বিশ্ব বাঁশ সম্মেলন

বাঁশছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর সব প্রজাতির বাঁশের প্রতিনিধিরা আজ এক জুম মিটিংয়ে মিলিত হয়েছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে আছে নানা প্রজাতির বাঁশ। বাঁশ নানাভাবে মানুষের উপকার করে। বাঁশকে বলা হয় গরিবের বন্ধু।  কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বাঁশ নিয়ে মনুষ্যকুল নানাবিধ অপপ্রচারে লিপ্ত।  বাঁশকে নেতিবাচক অর্থেই বেশি প্রচার করা হয়। বিশেষ করে উপকারের বদলে অপকার করলে বলা হয় বাঁশ দিছে। আবার কাউকে ঠকালে গ্রাম্য ভাষায় বলা হয় আইক্কাওয়ালা বাঁশ দিছে।  ওদিকে নানা কারণে বাঁশের প্রজাতি আজ হুমকির সম্মুখীন।  এ সব বিষয়কে সামনে রেখে আয়োজন করা হয়েছে বিশ্ব বাঁশ সম্মেলনের। বাঁশ সম্মেলনের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘বাঁশ দেওয়া মানে বাঁশ দেওয়া নয়’।

জুম মিটিংয়ের শুরুতেই বাংলাদেশের প্রতিনিধি সবাইকে বিশ্ব বাঁশ সম্মেলনে  স্বাগত জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের বাঁশ সম্প্রদায় যুগে যুগে মানুষের নানাবিধ উপকার করে যাচ্ছি। নৌকার লগি থেকে শুরু করে মানুষের ঘরের বেড়া পর্যন্ত সবকিছুই বাঁশের অবদান।’

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

যুগে যুগে বাঁশের ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে এ দেশের সভ্যতা সংস্কৃতি। এ দেশের নদীপথে একসঙ্গে অনেকগুলো বাঁশ বেঁধে নৌকার মতো চালিয়ে নেওয়ার দৃশ্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে আকাশে ওড়ানো হয় হাজার রঙের ঘুড়ি। বর্ষা মৌসুমে বন্যা হলে গ্রামে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে দেওয়া বাঁশের সাঁকো। খালে বিলে অসংখ্য বাঁশের সাঁকো তৈরি করে গ্রাম বাংলার মানুষ তাদের চলার পথকে সহজ করেছে। বাঁশের বাঁশির মনমাতানো সুর যুগে যুগে এ দেশের মানুষের মননে গড়ে তুলছে ইতিবাচক প্রভাব।  শোবার ঘর থেকে কবর পর্যন্ত মানব জীবনের সর্বত্রই বাঁশের ব্যবহার। কিন্তু এ দেশের মানুষের নানাবিধ উপকার করলেও আমরা তাদের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মানটুকু পাইনি। এ দেশে পাট খড়ির কিংবা ধঞ্চের যে দাম আছে বাঁশ হিসেবে আমাদের সে দাম নেই। এ দেশে ছাদ ঢালাইয়ে দুর্নীতিবাজ ঠিকাদাররা রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার করে আমাদের সম্মানহানি করছে। এ দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে বাঁশের অবদান অনস্বীকার্য। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা যুগে যুগে দেশবাসীর প্রতিবাদের অগ্নিশিখা রূপে কাজ করছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বাঁশের লাঠি নিয়ে  রনাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু কিছু ঘটনায় বাঁশের অপব্যবহারের কারণে বাঁশের সুনাম আজ হুমকির সম্মুখীন। লগি–বৈঠা নিয়ে ঢাকার রাজপথে মানুষ হত্যার দায় সরাসরি আমাদের বাঁশ জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। মনুষ্য সমাজ আমাদের অবদান ভুলে গিয়ে অবাধে বাঁশঝাড় উজাড় করছে। আগে প্রতি বাড়িতে বাঁশের ঝাড় ছিল অথচ সারা গ্রাম খুঁজেও এখন একটি বাঁশের ঝাড় খুঁজে পাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে আমাদের নিচিহ্ন করে ওদের ভাষায় বাঁশ জাতিকে চূড়ান্ত বাঁশ দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে।

আরও পড়ুন

ভারতের বাঁশ প্রতিনিধি আসামের বাঁশ বলেন, এ অঞ্চলে রয়েছে নানা প্রজাতির বাঁশ। এ অঞ্চলে জন্মে পৃথিবীর উৎকৃষ্টতম বাঁশ। এ অঞ্চলের বাঁশের প্রজাতির মধ্যে রয়েছে Bambusa balcooa- ঘরবাড়ি তৈরিতে,  Bambusa tulda- কাগজ শিল্পে,  Bambusa nutans সেতু নির্মাণে, Bambusa pallida- চা-বাগানে ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা বিনির্মাণে বাঁশের অবদান অনেক। কিন্তু যখন মরণ ফুল ফুটে।  কোটি কোটি বাঁশে ফুল আসে। বাঁশ মরে যাওয়ার আগে ফুল থেকে ফল হয়। সে ফল খেতে ঝাঁকে ঝাঁকে ইঁদুর আসে। সে ইঁদুর ফল খেয়ে বংশবিস্তার করে। একসময় মানববসতিতে ঢুকে পড়ে। মানুষ তখন ইঁদুরের উপদ্রবের জন্য আমাদের দায়ী করে। মানুষের এ আচরণে আমরা বিস্মিত! হতাশ!

ইউরোপ মহাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে ফ্রান্সের ‘La Bambouseraie en Cévennes’ ইউরোপের সবচেয়ে বড় বাঁশের উদ্যানের বাঁশ সদস্য বলেন, ‘ইউরোপে বাঁশ খুব কম জন্মে। এ দেশের বাঁশ শীত সহনশীল। সাধারণত সৌন্দর্যবর্ধনে ইউরোপে বিভিন্ন ধরনেন বাঁশের বনসাই তৈরি করা হয়। এ দেশের বিভিন্ন পার্কে বাঁশ চাষ করা হয়। আমরা ইউরোপীয় বাঁশ সংখ্যায় কম হলেও আমরা অত্যন্ত অভিজাত। পৃথিবীর নানা প্রান্তে আমাদের প্রজাতির ভাইদের রক্ষায় আমরা সোচ্চার।’

মনুষ্য সম্প্রদায়ের জানা উচিত মানুষে মানুষে বিভেদ থাকলেও বাঁশে বাঁশে কোনো বিভেদ নেই। বাংলাদেশের বাঁশের যে প্রজাতি, সে একই প্রজাতি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক, তাদের একই দিনে একই সময়ে ফুল ফুটে, তারা একই দিনে মারা যায়।

আফ্রিকার অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে নাইজেরিয়ার বাঁশ প্রতিনিধি বলেন, আমাদের অঞ্চলে বাঁশকে বলা হয় Green gold, এ অঞ্চলে ৫০ প্রজাতির বাঁশ জন্মে। গরিলা, হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণী জীবন ধারণের জন্য বাঁশের ওপর নির্ভরশীল। নাইজার নদীতে ভেসে ভেসে আমরা ছড়িয়ে যাই আফ্রিকার নানা প্রান্তে। সাহারা মরুভূমি, চাঁদ, ঘানা, ক্যামেরুন সবত্র বাঁশ ছড়িয়ে আছে আপন মহিমায়।

লাতিন আমেরিকার বাঁশ প্রতিনিধি হিসেবে আমাজন বনের গভীর অরণ্য হতে একজন বাঁশ সদস্য বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলে প্রায় এক হাজার প্রজাতির বাঁশ জন্মে। আমরা লাতিন আমেরিকার বাঁশ সারা পৃথিবীর বাঁশ সদস্যদের নেতৃত্ব দিতে চাই। তাদের সুখে দুখে অংশ নিতে চাই। বাঁশ নিয়ে  খাটো করে কথা বল্লে বিশ্ব বাঁশ সম্মেলনের মাধ্যমে যথাযথ জবাব প্রদান করা হবে।’

আরও পড়ুন

অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের বাঁশ প্রতিনিধি বলেন, বাঁশ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঘাস। আমাদের নর্দান টেরিটোরিত, আর্দ্র অস্ট্রেলীয় জঙ্গল এবং ট্রপিকাল রেইন ফরেস্টে প্রচুর বাঁশ জন্মে। ঔপনিবেশিক সময়ে এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে এখানে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ আনা হয়েছে। Bambusa vulgaris – সারা বিশ্বে ছড়ানো একটি বহুল ব্যবহৃত বাঁশ, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বাগানে দেখা যায়। আমাদের রেইন ফরেস্টের ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য রক্ষায় বাঁশ পালন করছে বিশেষ ভূমিকা। তাই এ সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে বলতে চাই, বাঁশের গায়ে দিলে হাত, হয়ে যাবে মহা সর্বনাশ!

এন্টার্কটিকা মহাদেশে কোনো বাঁশ জন্মায় না। ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে বাঁশের বংশবিস্তার করা যায় কি না, সে বিষয়ে সভায় একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

সভাপতির বক্তব্য বাংলাদেশের বাঁশ প্রতিনিধি বলেন, বাঁশ নিয়ে  মনুষ্য সমাজের সচেতন হওয়া দরকার। আপনারা জানেন, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জনক বাংলাদেশের সুযোগ্য সন্তান ফজলুর রহমান খান। তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং করার নকশা আবিষ্কার করেছেন। তাই তাকে বলা হয় স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আইনস্টাইন। তো তাকে একবার প্রশ্ন করা হলো আপনি উঁচু বিল্ডিং তৈরির ধারণা কোথা থেকে পেলেন। তিনি জানান, বাঁশ থেকে! ছোটবেলায় তার পড়ার ঘরের জানালার অদূরে ছিল একটা বাঁশের ঝাড়। একদিন প্রচণ্ড ঝড় এল। তিনি দেখলেন ঝড়ে বাঁশের ঝাড় নুয়ে পড়ছে কিন্তু ভেঙে পড়ছে না। এই বিষয়টা নিয়ে পরবর্তী সময়ে তিনি গবেষণা করে দেখলেন, বাঁশের মাঝখানে ফাঁকা আর নির্দিষ্ট দূরত্বে বাঁশ স্তরে স্তরে বিভক্ত। এ বিষয়টি পরবর্তী সময়ে তাকে উঁচু বিল্ডিংয়ের নকশা আবিষ্কারে সহায়তা করেছে। মনুষ্য সম্প্রদায়ের জানা উচিত মানুষে মানুষে বিভেদ থাকলেও বাঁশে বাঁশে কোনো বিভেদ নেই। বাংলাদেশের বাঁশের যে প্রজাতি, সে একই প্রজাতি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক তাদের একই দিনে একই সময়ে ফুল ফুটে, তারা একই দিনে মারা যায়। বিশ্বব্যাপী বাঁশেদের রয়েছে সুবিস্তৃত নেটওয়ার্ক। পৃথিবীর বাঁশ সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ তাই প্রতি দেশে বাঁশকে জাতীয় বৃক্ষের মর্যাদা প্রদান করতে হবে। বাঁশ নিয়ে ষড়যন্ত্র করা হলে বাঁশ ফুল ফুটিয়ে ইঁদুর ডেকে মনুষ্য প্রজাতিকে শায়েস্তা করা হবে। তাই সবশেষে বলতে চাই—বাঁশ দেওয়া মানে বাঁশ দেওয়া নয়।

*লেখক: সুলতান মাহমুদ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, শরীয়তপুর।

আরও পড়ুন