উদ্বাস্তুর ইতিকথা: প্রথম পর্ব
অনেক আন্দোলন, রক্তক্ষয়, জীবন, আর ত্যাগ–তিতিক্ষার মাধ্যমে অবশেষে অবসান হলো স্বৈরাচারী সামরিক শাসনের। আকাশে বাতাসে মুক্তির অনাবিল আনন্দ। সারা দেশের আনাচে কানাচে নির্বাচন ছাড়া অন্য কথা নেই। নেতা-নেত্রী, রাজনৈতিক কর্মী, সাধারণ জনগণ—সবাই ভীষণ ভীষণ ব্যস্ত। কিন্তু এরই মধ্যে রহমত মিয়া এবং তার পরিবার নিজেদের দেখতে পেল ভিন্ন এক সংগ্রামের মধ্যে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও জড়িয়ে পড়তে হলো আরেক ভয়াবহ সংগ্রামে!
রহমত মিয়া আর তার পরিবার বসবাস করত এক প্রমত্ত খরস্রোতা নদীর পারঘেঁষা গ্রামে। এ নদী গ্রামবাসীর জীবনে একদিকে আশীর্বাদ আর অন্যদিকে অভিশাপ ছিল। প্রায় প্রতি বছরই নদীটি বন্যায় প্লাবিত হতো, উর্বর করত মাটি, ফলত প্রচুর ফসল। শুধু কি তাই, নদীতে মিলত প্রচুর মাছও। কিন্তু বর্ষার মাসগুলোতে গ্রামবাসীরা সব সময়েই ভয়ে থাকত, কখন নদীর ভাঙনে ফসলি জমি বা বসতবাড়ি নদীর গহ্বরে চলে যায়।
এবারের বর্ষা কালে, রহমত মিয়ারা প্রত্যক্ষ করল এক ভয়াবহ স্মরণকালের অতীত বন্যা। গ্রামবাসীরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, ‘এবারে মতন সর্বনাশা বান কেউ কি জীবনেও দেখছুনি?’ গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক লোকটিও কোনো জবাব না দিয়ে দুদিকে মাথা হেলিয়ে না সূচক অভিব্যক্তি প্রকাশ করল।
এদিকে চিরচেনা নদীটি তার স্বাভাবিক সীমানা ছাড়িয়ে স্ফীত হয়ে প্রবল আক্রোশে চারিদিক প্লাবিত করে চলেছে। গ্রামবাসীর নিত্যসঙ্গী চিরচেনা নদীটি আজ যেমন দুর্বোধ্য আর তেমনি অপ্রতিরোধ্য।
বন্যার পানি ক্রমেই বেড়েই চলেছে আর সামনে যা পাচ্ছে সমস্ত কিছুকে গিলে ফেলছে। বাড়িঘর যেন বালি দিয়ে গড়া—নিমিষে ভেঙে পড়ছে আর ফসলি জমি হারিয়ে যাচ্ছে নদীর বুকে। রহমত মিয়ার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল, হয়তো তাদের বসতভিটাটা বন্যা যতই হোক না কেন ঠিকই মাথা উঁচু করে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাবে।
কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! বন্যার পানি কাউকে কোনো করুণা দেখায়নি, এমনকি গ্রামের সব চেয়ে উঁচু স্থানেও পৌঁছেছে। রহমত মিয়ার বাড়ি, যার উঠানও কখনোই বৃষ্টির পানিতে ডুবে না, তা–ও বন্যায় ধ্বংস হয়ে গেছে। যখন বন্যার পানি তাদের বসতবাড়িকে গ্রাস করেছে, তখন সে অবিশ্বাসের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল আর ভাবছিল, ‘হায়রে নদী, আমার কয় পুরুষ তোর পারে জীবন কাটাইছে আর সেই তুই কিনা চোক্ষের পলক ফেলতি পারবার আগেই আমার থাকবার ঘরবাড়ি গিলে ফেললি!’
ভিটামাটি জমিজিরাত হারিয়ে রহমত মিয়া আজ নিঃস্ব, তার চোখেমুখে হতাশার তীব্র ছাপ। একই রকম হতাশা রহমত মিয়া তার গ্রামের সব মানুষের মধ্যেও দেখতে পেল। এইতো সেদিনের ছায়া শ্যামলসবুজেঘেরা শান্তির গ্রামখানি চোখের পলকে হারিয়ে গেল নদীর অন্ধকার গহ্বরে। ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে ওরা নিজের দেশেই কিনা উদ্বাস্তু হয়ে গেল!
তাই বলে কি জীবন থেমে যাবে? রহমত মিয়া তার স্ত্রী আর তিন সন্তানসহ উদ্বাস্তুদের ভিড়ে মিশে হাজির হলো তিলোত্তমা রাজধানীতে। রাজধানীর ব্যস্ত রাস্তাঘাট, যানবাহনের কোলাহল, উঁচু উঁচু দালান-কোটা দেখে ওরা ভাবে, ওদের গ্রামের জীবনটা কতটা সহজ সরল ছিল, আর মনের অজান্তেই দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। ওদের স্থান হলো এক বস্তিতে। রহমত মিয়া মনে মনে কাজ খুঁজতে থাকে, কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না, সে কি কাজ করতে পারবে। তারই বয়সী আরেক বস্তিবাসী এক সকালে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে কলের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল—
‘তা, রহমত মিয়া কী করবা বইল্লা ভাবতাছো? ঝিম মাইরা বয়া থাকলি কি পেট চলব?’
চোখের পানি মুছতে মুছতে রহমত মিয়া ক্ষীণ কণ্ঠে বলল—
‘তা ভাইরে, কি করুম, মাঠঘাটের কাম ছাড়া তো কিছু জানতাম না। এ কাম তো শহরে নাইক্কা।’
‘হ বুঝছি! তা তুমি মিয়া তো আমার লাহান রিকশা চালাইবার পার।’
অবশেষে কোনোরকম উপায়ান্তর না দেখে রহমত মিয়া রিকশার হাতলে হাত রাখতে বাধ্য হলো। আর অন্যদিকে তার স্ত্রী মিনা বেগম প্রথম প্রথম বস্তির অন্য বউঝিদের সঙ্গে মিশতে বা কথা বলতে বেশ সংকোচ বোধ করত। কিন্তু স্বামীর উপার্জনে যখন সংসারের খরচাপাতি ঠিক মতো ওঠে না, তখন এক প্রকার বাধ্য হয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন পাশের ঘরের বউকে জিজ্ঞাসা করল—
‘হেগা, তোমারে তো পেত্যেক দিন সকাল বেলায় দেহি চলি যাও আর সেই বিয়ান বেলায় ফিরি আসো। তা তুমি কই যাও?’
‘আর কইও না বুন। কামে যাই।’
খানিকটা হাত কচলিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে মিনা বেগম বলল—
‘তা আমারে এড্ডু কইবা তুমি কুনখানে কাম করো?’
‘কেন কমু না কেন? আমি পেত্যেক দিন তিন ফ্ল্যাটে ছুটা বুয়ার কাম করি।’
‘তা আমারে একটা কামের খোঁজ দিবার পারবা নি?.... পোলাপানের বাপের টাহায় আমাগো সংসার যে চলতি চায় না।’
‘হুনো মিনা বু, আমারে কেউ কামের কথা বললি তোমারে কব। বেশি চিন্তা করবা না কিন্তুক কয়ে দিলাম।’
কিছুদিন হলো মিনা বেগম দুটো গৃহকর্মীর কাজ পেয়েছে। সংসারে আগের চাইতে একটু স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে কোলের আড়াই বছরের বাচ্চাটাকে নিয়ে। একমাত্র ওর পিঠাপিঠি বড় বোন রিতা ছাড়া আর কারও কাছে ওকে রাখা যায় না, শুধু কান্নাকাটি করে। আর রিতা? কতই বা বয়স ওর, গ্রামের স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত, ওর শুধু মন চায় স্কুলে যেতে আর সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলা করতে। পরিবারের সবচেয়ে বড় সন্তান টুটুল পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি নিয়ে মাধ্যমিক স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে যেত, ওকে নিয়ে শুধু কি রহমত মিয়া আর মিনা বেগমের, সারা গ্রামবাসীর গর্বেরও অন্ত ছিল না। আর সেই ছেলেটিই সারা দিন ঝিম মেরে ঘরের কোণে বসে থাকে, কারও সঙ্গেই কোনো কথা বলতে বা সমবয়সীদের সঙ্গে খেলতেও চায় না। টুটুল মুখে কিছু না বললেও রহমত মিয়া আর মিনা বেগম ঠিকই বুঝতে পারে, টুটুল স্কুলে যেতে পারছে না বলে ওর কিছুই ভাল লাগে না। আর তাই স্বামী-স্ত্রী উভয়েই ভাবে, আয়-উপার্জন আর একটু বাড়লেই টুটুল আর রিতাকে আবারও স্কুলে পাঠাতে পারবে।
কয়েক মাস পরের কথা। রহমত মিয়া যাত্রী নিয়ে শহরের অতি ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিল। সকালে বস্তি থেকে বের হবার সময় তার শরীরটা একটু গরম ছিল। কিন্তু তাতে কি এসে যায়? তার মতো কপালপোড়া মানুষের কি বিশ্রাম করার উপায় আছে? যাত্রী তাকে তাগাদা দেয়, ‘এই রিকশাওয়ালা, একটু তাড়াতাড়ি চালাও না, ভাই আমার ব্যাংকে জরুরি কাজ আছে।’ যাত্রীর এ ধরনের তাগাদা রহমত মিয়াকে প্রায়ই শুনতে হয়। অন্য দিন সে কিছু একটা বলে। কিন্তু আজ শরীরটা ভাল না থাকায় কোন উত্তর করতে তার ইচ্ছা করে না। এরই মধ্যে একটি ট্রাক তার রিকশার পিছনে সজোরে ধাক্কা দেয়। যাত্রী রিকশা থেকে ছিটকে ফুটপাতে গিয়ে পড়ে, রিকশাটি দুমড়ে মুচড়ে যায় আর রহমত মিয়া? সে গুরুতরভাবে আহত হয়।
দুর্ঘটনাটি কেবল রিকশাটিকেই পিষে দেয়নি তা নয়, রহমত মিয়ার পরিবারের অর্থনৈতিক ভঙ্গুর অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রামকে যেন বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে।
রহমত মিয়ার দুর্ঘটনার খবর বেশ দ্রুততার সঙ্গেই মিনা বেগমের কাছে পৌঁছে গেল। সে তিন সন্তান নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতালে এল। দেখতে পেল রহমত আলী হাসপাতালের জরুরি বিভাগের বিছানায় অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। তার চিকিৎসা চলতে থাকে, কিন্তু রহমত মিয়ার অবস্থার তেমন কোন উন্নতি দেখা যায় না। এরই মাঝে কয়েক সপ্তাহ কেটে যায় আর রহমত মিয়ার অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে থাকে। অন্যদিকে, রহমত মিয়ার উপার্জন ছাড়া তার পরিবারটির আর্থিক অবস্থা ক্রমেই খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়ে পড়ে। অবশেষে এক ভীষণ বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় রহমত মিয়া মিনা বেগমের দুর্বল কাঁধে সংসারের সমস্ত দায়দায়িত্ব দিয়ে অজানার উদেশে অনেকটা নির্লজ্জের মতো পৃথিবীর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করল। মিনা বেগমের চোখে পানি বা কণ্ঠে বিলাপ কোনটারই দেখতে পাওয়া গেল না, সে যেন পাথরের এক নির্বাক মূর্তি!
চলবে....