বীথি: পর্ব-১৬
বীথি,
প্রায়সময় এমন হয় যে তোকে লিখতে বসার আগে দুই-তিন বা চার-পাঁচ রকম ঘটনা মাথার ভেতরে দোল খেতে থাকে।
কথাগুলো, ঘটনাগুলো, তোর কাছে একান্তে লেখার বিষয়গুলো সাজাতে থাকি আর নিজের মনের সঙ্গেই কথা বলতে থাকি। ভাবি, কী লিখব? কতটুকু লিখব, লেখা কি ঠিক হবে? লেখা কি উচিত? কী হবে লিখে? এসব ভাবনা।
আবার ভাবি, লিখলে ক্ষতি কী? কেন লিখব না? আমি তো বলেইছি, কথা বলার জায়গাটা আমার একান্ত নিজের। তবু যখন খুব অপরিচিত কেউ বা খুব ব্যস্ত কেউ, ফোন ধরেই বলে, ‘কী ব্যাপার লুনা, তোমার বীথির খবর কী? তোমার মন ভালো তো?’ আমি তখন নিজের ভেতরই একটু নড়ে বসি। ভাবি, আরে এই মানুষও আমার লেখা পড়ে? আমার কথা মন দিয়ে শোনে? তখন নিজের দায়িত্ব বেড়ে যায়। ভাবি, তাহলে কি লেখার সময় আরও সাবধান হওয়া দরকার?
অনেক দিন আগে বীথি, সেই ১৯৮৪-৮৫ সাল হবে। আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি, থাকি সাভারে বিপিএটিসিতে। মোহাম্মদ সাদিক নামে এক নতুন বিসিএস কর্মচারী ফাউন্ডেশন কোর্সে এসেছিলেন। সে সময়, আমরা তাঁকে সাদিক মামা বলে ডাকতাম। তিনি আবার কবি ছিলেন। সে সময় তিনি পিএটিসির সেই নতুন ক্যাম্পাসে কবিতা পাঠের আয়োজন করেছিলেন। এসেছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ।
কী কারণে জানি না, আমাদের মানে দর্শকের জন্য প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল। আমি কবি গুণকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি কি কবিতায় মনের সব কথা বলতে পারেন?
উত্তরে লিখেছিলেন গুণ, ‘না কিছুই বলতে পারি না, একবারেই না। যা বলতে চাই, তার ঠিক বিপরীত কথাগুলো কবিতায় লিখি।’ জানিস বীথি, আজ প্রায় ৩০ বছর ধরে কথাটা ভীষণ টানে। নিজে লিখছি, তা–ও ৩০ বছর হয়ে গেছে।
কত রাখ লাখবার যে কথাটা মনে হয়েছে। আসলেই তা–ই, যা তোকে বলতে চাই, তা কি বলি কখনোই? কেউ কি আমরা বলি কাউকে? কেন বলতে পারি না? কিসের পিছুটান? এই তো জীবন, ফুরিয়েই তো যাবে একদিন, তবু খুলে মেলে ধরতে পারি না নিজেকে, কিন্তু কেন?
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
গতকাল ছেলেকে আমেরিকার উড়োজাহাজে তুলে দিয়ে এলাম, কানাডার সীমান্তের কাছেই বাফেলো বিমানবন্দরে।
আজ এই মুহূর্তে যেমন সকাল সাড়ে নয়টা, তেমনি গতকাল এই মুহূর্তে নাইয়া ছিল আমার পাশের সিটে। আমি অবাক হয়ে আমারই সন্তানকে দেখে বারবার ভাবছিলাম, এ–ই কি সেই আশ্রয়, যাকে ধরে আমি বেঁচে আছি? বা আমি যাকে নিয়ে ভাবি, এই জীবন কেটে যাবে? আসলেই কি তা–ই ? কারও কি কাটে ? নাকি নিজের জীবন নিজেকেই কাটাতে হয়?
একটা অদ্ভুত কথা কি, এসব দেশে, মানে আমেরিকা /কানাডায় শিশুরা ভিন্নভাবে চিন্তা করতে শেখে। বাসের দুলুনিতে নাইয়াকে দেখলাম ঘাড় কাত করে ঘুমাচ্ছে। আমি ওর মাথাটা আমার ঘাড়ের কাছে নিতেই ও বলল, ‘তুমি আমাকে জাগিয়ে দিলে কেন?’ আমি বলি, তুমি আরাম করে ঘুমাও। ও বলে, ‘না মা, আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম, তুমি আমাকে বিরক্ত করে ঘুম ভাঙালে কেন?’
বীথি, এটা কিন্তু সবখানেই। আমার সঙ্গে নাইয়ার ফারাক, আমি যেটা ভালোবেসে করি, তার অনেক কিছুই ওর জন্য কাম্য নয়। সেটা যে খারাপ, তা কিন্তু বলছি না; কিন্তু এটাই ও শেখে।
এখানে বিশেষ করে পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী সমাজ ওকে পই পই করে বলে দেয়, জীবনটা তোমার, তুমি জীবনটা উপভোগ করবে নিজের মতো করে। এই সমাজ ওকে এটাই শেখায় প্রতিমুহূর্তে। যা আমরা একজন্মে শিখি না, বলতে পারি না, বিশেষ করে আমরা বাংলাদেশের মেয়েরা জন্মই নিই হয়তো অন্য কারও জন্য।
এই যে আমি শূন্য বাড়িতে নাইয়াকে রেখে প্রতিদিন অফিসে যাই, আমার কাছে যা শুন্যতা মনে হয়, ওর কাছে এটা ভীষণ আনন্দের। কারণ, ও আমাকে নিয়তই বলতে থাকে, ‘আই নিড মাই ওউন টাইম।’
এর অর্থ কিন্তু এই নয় বীথি, আমার ছেলে খারাপ, ছেলে ফাঁকা সময় পেলে পড়াশোনা করবে না বা আমাকে আড়াল করে কোনো কিছু করবে, তা কিন্তু একেবারেই নয়। যেসব ভাবনা নিয়ে আমি বড় হয়েছি, তার অনেক কিছুই নাইয়ার ভেতর নেই। কারণ, ও একটা ভিন্ন সমাজ ও পরিবেশে বড় হচ্ছে। এই কয়েক দিন আগেই একবার বললাম, যাও বাবু, তোমার পড়াশোনা করতে হবে না, তুমি বইখাতা ফেলে দাও, আমিই তোমাকে দেখব, আমিই তোমাকে আজন্ম খাওয়াব /পরাব।
ছেলে সঙ্গে সঙ্গে খুশি হয়ে হয়ে গেল। আমরা দুজনই মেঝেতে শুয়ে ছিলাম। নাইয়া বলে, ‘আম্মু, আর ইউ সিরিয়াস?’ আমি বলি, হ্যাঁ বাবু, আমি সিরিয়াস।
আসলেই তা–ই বীথি। আমি ভাবি, কী হবে লেখাপড়া করে বড় হয়ে? তার চেয়ে আমার কাছে থাকুক, বাঁচার জন্য হলেও তো আমাকে আশ্রয় করবে? নাইয়া দেখি একটু উঠতে গিয়ে আবার শুয়ে পড়ল মেঝেতে। বলে, ‘নাহ আম্মু, আমাকে গুড এডুকেশন পেতেই হবে, আই নিড আ বেটার লাইফ।’
ভাবতে পারিস বীথি, মাত্র ১৪ বছরের ছেলে, বেটার লাইফ বুঝে গেছে আর আমার ৪৫ বছরেও জানা হলো না এই জীবন কি শুধুই আমার ভালোর জন্য? নাকি আমার আরও কিছু কাজ করার ছিল? আমি কি কেবলই নিজে ভালো থাকব নাকি কাউকে নিয়ে ভালো থাকব?
সেই অতি প্রাচীন নানি/দাদির মতো এখনো এই শূন্য ঘরে একা একা ঘুরতে ঘুরতে মনে হয়, কিসের ভালো থাকা? কিসের আনন্দ? কত দূরে প্রিয় দেশ, কত দূরে প্রিয় মানুষেরা, এর নাম বুঝি ভালো থাকা?
চলবে...