বীথি: পর্ব ১৯
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo. com
বীথি,
আফিস শেষ হয় ৪টা ৩০ মিনিটে।
ঘড়ির কাঁটা ধরে পরপর দুই বাস বদলে যখন ইনেদের বাসায় ঢুকি, তখন বিকেল ৫টা ৩ মিনিট। গত চার সপ্তাহে এর কোনো বদল হয়নি, কোথাও বাস দেরি করেনি, কোথাও দুই মিনিট দেরি হয়নি, বাসযাত্রীরা এক, চালক এক, যেন ঘড়ি ধরে একটা দেশ চলছে। ১০ বছর ধরেই ভাবছি, হয়তো যত দিন থাকব, ভাবতেই থাকব কী করে এটা হয়?
ভাবনার জালজুড়ে যেহেতু নিজের দেশ আছন্ন করে রাখে, তাই হয়তো বাকি জীবনে আর কোনো দিন এই ভাবনার প্যাটার্ন থেকে বেরোতে পারব না। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ইরানি সহকর্মী নিসারের কথা। কাজের সুত্রেই ওর সঙ্গে পরিচয়, খুব মিশুক মানুষ বলেই বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি।
সে–ও প্রায় ছয় বছর আগের কথা। আমার বাসায় ওর বান্ধবী নিয়ে বেড়াতে এসেছিল। আমাকে বলে, আমি বুঝি না লুনা, তুমি কাজ করছ কানাডায়, থাকছ কানাডায়, কিন্তু প্রিয় মানুষ খুঁজছ বাংলাদেশে। আবার বলছ বাংলায় কথা বলতে হবে, কেন? ইংলিশে কথা বললে প্রেম করা যায় না? তাহলে অফিস করো কী করে?
অনেক তর্কের পরে আমি নিসারের কাছে হাতজোড় করে বলি, এটা আমার লিমিটেশন। প্লিজ, আর কিছু বোলো না। ঠিক তেমনি বীথি, এই দেশে যখন চলাফেরা করি, জীবন যাপন করি, বছরের পর বছর থাকি, আমি কিন্তু পরিষ্কার জানি এবং মানি যে এটা কানাডা। এই দেশের কোনো কিছুর সঙ্গেই বাংলাদেশের তুলনা চলে না, চলা উচিত নয়, কখনোই চলবে না, চলতে পারে না। কিন্তু তবু আমাকে দ্যাখ, আমার মতো লাখো প্রবাসীকে দ্যাখ, সবাই এক ধ্যানে জীবন পার করছে—ওই একটাই শব্দ বুকে বহন করি—বাংলাদেশ।
ওখানেই সব তুলনা, ওখানেই সব ক্ষোভ, ওখানেই সব প্রতারণা, ওখানেই সব অভিযোগ, ওখানেই শেষ অবধি সব ভালোবাসার আকর। কী করে পার করব এই দূরত্ব? গতকাল সোমবার ভোরে নিজের বাসার সামনে থেকে যে বাস ধরি, সেখানে মিট করি গায়ানিজ নারী রোলার সঙ্গে। মধ্যবয়স্ক, কিন্তু সেদিন উচ্ছল বালিকার মতো নেচে উঠল, বলে, ‘আমি ব্যাক হোমে যাচ্ছি।’
এই বাসার মালকিন, বন্ধু ইনেদ যাচ্ছে ত্রিনিদাদে, ওর ব্যাক হোমে, সামনের সপ্তাহে, ইনেদ নিজেও খুশিতে আত্মহারা। অথচ ইনেদ এই দেশে আছে প্রায় ৩৫ বছর, কিন্তু ওই যে শিকড় ফেলে এসছে নিজের দেশে, এর শেষ কোথায়?
সারা জীবন আব্বাকে দেখেছি, কয়েক মাস পরেই বলতেন, বাড়ি যাব, মানে কী? ঢাকায় বাবা আমাদের নিয়ে যে বাসায় থাকেন, সেটা বাড়ি না?
এই পড়ন্ত বিকেলে বসে তোকে লিখতে গিয়ে বারবার চোখ মুছি বীথি, কোথায় আমার বাড়ি? সেই মাগুরা জেলার বরিশাট গ্রামে, সেখানে আমার চাচা–ফুফুরা থাকেন, সেটা আমার বাড়ি? আমি যদি কোনো দিন সব ফেলে দিয়ে সেখানে চলে যাই, গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশে থাকব বলে মনস্থির করি, কেউ কি বাধা দিতে পারবে?
ছোটবেলায় আমরা ছিলাম নানাবাড়িতে, আমি জন্ম হওয়ার পরে নাকি আম্মা নানাকে বলেছিল, ‘এই পাগল মেয়ে আপনি মানুষ করবেন।’ নানা কথা রেখেছিলেন। নানা–নানি দুজনই আমাকে সবচেয়ে বেশি আদর করতেন।
যদি ফিরে যাই সেখানে? সেই রংপুরের রবার্টসগঞ্জ এলাকায়? আমার দুরন্ত শৈশব যেখানে ফেলে এসেছি। সেই প্রথম আমবাগান, সেই স্কুলমাঠ, মেয়ে হয়ে ওঠার দুরন্ত স্বপ্ন যেখানে বপন করা আছে, নানাবাড়ির বিশাল একতালা বাড়িতে যদি ফিরে যাই? কে বাধা দেবে, বীথি? ছোট মামা এখোনো আছেন সেখানে, জানি মামা বুকে করে রাখবেন।
গ্রামের মানুষের সুখ–দুঃখের সঙ্গে কাজ করার মানসিক গড়ন সেই ছোটবেলা থেকেই; সেই শিক্ষার ওপরে ভর করেই আজও বেতন পাচ্ছি, ভয় কিসের বল? জীবনে কী নিয়ে ভয় করব? ভয় করব কিসের জন্য?
ভালোবাসা হারানোর ভয় ছাড়া তো হারানোর আর কিচ্ছু দেখি না, বীথি। দূরত্ব ভীষণ কষ্টের, সারাক্ষণ ফিরে ফিরে অতীত দেখা ভীষণ রকম যন্ত্রণার, কিন্তু বেঁচে থাকার দায়ে মানুষ বেছে নেয় কত কত পথ, আমার পথও তেমনি অনেক পথের একটা, রাতের অন্ধকারে স্মৃতি হাতড়ে ফেরা এক জীবন আমাদের। আদর। চলবে...