উদ্বাস্তুর ইতিকথা-চতুর্থ পর্ব
মিনা বেগমের আকস্মিক মৃত্যু টুটুল আর রিতার জীবনের পথচলাকে একপ্রকার থমকে দিয়েছে। তারা দুই ভাই-বোন যেন দুঃখের এক অথই সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছে। তারা সারা দিনই বস্তির ঘরেই থাকে। নিজেদের মধ্যেও তেমন কোনো কথাবার্তা বলে না, চারদিকে শুধু নীরবতা আর নীরবতা। সংসারজীবন থেকে মিনা বেগমের এই অপ্রত্যাশিত বিদায় যে শূন্যতার সৃষ্টি করেছে, তা যেন তাদের ছোট্ট ঘরের নীরবতার মধ্যে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
কয়েক সপ্তাহ পরের কথা। এক সন্ধ্যায়, টুটুল যে গ্যারেজে কাজ করত, তার মালিক জমির আলী এল দেখা করতে। সে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বেশ নরম কণ্ঠে বলল-
‘দ্যাখ টুটুল, মা-বাপ কি কারও হারা জীবন থাহে রে?’
টুটুল জমির আলীর কথার পিঠে কোনো উত্তর করে না দেখে সে আবারও বলে-
‘তা তোর তো বুনির কথা ভাবতি হবি। হুনলাম তুই হারাদিন ঘর থাইকা বাহির হস না।’
উত্তরে টুটুল অন্যদিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলে-
‘চাচা, মা ডা মরি যাবার কষ্ট ভুলতি পারছি নে রে।’
‘শোন টুটুল, আমি বলি কি তুই কামে চলি আয়। তোর ভালো লাগতি পারে কলাম কিন্তুক।’
এ কথা বলার পর জমির আলী চুপ করে থাকে আর মনে মনে ভাবে টুটুল যেমন দক্ষ কারিগর হয়েছে, তাতে ওকে ছাড়া তার গ্যারেজ চালানোও বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। সে আবার বলে-
‘শোন টুটুল, আমি জানি তুই আর কারিগরের কাম করতি চ্যাস নে। কিন্তুক আমি কই কি, তুই পেত্যেক দিন চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা কাম করলি। হেরপর, তোর যেখানে মন চায় সেখানেই যাবি, মনে হলি পলিটিকসেও।’
উত্তরে টুটুল কিছুই বলছে না দেখে জমির আলী বলল-
‘আমি আজকে উঠি রে।...তুই ভেবেচিন্তে দ্যাখ। আমার গ্যারেজের দরজা তোর জন্নি সব সময় খুলা থাকপি কিন্তুক।’
কয়েক দিন পরের এক সন্ধ্যা। টুটুলের এক ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী রফিক তার সঙ্গে দেখা করতে এল। সে বলল-
‘দেখ টুটুল, তোর মতন কর্মী আমাগোর দলের জন্নি খুবই দরকার। মানষির জীবনে কত কিছু হয়! ...তুই গা ঝাড়া দিয়ে উঠি দাঁড়া, দেকপি সব ঠিক হয়ে যাবে নে।’
‘তুই ঠিকই কইছিস। তয়...’ এ কথা বলার পর টুটুল কেন জানি কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। যেন ডুবে যায় এক অন্তহীন চিন্তার সমুদ্রে।
টুটুল তার নিজের মনে ভাবতে থাকে, এই রাজধানীর প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বসবাস করে, যাদের না আছে অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা আর বাসস্থানের নিশ্চয়তা। কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা আর দূষণমুক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকার অধিকার, সে তো সুদূরপরাহত। শুধু কি তা-ই? বস্তির পরিবারগুলো প্রতি বর্গফুট অনুযায়ী যে বাসাভাড়া দেয়, তা রাজধানীর অভিজাত এলাকার চেয়েও বেশি। টুটুল ভাবে, যদি রাজধানীর এসব অধিকারহীন হতদরিদ্র বস্তিবাসী কোনো দিন শুধু দুমুঠো ভাত আর অন্যান্য মৌলিক চাহিদার দাবিতে রাজপথে শুয়ে পড়ে, তবে এত মানুষের গণজোয়ার ঠেকানোর কোনো উপায় কি রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে আছে?
হয় তো পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, বেধড়ক লাঠিপেটা আর মান্ধাতার আমলের বন্দুক দিয়ে গুলি করতে পারে, কিন্তু তাতে কি লাখ লাখ মানুষকে ছত্রভঙ্গ করা সম্ভব? হয়তো বস্তিবাসীরা ভাবতে পারে, এমনিতেই খেতে পায় না আর পুলিশের তৎপরতার না হয় দুই-চারজন মারা যেতে পারে। আচ্ছা, পুলিশের তৎপরতায় যদি কিছু না হয়, তাহলে যদি আর্মি নামায়? কিন্তু আর্মিই-বা কি করতে পারে? তাদের তৎপরতার কারণে হয়তো আরও বেশি মানুষ মারা যেতে পারে, কিন্তু এত কিছুর পরও যদি দাবি আদায় হয়, তবে উন্নত জীবন পেতে পারে যারা বেঁচে থাকবে। কিন্তু এ-ও কি সম্ভব?
এ কথা মনে হতেই টুটুলের ঠোঁটের কোণে হাসির আভা দেখা গেল। সে ভাবল, অবশ্যই সম্ভব! শুধু দরকার এত মানুষকে একত্র করার মতো একজন নেতার। সে ধরনের নেতা কখনই কি বাংলার মাটিতে জন্মাবে? টুটুলের চিন্তার ঠিক এ পর্যায়ে রফিক কনুই দিয়ে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল-
‘এই টুটুল, কী এত ভাবতাছিস? কথা কস না ক্যা রে?’
টুটুল ভাবল তার উদ্ভট ভাবনার কথা রফিককে বললে হয়তো ভাববে মা মারা যাওয়ায় টুটুলের পাগল হওয়ার আর বাকি নেই! আর তাই বলল-
‘আমারে আর কয়ডা দিন দে। আমি পার্টি অফিসে আসপানে।’
রফিক চলে যাওয়ার পর রিতার কথাতেই তারা দুজনে একসঙ্গে রাতের খাবার খেতে বসল। রিতার মনে হলো মায়ের মৃত্যুর পর এই প্রথমবারের মতো তারা একসঙ্গে খেতে বসেছে। খাবার খাওয়ার প্রায় শেষ পর্যায়ে রিতা বলল-
‘ভাই, আমি ভেবে দেখলাম এভাবে ঘরে বসে থাকলি তো চলবি না রে।’
‘তুই ঠিকই বলিছিস।...তুই কি শুনিছিস জমির চাচা আর রফিক আমারে কি বলিছে?’
‘এই ছোট ঘরের মদ্দি যার সঙ্গেই কথা কও, তার সবকিছুই তো শুনতি পাই। কিন্তুক ক্যান?’
‘আমি চিন্তা করে দেখলাম, জমির চাচার গ্যারেজেই কাম করা ভালো। বিকেল থেকে তালি পার্টির অফিসেও যাতি পারব। তা তুই কি কবি ক?’
‘আমি আর কি কব। তুমি যা ভালো মনে করবা, তা-ই কর।...তয় আমি চাচ্ছিলাম একটা কামে যাই।’
‘তা তুই কি করতি চাস? সেই অন্য মানষির বাচ্চাকাচ্চা দেখে রাখতি চাস?’
‘না রে ভাই, আমি পোশাক কারখানায় কাম নিতি চাই। আমাগের বস্তির অনেক মেয়েই তো সেখানে কাম করে।’
টুটুল গাড়ির গ্যারেজে কাজ শুরু করেছে। সেই সকালে কাজে যায় আর বিকেল চারটার পর সে কাজ থেকে বেরিয়ে যায় আর সন্ধ্যা ৮টা-৯টা পর্যন্ত পার্টির কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কখনো মিটিং, কখনো মিছিল, কখনো পোস্টার সাঁটানো, কখনো সালিস-বিচার—এভাবেই দিন গড়াতে থাকে। আর রিতা একটা পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছে। ওর কাজ শুরু হয় সকাল সাতটায় আর শেষ হয় সেই সন্ধ্যা সাতটায়। প্রতি সন্ধ্যায় দুই ভাই-বোন একসঙ্গে রাতের খাবার খায় আর ফাঁকে ফাঁকে রিতা প্রায়ই সারা দিনে ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে।
কয়েক মাস পরের কথা। এক বিকেলে টুটুল তার পার্টির এক বিশাল সমাবেশে গেছে। চারদিকে জনাকীর্ণ।
এক কোণে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টুটুল শুনতে থাকে বড় বড় নেতা-নেত্রীর হৃদয়গ্রাহী ভাষণ। ভাষণ শুনতে শুনতে টুটুলের মানসপটে ভেসে ওঠে সারা দেশে শান্তি আর শান্তি। রাজধানী আর মফস্সলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বাস্তুহারা পরিবারগুলোর আর জীবন–জীবিকার জন্য রাজধানীতে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিতে হয় না। স্থানীয়ভাবে তাদের সব ব্যবস্থা করা হয়।
এমন দিবাস্বপ্নের মধ্যে হঠাৎই টুটুলের মনে হলো তার চোখ জ্বলছে। মঞ্চের কাছে দেখা গেল ধোঁয়া উড়ছে আর বোমা বিস্ফোরণের শব্দও শোনা যেতে লাগল। ইতিমধ্যে পুলিশ যে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছড়িয়েছে তা–ই নয়, ভয়ানক লাঠিপেটাও শুরু করে দিয়েছে। এমন অবস্থায় যে যেদিকে পারছে, সেদিকেই ছুটে চলেছে। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে সমাবেশস্থল আর তার পার্শ্ববর্তী এলাকা একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে, যেন রণক্ষেত্র!
শহরের পরিবেশ থমথম করছে, যানবাহনের চলাচল বন্ধ, শহরের প্রধান সড়কগুলো একেবারেই ফাঁকা। টুটুল ভেবে পায় না, সে কীভাবে বস্তিতে পৌঁছাবে। তার চিন্তায় আসে মা-বাবাহারা রিতা নিশ্চয়ই তার জন্য প্রতিদিনের মতো রাতের খাবার খুলে নিয়ে বসে থাকবে।
আর অন্যদিকে রিতা, কারখানা থেকে ফেরার পথেই শুনেছে আজকের জনসভায় ভীষণ রকমের হট্টগোল হয়েছে। ফেরার পথে পরিচিত বেশ কয়েকজনকে রিতা জিজ্ঞাসা করে, কেউ তার ভাইকে দেখেছে কি না, কিন্তু কেউ সদুত্তর দিতে পারে না। ঘরে ফেরার পর সে প্রতীক্ষায় থাকে, কখন ভাই ফিরবে? কিন্তু সন্ধ্যা, ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকারের কাছে নিজের সত্তাকে বিলিয়ে দেওয়ার পরও টুটুল ঘরে ফেরে না। রিতা বুঝে উঠতে পারে না এমতাবস্থায় তার কী করণীয়। সে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে হাত তুলে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, তার ভাইকে যেন কোনো বিপদ স্পর্শ না করে। চলবে...