হারিয়াল বিলে এক রাত
‘মাইট্যা জোৎস্না রাইত। চারদিক ক্যামন ফকফকা। বিয়ান হইয়া গেল নাকি?’ মিন্টুর ঘুম ভেঙে গেছে। বর্ষার পানি টান দিছে। হারিয়াল বিলে মাছ কিলবিল করে। ঘুম ভেঙে মিন্টু যেন মাছের ডাক শুনতে পায়। আনমনেই ঝাঁকি জালের ওপর হাত চলে যায়। গাবের কষ দিয়ে জালটা ঘষা হয়েছে কয় দিন আগে। বিলে মাছ ধরার মৌসুমে জালটি মিন্টুর একমাত্র ভরসা। ফজরের আজান হয়েছে কি না, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে আজান না হলেও রাত আর বেশি বাকি নেই ভাবে মিন্টু। ঝাঁকি জাল কাঁধে করে সে ঘরের খিড়কি খুলে বের হয়ে আসে। বাড়ির উঠানের কোণে ডালিমগাছের নিচে কুকুরটি ঘুমাচ্ছে। ‘রাত তো প্রায় শেষ হইয়া আইলো, তবু কুত্তার ঘুম ভাঙে না। বড়ই আইলসা কুত্তা,’ মনে মনে ভাবে মিন্টু। বাড়ির পেছনে কলতলার পাশ দিয়ে একটা সরুপথ চলে গেছে বাঁশঝাড়ের মাঝখান দিয়ে। বাঁশঝাড় পার হতেই একটা বিশাল চক। চক পার হলেই একটা বড় কাঁচা রাস্তা। রাস্তার সঙ্গেই বিশাল হারিয়াল বিল।
মিন্টুর একটা ছোট কোষা আছে হারিয়াল বিলের ধারে। কোষা বেয়ে সে চলে যায় বিলের ওপাড়। সেখানে একটি খাল আছে। বর্ষার পানি টান দিলে খালের মুখ দিয়ে নামে বড় বড় রুই–কাতলাসহ নানা ধরনের মাছ। মিন্টু সেখানেই যাবে মাছ ধরতে। মাছ ধরা অবশ্য তার পেশা নয়। তার মূল পেশা গেরস্তালিকাজ। বর্ষার এই সময়তেই সে কেবল মাছ ধরে। এটা মিন্টুর জন্য একটা বাড়তি রোজগারের পথ। বাড়তি রোজগার করা তার খুব জরুরি। বছর তিনেক আগে সে মালয়েশিয়া গিয়েছিল। বিদেশ গিয়ে নগদ টাকাপয়সাও হইছিল। সারা বছর খাজনা জমিতে ঘর উঠায়ে থাকছে। বিদেশ গিয়া এলাকায় জমি কিনছে। জমিতে চৌচালা ঘর উঠাইছে। একটা ল্যাট্রিন করছে। কল উঠাইছে। বাপ–মায়ের কাছেও মিন্টুর একটা দাম হইসে। সংসারে তার কথার গুরুত্ব বাড়ছে। কিন্তু ঘটনা অন্যখানে। বিদেশ গিয়া সে নতুন মুঠোফোন কিনছে। বন্ধু গো পাল্লায় পইড়া হারা রাইত মাইয়াগো নম্বর খুঁইজা খুঁইজা মিসড কল দেয়। মিসড কল দিতে দিতে এক মাইয়ার লগে পরিচয় হয়। মাইয়ার বাড়ি টাউন এলাকায়। ধোলাইপাড় বস্তিতে থাকে। কথা কয় নায়িকা গো মতন ঢং কইরা। পোলাগো ক্যামতে পটাইতে হইব, সে কৌশল মাইয়ার ভালো মতন জানা। মিন্টুও পইট্টা গেল। মাইয়ারে দেশে আইসা বিয়া করব বইলা কথা দেয়। ময়মুরব্বিরে জানায়, কিন্তু বাড়ির কেউ রাজি হয় না। বিশেষ কইরা মাইয়ার ফটো দেইখা কারও পছন্দ হয় না। চেহারা কেমন বুড়ি বুড়ি। বয়স মিন্টুর থেকে বেশি ছাড়া কম হইব না। কিন্তু ময়মুরব্বিগো নিষেধ ধোপে টিকে না। মিন্টু এই মাইয়ারেই বিয়া করব। পোলা রুজি কামাই করে। বাপ–মাও কিছু বলতে পারে না। বিদেশথন আইসা অষ্টগ্রামের মানুষেরে লইয়া বহুত ধুমধামে মাইয়ারে ঘরে তোলে। বিয়ার পরে বউরে লইয়া হারাদিন পইড়া থাকে। ওদিকে বিদেশে যাওয়ার ভিসার মেয়াদও শ্যাষ শ্যাষ। একদিন সে ঘোষণা দেয় বিদেশ যাইব না। ব্যবসা করব। ব্যবসা বৈধ হইলে কথা ছিল, কিন্তু মিন্টু একটা অবৈধ ব্যবসায় জড়ায় যায়। থানা–পুলিশ ফাঁকি দিয়া এই ব্যবসা চালানো তার জন্য কঠিন হইয়া যায়। একসময় সে চোক্ষে আন্ধার দেখে। ব্যবসায় লাল বাত্তি জ্বলে। কোনো দিকে দিশামিশা না পাইয়া শেষ পর্যন্ত গেরস্তালি কামে লাগে, আর সময় পাইলে মাছ ধরার জাল নিয়া পানিতে নামে। ওই দিকে পিরিতে টান লাগে। সংসারে অভাব। পিরিতি বেড়ার ফাঁক দিয়া বাহির হইয়া যায়। বউ একমাত্র কোলের সন্তানরে নিয়া বাপের বাড়ি পাড়ি জমায়। কথা নাই বার্তা নাই একদিন তালাকের নোটিশ পাঠায়। তার দুই মাস বাদে লিগ্যাল এইডে মিন্টুর নামে নোটিশ আসে। নোটিশে ভরণপোষণ দেওনের রায় হয়। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে মিন্টুর প্রতি মাসে ভরণপোষণ বাবদ বউরে টাহা দিতে হয়। এর মাঝে মিন্টু আরেকটা বিয়া করছে। সেই ঘরেও পয়পোলাপান আছে। সব মিলাইয়্যা বেচারা পড়ছে এক মাইনক্যা চিপায়।
মিন্টু বিলের ধারে আইসা কোষার ওপর ওঠে। বিলের ধারে বটগাছে একটা প্যাঁচা। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে মিন্টুর দিকে তাকিয়ে আছে। মিন্টু আড়াআড়িভাবে কোষাটা বাইতে থাকে। বিল পানি টান দিছে। কেমন কলকল একটা শব্দ। একটা ছন্দের তালে যেন বিলের পানি নামছে। পানির শব্দে মিন্টুর নেশা জাগে। এই শব্দ মিন্টুর অনেক চেনা। এই বিলে তার অনেক স্মৃতি। মিন্টুর প্রিয় ঋতু বর্ষা। গাঁয়ের বৈচিত্র্যহীন জীবনে বর্ষা যেন এক বিপুল উৎসবের ডালি নিয়ে আসত তার শৈশবে। পুরো বর্ষায় সে বন্ধুদের নিয়ে বিলে জলকেলি করত। বিলের স্বচ্ছ পানির নিচে সে ডুব দিয়ে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ দেখত। কোষা নিয়ে ঘুরে বেড়াত সারা গ্রাম। বড়শি দিয়ে ধরত নানা প্রজাতির মাছ। এ আনন্দ কেবল বর্ষায়ই পাওয়া যেত। তার শৈশবের বর্ষাগুলো ছিল রঙিন, দুরন্তপনায় ভরপুর। যেন এক লাল শাপলার ফুল, যে দুলত বিলের পানিতে!
‘চারদিকে অহনো কেমন আন্ধার। ফজরের কি অহনো অনেক বাকি! আমি কি একটু আগেই বাহির হইয়া গেলাম,’ মিন্টু মনে মনে ভাবে। চাঁদের আলোয় সে বিভ্রান্ত হয়ে সকাল ভেবে অনেক আগেই চলে এসেছে। এখন গভীর রাত। রাতের এ গভীরতায় অনেক কিছু ঘটে। অনেক অলৌকিক কিছু, যা সব সময় সুখকর হয় না। মিন্টু কোষা বেয়ে খালের মাথায় চলে এসেছে। নাহ্, এখনো কেউ আসেনি। মিন্টু ধীরে ধীরে কোষা বেঁধে জাল নিয়ে খালের পাড়ে নেমে পড়ে। মিন্টু ছোটবেলায় এ খালের পাড়ে একজন শৌখিন মৎস্যশিকারিকে মাছ ধরতে দেখত। তিনি স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক। বর্ষায় যখন পানি টান দিত, তখন ইয়া বড় একটা জাল নিয়ে মাছ ধরতে আসতেন। তাঁর সঙ্গে মাছ ধরে কেউ পারত না। ইয়া বড় বড় রুই–কাতলা ধরা পড়ত তাঁর জালে। মজার ব্যাপার হলো, সে মাছ ধরলে এর প্রায় বেশির ভাগই আশপাশের সবাইকে দিয়ে দিতেন। খুব অল্পই নিজের জন্য রাখতেন। মাছ ধরাটা আসলে ছিল তাঁর নেশা।
বাবলাগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে মিন্টু ঝাঁকি জাল ফেলে খালের প্রবহমান পানির ওপর। জাল টেনে সে হতাশ হয়। আশ্চর্য! একটা মাছও ওঠেনি। সে কিছুটা হতাশ হয়। এ সময় তো এমনটা হওয়ার কথা নয়। সে আরও খেও দিতে থাকে। নাহ্, কোনো মাছ নেই। যেন সব গায়েব হয়ে গেছে। মিন্টু ক্লান্ত হয়ে যায়। পুবের আসমানে এখন আন্ধার। চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। পোকারাও যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। মোরগের ডাক আর কত দেরি। বিয়ান আর কখন হইব আল্লাহ মালুম। হঠাৎ একপশলা গরম বাতাস বয়ে যায়। মিন্টুর সারা শরীর কেমন কাঁটা দিয়ে ওঠে। অজানা কারণে ভয়ের একটা স্রোত বয়ে যায় তার শিরদাঁড়ায়! একটু দূরে কে যেন জাল ফেলে মাছ ধরছে! এতক্ষণ সে লোকটাকে দেখেনি। ‘এই লোক কখন আইল?,’ মনে মনে ভাবে মিন্টু। সে ধীরে ধীরে লোকটার কাছে যায়। আরে এ তো কুলসুমের বাপ। কুলসুম মিন্টুর ছোট্টোবেলার খেলার সাথি। ওরা একই স্কুলে পড়ত। এই খালের দক্ষিণে কিছুটা দূরে কুলসুমদের বাড়ি। বিয়ে হয়ে গেছে। অনেক দিন কোনো খোঁজখবর নেই।
মিন্টু ধীরে ধীরে কোষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু কুলসুমের বাবার নাগাল পায় না। সে যত সামনে এগোয় কুলসুমের বাবাও তত দূরে সরে যায়। যেন চোর–পুলিশ খেলা চলছে। সে বুঝতে পারছে কুলসুমের বাবা তাকে দেখেই এমনটা করছে। সে নিরাশ হয়ে কোষা রেখে আবার মাছ ধরায় মনোযোগ দেয়। ঝাঁকি জাল দিয়ে খেওয়ের পর খেও দিচ্ছে। কোনো মাছ ধরা পড়ছে না। সব মাছ যেন গায়েব হয়ে গেছে। সে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দূরে কুলসুমের বাবা মাছ ধরছে। তার জালে মাছ ধরা পড়ছে, এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু মিন্টুর এখানে কোনো মাছ নেই। একটা কূপপক্ষী ডেকে যাচ্ছে দূরে কোথাও। কূপপক্ষীর ডাকে নীরব বিলে মিন্টুর মনে কেমন ভীতির সঞ্চার করে।
চাঁদের মৃদু আলো পড়েছে হারিয়াল বিলজুড়ে। কেমন নীরব, কেমন ভৌতিক পরিবেশ। হঠাৎই মিন্টু আবিষ্কার করে কুলসুমের বাবা মিন্টুর পাশে দাঁড়িয়ে প্রায় ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। সে কিছুটা হচকিত হয়ে যায়।
মিন্টু ছোটবেলায় এ খালের পাড়ে শৌখিন মৎস্যশিকারিকে মাছ ধরতে দেখত। তিনি ছিলেন স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক। বড় বড় রুই–কাতলা মাছ ধরা পড়ত জালে। মজার ব্যাপার হলো, মাছ ধরলে এর প্রায় বেশির ভাগই আশপাশের সবাইকে দিয়ে দিতেন। অল্পই নিজের জন্য রাখতেন।
- চাচা আপনে?
- হ আমি। তোমার কাছে বিড়ি আছে?
- না চাচা, বিড়ি নাই।
- তা মাছ–বইচা কিছু পাইছ?
- না চাচা।
- মাছ হইল ভাইগ্য, তোমার ভাইগ্য খারাপ।
- হ চাচা, ঠিকই কইছেন। তা আপনে কেমুন পাইছেন।
- ম্যালা।
- কই দেহি?
- এই যে দেহ।
মিন্টু অবাক হয়। বড় সাইজে ২০–৩০টা রুই মাছ দেখে।
- চাচায় তো ম্যালা মাছ ধরছেন।
- হ। ভাবতাছি মাছগুলান তুমারে দিয়া দিমু। নিবা?
- আমারে দিবেন! কন কি?
- হ। তয় তুমার একটা কাজ করতে হইব।
- কী কাম?
- আমার লগে কুস্তি খেলতে হইব
- কি কন আবোলতাবোল। আপনের লগে আমি কুস্তি খেলুম?
- হ, খেলবা।
- নাহ্, আমার মাছ লাগব না।
- তুই খেলবি না তোর বাপ খেলব, বলেই সে মিন্টুর গলা চেপে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় মিন্টু হতবিহ্বল হয়ে যায়। ঠিক কী ঘটছে, তা ঠিক বুঝতে পারছে না। একজন বয়স্ক মানুষ। যার গায়ে তেমন শক্তিও নেই সে মিন্টুকে এত জোরে চেপে ধরতে পারে, এটা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিজেকে বাঁচানোর জন্য সে পাল্টা প্রতিরোধ করে। একটা ঝাঁকি দিয়ে সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। কিন্তু কুলসুমের বাপ আবার তার দিকে তেড়ে আসে। এ বুড়ো কেন পাগলামি করছে মিন্টু বুঝতে পারছে না। সে আবার পাল্টা প্রতিরোধ করে। এটা চলতেই থাকে। ঘণ্টা দুয়েক পর মিন্টু ক্লান্ত হয়ে যায়। কিন্তু কুলসুমের বাপের মধ্যে কোনো ক্লান্তির লক্ষণ নেই। সে শক্ত করে মিন্টুর গলা চেপে ধরে। মিন্টুর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেকে ছাড়াতে, কিন্তু পারে না। তার দম বন্ধ প্রায়। কুলসুমের বাপ মনে হয় তাকে মেরেই ফেলবে। হঠাৎ ফজরের আজান ভেসে আসে। আজানের সঙ্গে সঙ্গে সব ফাঁকা! কুলসুমের বাপ নেই। মাছ নেই। মিন্টু একা হাঁপাচ্ছে। মিন্টু ধীরে ধীরে ওঠে দাঁড়ায়। ‘এইডা তাইলে ভূত আছিল!’ মিন্টু বিড়বিড় করে। সে আবার বাবলাগাছের গোঁড়ায় আসে। মাছে কিলবিল করছে জায়গাটা। জাল ফেলতেই কয়েকটি রুই মাছ ধরা পড়ে। মিন্টু খুশি হয়ে যায়। ভোর থেকে সকালের আলো ফোটা পর্যন্ত সে অনেক মাছ ধরে। কোষাটা মাছে ভরে ওঠেছে। একজন বয়স্ক লোক ধীরে ধীরে মিন্টুর দিকে আসছে। তার কাঁধে জাল। মিন্টু ভালো করে তাকিয়ে দেখে লোকটি তার বান্ধবী কুলসুমের বাপ!
*লেখক: সুলতান মাহমুদ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, শরীয়তপুর।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]