বীথি: পর্ব ১৮
বিথী,
১৯৯৬ সাল। মনে পড়ে, আমি তোদের সবাইকে রেখে, সেই কলাবাগানের খোলা ছাদের বাড়ি রেখে, ধানমন্ডি স্কুলের বিশাল মাঠ আর ঢাকার জমজমাট পরিবেশ ছেড়ে চলে এলাম সাভারে পিএটিসির শূন্য হাহাকার পরিবেশে। তখনো সেটা বিপিএটিসি হয়নি।
মাত্র গুটিকয় পরিবারের সঙ্গে আমরাও; বিপিএটিসি তখন সত্যিকার অর্থেই বিরানভূমি। দশম শ্রেণিতে পড়ি। জাহাঙ্গীরনগর স্কুল/কলেজে ভর্তি হওয়ার আগেই জেনেছিলাম, ঢাকার প্রথম দশটা স্কুল–কলেজের ভেতর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজ সেরা একটা।
মনে আছে তোর? তোর বড় ভাই দুলু ভাই বলেছিল, ‘লুনা তো ওই স্কুল/কলেজে চান্স পাবে না, ওটা অনেক ভালো স্কুল।’
দুলু ভাই একটুও ভুল বলেনি। যা হওয়ার তা–ই হলো। আমি দশম শ্রেণির অর্ধবার্ষিক, প্রিটেস্ট আর টেস্ট—তিনটা পরীক্ষাতেই প্রথম বছর ও পরের বছর, মানে আরও একবার দশম শ্রেণিতে ড্রপ দিয়ে মোট ৬টা অঙ্ক পরীক্ষায় একবার ১৫ নম্বরের বেশি পেলাম না। আমাকে নিয়ে স্কুল মহা ঝামেলায় পড়ে গেল।
কী করে আমি এসএসসি ফাইনালে বসব?
আজকের এই চল্লিশোর্ধ্ব জীবনে সবচেয়ে বিপদের দিনে, নিজের ফেলে আসা বিপদের দিনগুলোর কথা ভেবে নিজেকে শান্ত রাখি। নিজেকে বলি, নিশ্চয়ই বিপদে পথ বের হবে। নইলে আমি বা মানুষ টিকে আছে কী করে?
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo. com
আজও অনেক অনেক বিপদ পাড়ি দিচ্ছি, তাই সেই সব দিনের কথা মনে পড়ছে ভীষণ। তারপর শোন, অঙ্ক নিয়ে তো তোলপাড় শুরু হলো। কোনো শিক্ষক যদি আমার অঙ্কের দায়িত্ব নিয়ে, আমার হয়ে স্কুলকে গ্যারান্টি লিখে না দেন, তাহলে আর আমার এসএসসি ফাইনালে বসা হবে না।
সে সময় আমাদের স্কুলে দুজন সামসুদ্দিন স্যার ছিলেন, দুজনই অঙ্কের পণ্ডিত। একজন কবি মো. রফিকের বাবা, যাঁকে প্রিন্সিপাল স্যার বলা হতো। অন্যজন সামসুদ্দিন স্যার, ময়মনসিংহে বাড়ি। এই স্যার আমাকে চেনেন না। জানেনও না। একবারেই না। কিন্তু কী কারণে সেদিন তিনি আমার জন্য লিখিত দিয়েছিলেন, এই ৩০ বছরে সেটা জানা হলো না।
এই স্যার বদলে দিলেন আমার জীবনের অঙ্ক। শেষমেশ এসএসসি পরীক্ষায় ৭৬ পেয়ে পাস করলাম। কিন্তু স্যার বাকি জীবনের জন্য আমাকে বলে গেলেন, কেবল চেষ্টা দিয়ে মানুষ যেতে পারে বহুদূর।
জানিস, আজ সারা দিন স্যারকে ভেবেছি। প্রিন্সিপাল স্যার মানে কবি মো. রফিকের বাবা বলেছিলেন, ‘তুই কোনো দিন অঙ্কে পাস করবি না।’
আর সামসুদ্দিন স্যারকে সে কথা বলতেই তিনি বিনয়ের সঙ্গে খাস নেত্রকোনার ভাষায় বললেন, ‘যে ছাত্র ৭০ পায়, তারে ৮০ পাওয়ানো সোজা; কিন্ত যে ২০ পায়, তারে ৫০ পাওয়ানোর কাজ কেউ লইতে চায় না। যে মাথায় ত্যাল আছে, সেইখানে ত্যালের কাম কী? তুই পড়, তোরে আমি অঙ্কে পাস দিয়া দিমুনে।’
কোথায় আছেন সেই যুগজয়ী স্যার? মানুষ চলে গেলে কি ভালোবাসার ডাক শুনতে পায়?
বীথি, আজ সারা দিন ভেবেছি, আমার বিপদ নিশ্চয়ই একদিন কেটে যাবে। পথ খুঁজে পাব, পেতেই হবে। কিন্তু সময়কে যে কখনো কখনো স্থির মনে হয় রে! কী করি বল তো? কিছু ভালো লাগছে না জানিস, মনে হচ্ছে আর কতটুকু হাঁটলে একটু আলো পাব?
এমন অনেক অনেক দিনরাত্রি পার করেছি বীথি, মনে হয় দিন বুঝি আর সামনে এগোবে না।
কোনোকালেই জীবন খুব সরলভাবে এগোয়নি। সেই জীবন আমার নয়, অনেকেরই নয়। গত তিন দিন হলো, এই শহরে গাড়ির ইনস্যুরেন্স খুঁজছি। এই একটা দেশ আইন দিয়ে এমনভাবে বাঁধা আছে, যা কল্পনা করলেও অসহায় লাগে।
কানাডায় আইন মানে আইন। কোনো ডলার বা কোনো ক্ষমতা দিয়ে সেই আইনের ফাঁক গলানো যায় না। সবার জন্য এক আইন। এসব সময়েই নিজের দেশের কথা মনে পড়ে আর ভাবি, যদি কানাডায় আমি ফেল করতাম, স্যার কি বাঁচাতে পারতেন আমাকে?
শান্ত থেকেই পথ খুঁজতে হবে। তাহলে বিচলিত হচ্ছি কেন? একমাত্র চেষ্টাই আমাকে বাঁচাবে সেই দশম শ্রেণির মতো।
আদর, বীথি।