ইউরো সফরের গল্প পর্ব-৬: সুইজারল্যান্ডে কয়েক দিন
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
২৩তম দিন...
আজকে আমরা সবাই শিহরিত, সুইজারল্যান্ড যাচ্ছি। আমরা মিলান থেকে ইতালির ভোরের ট্রেনে ইতালি সীমান্তের চিয়াসো হয়ে সুইজারল্যান্ডের বেলিনজোনা যাব। সেখান থেকে সুইস ট্রেনে যাব সুইজারল্যান্ডের অন্যতম সুন্দর শহর লুজার্ন। শহরটা লুজার্ন নামের বেশ বড়সড় হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে। গ্রীষ্মের সময় সারা পৃথিবীর পয়সাওয়ালা লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যায় আর এমনিতে সারা বছর লাখো পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। আমরা সুইজারল্যান্ড দুই দিন থাকব বলে এক মাস আগে সুইস রেলের Saver Day Pass কিনে রেখেছিলাম। এটার দাম প্রতিদিনের জন্য জনপ্রতি পড়েছিল ৫২ ইউরো বা সুইস ফ্রাঁ। তাই আমরা দুদিনের জন্য জনপ্রতি দুইটা করে কিনেছিলাম। এ পাসে যেকোনো সরকারি বাস, ট্রাম, ট্রেন, যেকোনো জলযান, যেকোনো সরকারি কেব্লকার সারা সুইজারল্যান্ডে সারা দিনের জন্য ফ্রি। তবে অল্প কিছু আঞ্চলিক বেসরকারি কেব্লকার আর রিসোর্টের নিজস্ব বাহনে ৫০ শতাংশ সুবিধা পান পর্যটকেরা। সেটাই খারাপ কি?
তাই ইতালির সীমানা পর্যন্ত ট্রেন টিকিট কিনে উঠে পড়লাম বেলিনজোনার উদ্দেশে। সেখানে মিনিট ১৫ অপেক্ষার পর গথার্ড প্যানরমিক ট্রেনে উঠে বসলাম। আপনারা জানেন যে সুইজারল্যান্ড চারটি ভিন্নভাষী বেশ কয়েকটা ক্যান্টন নিয়ে গঠিত একটা দেশ। উত্তরে জার্মানভাষী, পূর্বে রোমানস ভাষা, দক্ষিণ–পশ্চিমে ফরাসি আর দক্ষিণে ইতালীয়ভাষী। ইতালিভাষী অঞ্চলের ভূপ্রকৃতিও আলাদা, গাছপালা আচার–আচরণ একদম ভূমধ্যসাগরীয়। আপনারা গেলেই বুঝবেন। তাই কিছুটা উষ্ণ আবহাওয়ার বেলিনজোনা থেকে যখনি এই প্যানরমিক ট্রেনটা উঁচু গথার্ড উপত্যকা পেরিয়ে উত্তর সুইজারল্যান্ড যায়, সেটা এক অপূর্ব দৃশ্য। আজকাল ট্রেনগুলো মিলান থেকে জুরিখে বিশাল লম্বা সুড়ঙ্গ দিয়ে যায় বলে সাধারণ মানুষ এর সৌন্দর্য দেখতে পায় না, এসব বিশেষ প্যানরমিক বা নৈসর্গিক ট্রেন সফরে পুরোনো রেললাইন ধরে নিয়ে যায়, তাই আমরাও তেমন ট্রেনে উঠে আশপাশের দৃশ্য দেখে আহ্লাদিত হলাম। ট্রেনটা যাবে জুরিখে, কিন্তু এ ট্রেনের যাত্রীরা সব লুজার্ন হ্রদের তীরের ফ্লুয়েলেনে নেমে মোটর লঞ্চে নৌবিহার করতে করতে লুজার্ন যায়।
কিন্তু আমাদের সময় কম, দেখতে হবে বেশি। তাই এখানে না নেমে আমরা দুই–তিন স্টেশন পরের আর্থ-গোল্ডাও নামলাম। স্টিশনের পাশে রিগি পাহাড়সারি। পাহাড়সারি গিয়ে মিশেছে লুজার্ন হ্রদের পাড়ে। স্টেশন থেকে ৪৫°কৌণিক হেলানো ছোট ট্রেনে করে রিগি পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা যায়। শীতকাল বলে পাহাড় ঘন সাদা তুষারে ঢাকা, সে কী অতিপ্রাকৃত দৃশ্য! আমরা উঠে গরম গরম চকলেট পানীয় আর কফি খেলাম আর বাচ্চাদের সঙ্গে স্নোমেন বানালাম। নিজেদের শিশুপনাতে নিজেরাই অবাক হলাম। এরপর সেখান থেকে আরেকটা কৌণিক ট্রেনে করে ভিটজনাউ নামের লুজার্ন লেকের পাড়ের লঞ্চঘাটে এসে নামলাম। আমরা চাইলে কেব্লকারেও নামতে পারতাম। কিন্তু সময় মেলেনি বলে ট্রেনে চড়ে নামামাত্র আমাদেরকে লুজার্নে নেওয়ার জন্য মোটর লঞ্চ হাজির। আমরা সবাই সেটাতে ভালো সিট পাওয়ার খায়েসে হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম।
সেখানেও গরম গরম চকলেট পানীয় খেলাম। আসলে তাপমাত্রা এতটাই কম ছিল যে না খেয়ে উপায় ছিল না।
লঞ্চটা সুন্দর মায়াবী হ্রদে সাঁতার কেটে লুজার্ন শহরের ঘাটে এসে ভিড়ল। ঘাটের ঠিক উল্টো পাশেই রেলস্টেশন। কিন্তু আমরা তখনই ট্রেনে না উঠে শহরটাতে একটু ঢুঁ মারলাম। স্টেশনের পাশের রাস্তা ধরে পুরোনো লুজার্ন গেলাম। সেখানে কাঠের সেতুতে একটা দুর্গ কাঠামো আছে, যেটা শখের পর্যটকেদের কাছে খুবই পরিচিত।
যেটাকে সবাই চ্যাপেল ব্রিজ বলে!
এরপর পুরোনো লুজার্ন ছেড়ে শহরের প্রান্তে হ্রদের ধার ঘেঁষে বাঁধানো পাড় দিয়ে অনেকখানি হাঁটলাম। এই promenade–এ সারি সারি ক্যাসিনো আর দামি দামি হোটেলের সারি। এখানেই মধ্যপ্রাচ্যের আর অন্যখানের বড়লোকেরা তাদের টাকার গাঁটরি খালি করে।
এরপর আমরা সন্ধ্যা নামার আগেই ট্রেনে করে রাতের আবাস বার্ন শহরে গেলাম। বার্ন এ দেশের রাজধানী। এখানে ওভট্রেন স্টেশনের পাশের পুরোনো বার্নের রাস্তা ধরে আমরা আরে নদী পেরিয়ে প্রান্তের টিলার ওপরের গোলাপবাগানে হাজির হলাম। ইচ্ছা ছিল এদের বিখ্যাত পনিরের তৈরি ফন্দ্যু খাব। সেটার জন্য আমরা অনেকটা হন্যে হয়ে বিখ্যাত এক রেস্তোরাঁতে হাজির হলাম। এ রেস্তোরাঁ খুঁজতে গিয়ে কী অদ্ভুত সব কাণ্ডকলাপ হলো, সেটা আরেক বিরাট কাহিনি।
গিয়ে দেখি জায়গা ফাঁকা নেই, আর খাবারের দাম আকাশ, ৪৭ সুইস ফ্রাঁ। জাতীয় খাবার বলে কথা। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার আগে আমাদের হাতে অপেক্ষার সময় নেই বলে কেটে পড়লাম। এরপর ঠান্ডা আবহাওয়া উপেক্ষা করে ইউনেসকো হেরিটেজখ্যাত সুন্দর শহরটা মায়াবী চাদের আলোয় উপভোগ করতে করতে বেশ রাতের দিকে আমরা আমাদের আবাসে ফেরত এলাম।
২৪তম দিন...
খুব ভোরে উঠে সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত পর্বত ‘মেটারহর্ন’ দর্শনে হাজির হলাম জের্মাত নামের শহরে। আগে কেটে রাখা টিকিটে কৌণিক গর্নারগ্রাট রেলে চেপে পর্বতের ওপরে উঠে পাশের ম্যাটারহর্ন পর্বতের চূড়ার দৃশ্য অসাধারণ লাগে, আর যখন উদীয়মান সূর্যের আভা চূড়াটাকে আলোকিত করতে থাকে, তখন নিজেকে বিরল সৌভাগ্যবানদের একজন ভাবতে পেরে ভীষণ ভালো লাগা কাজ করে।
আমরা সূর্যটা বেশখানি উজ্জ্বল হওয়ার পর সেখান থেকে সেই মজার ট্রেনে নেমে এলাম। এরপর আমরা আরেকটা সুন্দর জায়গার দিকে রওনা দিলাম। এ পথ আমাদের নিয়ে গেল জের্মাত থেকে ভিস্প, এন্ডারমিট হয়ে ক্যুর শহরে। ক্যুর হলো সুইজারল্যান্ডের এক প্রাচীন শৈল শহর। ট্রেনের এ পথটা হলো ‘গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস’ নামের প্যানরমিক ট্রেনের রুট। একটার একটা নৈসর্গিক দৃশ্য। আমরা একের পর এক স্টেশন পাড়ি দিয়ে বরফে ঢাকা অপরূপ পাহাড়চূড়া পাড়ি দিয়ে মনোরম সন্ধ্যায় হাজির হলাম ক্যুর শহরে।
আমাদের আজকের আবাস স্টেশনের পাশের এক এয়ারবিএনবি। স্টেশন থেকে ‘হ্যাপি আওয়ারে’ মজার সব বেকারিসামগ্রী কিনে রাতের আহার শেষ করলাম। আগামীকালের পরিকল্পনা হলো দুনিয়ার সবচেয়ে নির্ভেজাল বাতাসওয়ালা শৈল শহর আরোসা যাওয়ার।
২৫তম দিন...
আমরা খুব ভোরে ক্যুর স্টেশন থেকে একটা মজার টয় ট্রেনে চড়ে আরোসার কাছাকাছি এক স্টেশনে হাজির হলাম। ট্রেনটা ভালুক আর নেকড়ের সাজে সাজানো। তার বাইরে ভেতরে এদের মোটিফ।
সেই স্টেশনে থাকা রিপ্লেসমেন্ট বাসে করে আরোসা হাজির হলাম। আমরা যারা গরমের দেশের লোক, তাদের কাছে দিগন্তবিস্তৃত বরফে ঢাকা প্রান্তর আর পাহাড় পর্বত এক জাদুকরি ব্যাপার। হতবুদ্ধি হতে হয়। আরোসাতে পৌঁছে আমরা হকচকিত। এখানে সবাই স্কি করতে এসেছে। মানুষের মাঝে সে কী আনন্দ আন্দোলন! আমরা তো আর স্কিয়ার নই, তাই কেব্ল কারে করে উঁচু চূড়াতে উঠে আশপাশের দিগন্তবিস্তৃত বরফে ঢাকা পাহাড় চূড়া দেখে উদ্বেলিত হলাম। এটা ভাষায় বোঝানো অসম্ভব।
অনেক রকম ছবিটবি তুলে বেশ কিছু সময় থেকে ফিরতি পথে ক্যুর চলে এলাম। এরপির ক্যুর থেকে জুরিখের পথে রওনা দিলাম।
সুইজারল্যান্ড দেশটা এত্ত সুন্দর আর গোছানো আর এদের ট্রেনগুলো সময়নিষ্ঠ যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যেতে কোনো কষ্ট হয় না। ঘন ঘন ট্রেন আর কানেকশন জীবন অনেক সহজ করে দিয়েছে।
আমরা জুরিখ চলে এলাম সন্ধ্যার পর। আমাদের প্যারিস যাওয়ার টিজিভি ট্রেন রাতের দিকে, পৌঁছাতে লাগবে তিন–চার ঘণ্টা।
তার আগে আমরা শহরটাকে একটা চক্কর দিলাম। স্টেশনের এক পাশ দিয়ে পুরোনো শহরের শুরু, যেটা শেষ হয়েছে জুরিখ হ্রদে। আমরা ঠান্ডায় কাবু না হয়ে সুন্দর এ পথে, এগলি ওগলি করে জুরিখ হ্রদের পাড়ে পৌঁছালাম। জুরিখের এ পুরোনো ভবনগুলোতেই সব দামি ব্যাংক আর প্রসাধনসামগ্রীর দোকান, আর আছে সব আকাশছোঁয়া দামের ঘড়ির দোকান, অনেক চকলেটের দোকান। আর আছে পর্যটকদের রসনাবিলাসের সারি সারি সব খাবারের দোকান।
সময়ের অভাবে জুরিখ হ্রদে নৌবিহার করতে পারিনি। অবশ্য গতবার গ্রীষ্মে আমরা সেটা করেছিলাম। তাই প্যারিসে যাওয়ার ট্রেন ধরতে হ্রদে পড়া লিমাত নদীর ধার ঘেঁষে হেঁটে হেঁটে মূল ট্রেন স্টেশনে চলে এলাম।
লকার রুম বা মালগুদাম থেকে মালপত্র বুঝে নিয়ে উঠে পড়লাম টিজিভি ট্রেনে। সেটা দ্রুতগতি নিয়ে আঁধার ভেদ করে শেষ রাতের দিকে নিয়ে এল সুন্দরী প্যারিসে।
আমরা প্যারিসে আজ রাত থাকব শুধুই কাল শেষ সকালের দেশে ফেরার প্লেন ধরার জন্য। তাই কোনো রকম ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে ট্রেন থেকে নেমেই ঘুমাতে গেলাম আগে থেকে ঠিক করে রাখা এয়ারবিএনবিতে। এত্ত সব মজার অনুভূতি নিয়ে ঘুমাতে যাওয়াটা ছিল রীতিমতো উত্তেজনার।
আমাদের ইউরোপ সফর আসলে কতখানি লেখালেখিতে বোঝাতে পেরেছি, তা নিশ্চিত নয়, তবে আপনি যদি এ রুটগুলো ব্যবহার করে ঘুরতে যান, আপনার অভিজ্ঞতা আরও মজার আরও উত্তেজনায় ভরপুর হতে পারে। আপনারা খরচ কমানোর জন্য আর টাকাগুলো আরও বেশি মজার খাতে খরচ করতে চাইলে, আগেভাগে টিকিট কাটবেন, যেমনটা আমরা করেছিলাম, শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনসে আমাদের ঢাকা–প্যারিস–ঢাকা এসেছিল ৬৭ হাজার মাত্র, যদিও সেটা কলম্বো হয়ে, তাতে ক্ষতি কী? আর এ বছরের জুনে যাওয়ারটা পড়েছে আরও কম, মাত্র ৬৫ হাজার। শারজা হয়ে এয়ার অ্যারাবিয়াতে যাচ্ছি এবার ভিয়েনা। ট্রানজিট বেশি হলেও ক্ষতি কী? ট্রানজিট ভিসায় গতবার আমরা কলম্বো দেখেছি আর এবার দেখব শারজাহ।
আর অদরকারি পোশাক–আশাক না নিলে ইউরোপের কানেক্টিং budget airlines–গুলো অল্প মালপত্রে আরও সস্তা পড়ে। এয়ারবিএনবিগুলো আগেভাগে কাটলে লোকেশন বা এলাকাগুলো ভালো আর কম দামে পাওয়া যায়। খাবার খাওয়াটাও একটা অভিজ্ঞতা, এটাতে বেঁচে যাওয়া টাকা বিনিয়োগে ভুঁড়ি কিঞ্চিত বাড়লেও, মনের আনন্দ হবে অমলিন আর পর্যটনের দিনগুলো রবে সোনার খাঁচায় বন্দী সারা জীবনের তরে। শেষ...