বীথি: পর্ব ২০
কয়েক দিন আগে তোকে যে ইনেদের বাসার দুটি মাছের কথা বলেছিলাম, মনে আছে? লম্বা নীল ঝালরওয়ালা মাছ?
এই এক মিনিট আগেই মাছ দুটি দেখছিলাম। কী যেন ভাবতে ভাবতে আবার গিয়ে দাঁড়ালাম জানালার সামনে। বিকাল সাতটা, ইনেদ এখনো আসেনি, সাগা গেছে মুভি দেখতে। আমি বাসায় একা। কী করব বল।
ইফতার হতে আরও দুই ঘণ্টা বাকি। এই টরন্টো শহরে এখন লম্বা বিকাল, ইফতারের সময় সেই রাত নয়টায়।
নিজের জীবনের কথা ভাবলে নিজের কাছেই হাসি লাগে। ভাবি, এই হাসিই কি কাল হলো? বলেছি তোকে বহুবার, আমরা একটা ভরা পরিবারে বড় হয়েছি। সে কারণেই হয়তো আজন্ম নিজের একান্ত জগৎ খুঁজতাম। যত বড় হয়েছি, তত এ স্বভাব যেন নিজের ভেতরে বেশি করে টের পেয়েছি।
ছোট ঘটনা—তখন ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। কলাবাগানে একটা চার বেডরুমের বাসায় থাকতাম। মামা–খালা মিলিয়েই বাসাটা ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। একদম কোনার ঘরটা ছিল মিলন মামার। মামা প্রায়ই নানার বাসা রংপুরে যেতেন। একবার মামা বেশ কয়েক মাসের জন্য বেড়াতে যাওয়ার পরে আমি মামার ঘরে গিয়ে উঠি, বই–খাতা, জামাকাপড় সব নিয়ে। ওই ঘরে দরজা লাগিয়ে বসে থাকতাম। যেন এটাই আমার জগৎ। মহাবিরক্ত হয়ে আম্মা বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন, জানালা দিয়ে ভাত খেতে দিলেন। কয়েক দিন পর আম্মার প্রচণ্ড বকা আর মার খেয়ে সেই ভূত মাথা থেকে নামল।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo. com
এবার আসি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ের কথায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। সবার নামে হলে রুম বরাদ্দ থাকে। তবে যাদের ঢাকায় বাসা থাকে, তারা সাধারণত হলে থাকে না। কিন্তু আমি তো হলে থাকার জন্য পাগলপারা। হলের ভেতরে নিজের সংসার গুছিয়ে বসেছি। আমার যেকোনো মেয়েবন্ধু, যারা আমার ‘হোস্টেল জীবন’ কাছে থেকে দেখেছে, তারা কেউ যদি আজকের এই লেখা পড়ে, কেবল তারাই জানবে যে নিজের গোছানো ঘরের প্রতি কী প্রবল টান ছিল আমার।
মেয়েদের আবাসিক ঘরে রান্না করতাম নিজেই। কোনো দিন ডাইনিংয়ে খেতাম না, কোনো দিন না।
আমার ঘরের ফ্লোর ফিনাইল দিয়ে মুছতাম। সারাক্ষণ ভাবতাম, কবে নিরিবিলিতে আমার একটা ঘর হবে, সংসার হবে। হায়রে মানুষ—ওই যে শুরুতে বলছিলাম ইনেদের বাসার কথা, একটু নিরিবিলি থাকার কথা, আজকে আমার জীবনজুড়ে পরম করুণাময় এত বেশি নীরবতা আর একাকিত্ব দিয়েছেন যে সেই ভার সইবার ক্ষমতা নিজেই হারিয়ে ফেলেছি। এই বয়সে এখন খুঁজে ফিরি, কে একটু কথা বলবে, কে একটু আন্তরিক সময় দেবে। বীথি, ইফতারের আর মাত্র ছয় মিনিট বাকি আছে। আবার ফিরে লিখছি তোকে, কেমন!
মাত্র ২৫ মিনিটে ইফতার। নামাজ সেরে আবার বসলাম। ইনেদের এই মাস্টার বেডরুমটা ক্রমেই প্রিয় হয়ে উঠছে। খুব তাড়াতাড়ি যা ছেড়ে যেতে হবে, তা–ই বুঝি জীবনের সব ভালোবাসার জায়গা দখল করে রাখে।
যদিও ঘটনাটা আমাদের অজান্তেই ঘটে; কিন্তু সেই ক্ষত বয়ে বেড়াই আমরা জীবনভর। গত বছর এই সামারে আমি ছিলাম মনিকা পারকিনসন্সের বাসায়। ৭৪ বছর বয়সী মনিকার বাসা আমার অফিস থেকে হাঁটাপথেই মাত্র সাত মিনিট। কী অসীম ভালোবাসায় আর আনন্দে গত বছর মনিকার বাসায় ছিলাম। অথচ মাত্র এক মাস ক্যানসারে ভুগে মনিকা চলে গেল পরপারে।
গোটা বাড়িতে তিনজন মানুষ ছিলাম আমরা। মনিকা, আমি আর বিড়াল লাকী। একদিকে টেবিলে রাখা মনিকার বাইবেল, তার পাশেই রাখা ছিল আমার তসবিহ আর জায়নামাজ। আমি নামাজ পড়ি, একটু দূরে মনিকা বসে বাইবেল নিয়ে।
জীবন কী অপার আর অসীম। সবার জন্য জীবনযাপনের পথ খোলা বীথি। তোর আল্লাহ বল, ভগবান বল, জিসাস বল, সবকিছুর মূলে হচ্ছে বিশ্বাস ও ভালোবাসা। তোর উদ্দেশ্য যদি ঠিক থাকে, তাহলে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন হবেই, সুনার অর লেটার। কিন্তু আমরা খুব তাড়া করি এক জীবনে, তাই বুঝি কোনো কিছুর নির্যাস ভোগ করতে পারি না কেউ–ই। আমরা বলতেই থাকি—এখনই চাই, আমার এখনই চাই, এই মুহূর্তে চাই। লোভ আর তাড়া আমাদের জীবন বইয়ে দেয়। আমাদের টেনে নিয়ে যায় অন্ধকারের দিকে। আমরা ভাবি আলো, কিন্তু আসলে আলেয়া।
বীথি, কাল ফিরব নিজের বাসায়। আমার নিজের ভুবনে। যেখানে ফেরার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে আমার প্রাণ। আদর। চলবে...