উদ্বাস্তুর ইতিকথা: দ্বিতীয় পর্ব
রহমত মিয়ার চিরপ্রস্থান মিনা বেগম আর তার তিন সন্তানকে যেন অকূলপাথারে নিমজ্জিত করল। এই তো সেদিনের গ্রামের সচ্ছল সুখী পরিবারটি আজ বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত, ঠিক যেন গভীর সমুদ্রে দিশাহারা নাবিকহীন নৌকার মতো।
জীবন কি চলতে চায়? মিনা বেগম এখন গোটা তিনেক বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করে, সেই সকাল ছয়টাই সে বস্তির ঘর থেকে বের হয় আর সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ক্লান্ত অবসন্ন দেহ-মন নিয়ে ঘরে ফিরে আসে।
এরপর কয়েক ঘণ্টা তাকে ব্যয় করতে হয় নিজ সংসারের রান্নাবান্না আর গৃহস্থালির কাজে। মিনা বেগম কিছুদিন ধরে ভাবছে, টুটুলকে যদি কোনো একটা ছোটখাটো কাজে ঢোকানো যেত, তবে তাদের মা-পুতের আয়ে সংসারটা আরও একটু ভালোভাবে চলত। কিন্তু সে ভেবে পায় না, কীভাবে সারাক্ষণ ঝিম ধরে থাকা ছেলেকে এ কথা বলবে।
কয়েক সপ্তাহ পরের কথা। কোনো এক সন্ধ্যায় বস্তিতে ফেরার পথে মিনা বেগম দেখতে পায়, তার ছেলে ওরই সমবয়সী কিছু ছেলেপেলের সঙ্গে মারামারি করছে, আর সেই সঙ্গে অশ্লীল-অশ্রাব্য ভাষায় মুখ খিস্তি করে চলেছে। ছেলেকে এ অবস্থায় দেখে মিনা বেগম কি করবে, বুঝে উঠতে পারে না। খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার পর সে চিৎকার করে বলে উঠল—
‘টুটুল, তোরে কিন্তুক আমি খাইছি। হারাদিন ঝিম মারি থাকো আর আমি না থাকলি এই সব করি বেড়াও। ঘরে চল, তোর মজা আমি দেখাবানে কলাম কিন্তুক।’
মায়ের এমন উচ্চ স্বর শুনে টুটুল বেশ খানিকটা হতভম্ব। এর আগে কখনোই সে মায়ের এমন রূপ দেখেনি। সে বেশ ভয়ও পেয়েছে, আর তাই মিইয়ে পড়া ভেজা বিড়ালের মতো নিঃশব্দে মায়ের পিছে পিছে সেও ঘরে ফিরে এল।
অন্যদিকে মিনা বেগম ভাবছে, যাক বাবা, ছেলেকে বেকায়দা অবস্থায় পেয়ে তার বেশ কিছুটা সুবিধা হয়েছে। কিন্তু বাইরে সে একটা নিশ্চুপ ভাবলেশহীন মুখোশ ধরে আছে, যা দেখে শুধু টুটুলই না, অন্য দুই সন্তানও ভয়ে অস্থির। বাচ্চাগুলো ভাবছে মায়ের আজ কি যে হলো! এভাবে মিনা বেগম সেদিনের সংসারের সব কাজ শেষ করে। সবাইকে নিয়ে একত্রে বসে রাতের খাবার পর সে টুটুলকে বেশ গম্ভীর স্বরে বলল,
‘শোন টুটুল, তুই যে এত খারাপ হইছোস, তা আমি কিন্তুক বুঝতাম নারে।’
এ কথা বলার পর সে চুপ করে থাকল আর অপেক্ষা করতে থাকে ছেলে কিছু প্রত্যুত্তর করে কি না।
কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর সে আবারও বলল—
‘আমি ভাবতাছি তোরে একটা কামে দিমু। আমার লগে মোড়ের গাড়ির গ্যারেজের মালিকের কথা হইছে।
হেই কইছে তোরে ছুডোখাডু কাম করবার দিবি। গোড়ার দুই তিন মাস কলাম শুধু তিনবেলা খাওন দিবি। কিন্তুক কাম এড্ডু শিকতি পারলিই হেই তোরে টাহাপয়সা দিবি কলাম। তা তুই কি কবি ক?’
টুটুল যেহেতু বেকায়দায় পড়েছে, তাই কি আর সে বলতে পারে? চোখের দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে মিনমিন করে বলল—
‘মা, আমি তো ইস্কুলে পড়বার চাই।’
মিনা বেগম যা ভয় পাচ্ছিল, সেটাই তো হলো! সে তো বেশ ভালো করেই জানত যে টুটুলকে কাজের কথা বললেই সে পড়বার বিষয়ে কথা তুলবেই। তাই ধীর, কিন্তু কঠিন স্বরে সে বলল—
‘দেখ টুটুল, একে তো তোদের বাপ নাইক্কা। হেরপর যতটুক কামাই করি, তা দিয়ে তো আমগোর খাওন-পরন ঠিকঠাক চলবার চায় না। আর তুই কস তোরে ইস্কুলে পাঠাইতাম? তা তুই-ই বল, আমি কী করতাম?’
কথাগুলো বলবার পর মিনা বেগমের বুক চিরে এক দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে এল। আর টুটুল? ওর দুচোখ বেয়ে এক চাপা কান্না টপটপ করে গড়িয়ে পড়তে থাকে।
কয়েক মাস পরের কথা। টুটুল তার কাজে বেশ ভালোই করছে। কিছু টাকাপয়সাও সে আয় করে। আর তাই মা-পুতের আয়ে সংসারের আর্থিক অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও টানাপোড়েনের অন্ত নেই। তাদের পারিবারিক উপার্জন খানিকটা বাড়লেও তার চেয়ে দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে ঘরভাড়া, দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ, পানি আর গ্যাসের দাম।
একদিন মিনা বেগম বস্তির কলতলায় কাপড় কাঁচা আর ধোয়ার কাজ করছিল। এমন সময়ে আরেক বস্তিবাসী নারী এসে মিনা বেগমকে বলল—
‘হেগা টুটুলের মা, আমাগো একটা উপকার করবার পারবানি?’
কাপড়চোপড় পরিষ্কারের কাজ না থামিয়েই মিনা বেগম বলল—
‘তা তোমাগের জন্নি কী করতি হবি, জলদি জলদি কয়ে ফেলাও দিখিনি?’
‘হইছে কি, আমার ছোডো মাইয়েডার জন্নি না, ঠিক মতন কামে যাতি পারি নে।’
‘তা আমাগোর কী করতি হবি, সেইডা কও না কেন?’
‘আচ্ছা তা কইতাছি খাড়াও। আমাগোর ছোডো মাইয়েডারে যদি পেত্যেক দিন সকালে চার-পাঁচ ঘণ্টা তোমাগো রিতার কাছে রাখবার পারতাম, তয় কুনু রকম চিন্তন ছাড়া কামে যাইবার পারতাম কিন্তুক। আর তোমাগোর রিতারে কলাম কিছু টাহা দিবানে আমগোর মাইয়াডারে রাখার জন্নি।’
প্রস্তাবটি শুনে মিনা বেগমের বেশ মায়া হলো। তার মনে হলো এই নারীর জন্য কিছু একটা করা উচিত, যদিও সে বুঝতে পারে না রিতা কি ওর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা শিশুর দায়িত্ব নিতে পারবে কি না। আবার মনে হলো ওই শিশুর দেখাশোনা করলে সংসারে আয়ও তো কিছুটা বাড়তে পারে। তার এত সব চিন্তাভাবনার মধ্যখানেই প্রস্তাব দেওয়া নারীটি আবারও বলে উঠল—
‘তা টুটুলের মা, কুনু কথা কও না কেন? হ বুজছি, তোমাগো দিয়ে কুনু উপকার হবি বলি মনে হচ্ছি না।’
‘কি যে কও না? তা হুনো, আমি রিতার লগে কথা কমুনে আর দুই একের মদ্ধি তোমাগোরে জানামুনে কলাম।’
ঘরে ফিরে মিনা বেগম রিতার সঙ্গে আলাপ করে। সবদিক বিবেচনার পর মিনা বেগম আর রিতা—দুজনেই তাদের বস্তির ওই নারীর সন্তানের দেখাশোনা করতে রাজি হয়ে যায়। তাদের এই কার্যক্রম যে শুধু সহবস্তিবাসীকে সাহায্য করে তা নয়; বরং মিনা বেগমের পরিবারের আয়ও কিছুটা হলেও বাড়ায়।
মিনা বেগম আজ বুঝতে পারে দুঃখ-কষ্টের মহাসাগরের মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে একে অপরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় আর নেই। বস্তির জীবন তার বা তার পরিবারের কাছে কখনোই সহজ ছিল না, বিশেষ করে রহমত মিয়ার মৃত্যুর পরের দিনগুলোয়। তারপরও সে যে তিন সন্তান নিয়ে এখনো টিকে আছে, তা নিয়ে তার নিজেরই মাঝেমধ্যে বিশ্বাস হতে চায় না।
পরের বছর শীতের সময়। এবারে কেন জানি শীতটা বেশ জেঁকে বসেছে। গত চার থেকে পাঁচ দিন হলো আকাশে সূর্যের কোনো দেখা নেই। আর সেই সঙ্গে ঘরে-বাইরে সবখানে বইছে হাড়কাঁপানো হিমেল হাওয়া। শীতের প্রকোপ একটু কমতেই শহরজুড়ে দেখা দিয়েছে শীতজনিত নানান রোগবালাই। নিস্তার পায়নি মিনা বেগমের কোলের সন্তানটিও। গত দুই দিন হলো তার গায়ে হঠাৎ হঠাৎ ভীষণ জ্বর আসছে, সেই সঙ্গে খুব দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে, ঠিক যেন হাপরের মতো বুকের ওঠানামা আর ভয়ানক কাশির দম। প্রথমে মিনা বেগম ভেবেছিল সাধারণ জ্বর-কাশি। কিন্তু ভাবগতিক ভালো না দেখে মোড়ের ওষুধের দোকানে গেলে তারা পরামর্শ দেয় তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে মিনা বেগম দেখে রোগীর লম্বা লাইন। কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষার পর অবশেষে তাদের সুযোগ এল ডাক্তার দেখানোর। রোগীর প্রাথমিক পরীক্ষার পর গম্ভীর মুখে ডাক্তার আপা জানালেন, রোগীর অবস্থা বেশ জটিল। পরামর্শ দিলেন শিশুটিকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ভর্তি করতে। তার অবস্থা এই ভালো তো এই খারাপ। রিতা তো ছোট ভাইয়ের জন্য সারাক্ষণ কেঁদে-কেটে একেবারে অস্থির। আর টুটুল তার গ্যারেজের সব কাজ বাদ দিয়ে রিতাকে সঙ্গী করে সারা দিনরাত হাসপাতালেই থাকে। এখানে ভর্তির কয়েক দিনের মধ্যেই চিকিৎসকদের সব চেষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সর্বনাশা নিউমোনিয়া শিশুটিকে মিনা বেগমের কোল থেকে একপ্রকার জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
সদ্য সন্তানহারা মিনা বেগম এখন জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত এক সৈনিক। তার দুর্বল কাঁধ কি বইতে পারে সন্তানের প্রাণহীন দেহ, সেই ক্ষমতা কি সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন কোনো মা-বাবাকে! মিনা বেগম বিড়বিড় করে বলতে থাকে-
‘হায় রে নিষ্ঠুর দুনিয়া, কত কষ্ট আর আমাগোরে দিবি।...ছিলাম গ্রামে, ভালোই ছিলাম। ভিটে-মাটি-জমি-জিরাত সবই তুই গিলে খালি।...পোলাপানের বাপডারে তুই তুলি নিলি।...আর কোলের নেদা ছাওয়ালডারেও ছাড়লি নে।...তোর জ্বালায় আর তো পারি নে। ...আমারে কি তুই চোহে দেহোস না রে।…’
চলবে ....