন্তুক।’

একটু দম নিয়ে মিনা বেগম বলে উঠল, ‘হ্যাঁরে বাজান, তুই এত রাইত তক কই থাকস? কী করস? তোর গ্যারেজ তো বন্ধ হয় হেই কোন সন্ধ্যায়।’

টুটুলের বলতে ভয় হয়, তবুও মনে হলো আজ তার বলতেই হবে। সে বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘মারে, আমার আর মেকানিকের কাম ভালা লাগতো নারে। ...আমি পলিটিকসে নাম লিখাইছি কলাম। ...গরিব মানসির দুক্ষির জেবন বদলাইতে চাই রে মা। বস্তির এই ফহিরনির জেবন আমার টানতি টানতি মনে হবার লাগি দম আটকি মরি যাই কলাম।’

কয়েক মাস পরের কথা। বন্যা বিধস্ত উদ্বাস্তু এই পরিবারটির জীবনে নেমে এল আরেক ভয়াবহ বিপর্যয়ের। সেদিন মিনা বেগম যে বাসায় কাজ করতে গিয়েছিল, সেখানে সে বাথরুমে ওই পরিবারের কাপড়চোপড় কাচাকাচিতে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ সে শুনতে পায় তার গৃহকর্ত্রীর বিকট চিৎকার রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে, ‘বাঁচাও বাঁচাও আমার সমস্ত শরীর আগুনে পুড়ে গেল রে...’

মিনা বেগম দ্রুততার সঙ্গে ছুটে যায় রান্নাঘরের দিকে। গিয়ে দেখে লম্বা কাঠের ফালির মতো জ্বলছে তার গৃহকর্ত্রী। কি যে করবে, সে বুঝে উঠতে পারে না। তারপরও কোনরকম ইতস্তত না করে ছাপিয়ে পড়ে গৃহকর্ত্রীকে রক্ষার মহান কাজে। কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। শেষ রক্ষা হয় না তার গৃহকর্ত্রীর। আর মিনা বেগমের শরীরের অন্তত আশি ভাগ আগুনে পুড়ে ঝলসে যায়।

মিনা বেগমের স্থান হয় মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে। চিকিৎসা চলতে থাকে কিন্তু মিনা বেগমের ভালো হবার কোনরূপ লক্ষণই দেখা যায় না। আর ওই দিকে রিতা আর টুটুল একে অপরের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, যেন বলতে চায়, প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার কি কোন শেষ নেই? চলবে....

আরও পড়ুন